‘আমি ওপরের দিকের বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যান হতে চাই’

কিছুক্ষণ পরই ইসলামাবাদ থেকে দেশের বিমান ধরার কথা মেহেদী হাসান মিরাজের। চেক ইন, ইমিগ্রেশন শেষে লাউঞ্জে বিমানের অপেক্ষায় ছিলেন মিরাজ ও দলের অন্য সদস্যরা। আগের দিন রাওয়ালপিন্ডিতে ইতিহাস গড়ার কারিগর কাল বিমানবন্দরে বসেই প্রথম আলোকে মুঠোফোনে শোনালেন পাকিস্তান সফরে তাঁর নায়কোচিত পারফরম্যান্সের গল্প। আসন্ন ভারত সফর নিয়েও শুনিয়েছেন তাঁর ভাবনার কথা।

প্রথম আলো:

পাকিস্তানে ঐতিহাসিক সিরিজ জয়, সেখানে ম্যাচ অব দ্য সিরিজের পুরস্কার জিতলেন আপনি। অনুভূতিটা কেমন?

মেহেদী হাসান মিরাজ: আমাদের টেস্ট ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় অর্জন মনে হয় এটাই। পাকিস্তানের মাটিতে দুটি টেস্ট জেতা, তাদের মাটিতে, এটা বিরাট ব্যাপার। সেখানে আমি পারফর্ম করেছি, ম্যান অব দ্য সিরিজ হয়েছি, দলের অন্যরাও সিরিজের বিভিন্ন সময় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে, সব মিলিয়ে অসাধারণ এক অনুভূতি। দলের সবাই খুব করে চেয়েছে ভালো করতে। জয়-পরাজয় পরের ব্যাপার। সবার মন থেকে ভালো করতে চাওয়ার বিষয়টা একজন আরেকজনকে খুব করে অনুপ্রাণিত করেছে।

প্রথম আলো:

সিরিজজুড়ে বারবার আপনারা সিলেট-চট্টগ্রামের বিশেষ ক্যাম্পের কথা বলছিলেন। সেটার প্রভাব কতটা ছিল এই সিরিজ জয়ে?

মিরাজ: আমরা সবাই ওই সময়টায় অনেক কষ্ট করেছি। ক্যাম্প হয়েছে ঢাকার বাইরে। সবাই পরিবার ছেড়ে অনুশীলন করেছে। শুধু আমরা নয়, স্থানীয় কোচিং স্টাফের সবাই, প্রত্যেকেই অনেক স্যাক্রিফাইস করেছে। যারা সুযোগ-সুবিধার দেখাশোনা করেছেন, তাঁরাও। প্রত্যেকের কথা বলছি; কারণ, আমি বিশ্বাস করি, আমাদের এ অর্জনে তাঁদের সবার অবদান আছে। এটি আমার দেখা অন্যতম সেরা ক্যাম্প ছিল। আমরা সেটার ফলই পেলাম।

প্রথম আলো:

পাকিস্তানে আগে যাওয়াটা কতটা সাহায্য করেছে? শুনেছি, গরমের সঙ্গে মানিয়ে নিতে এই আগে যাওয়াটা খুব কাজে দিয়েছে...

মিরাজ: আমাদের ১৭ তারিখ আসার কথা ছিল। সেটি হলে চার দিনে এত ভালো প্রস্তুতি নেওয়া হতো না। গরমের জন্য মানিয়ে নিতেই আমাদের তিন দিন লেগেছে। পরের চার দিন আমরা ভালোমতো অনুশীলন করতে পেরেছি। মুশফিক ভাই, সৌরভ ভাইদের (মুমিনুল) আরও সুবিধা হয়েছে। ‘এ’ দলের হয়ে ওনারা আরও আগে এসেছেন। দেশের বাইরে ভালো করতে গেলে এমন প্রস্তুতিই থাকা উচিত। জেতা-হারার বিষয়টা পরে, কিন্তু এমন হলে ভালো করার সম্ভাবনা বেশি থাকে। জানি, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বর্তমান সূচির চাপে সব সময় এভাবে প্রস্তুত হওয়া সম্ভব নয়। তবে চেষ্টা থাকলে সামনেও ভালো করার সম্ভাবনা বাড়বে।

প্রথম আলো:

ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সে আসি। সিরিজজুড়েই আপনার সেরা পারফরম্যান্সগুলো এসেছে দলের বিপদে। ২৬ রানে ৬ উইকেট থেকে লিটন দাসের সঙ্গে, প্রথম টেস্টে মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে জুটি। দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম দিনে রাওয়ালপিন্ডির মতো ব্যাটিং-স্বর্গে ৫ উইকেট নেওয়া...দারুণ সব কীর্তি।

মিরাজ: দেখুন, ২৬ রানে ৬ উইকেট যাওয়ার পর আমিই কিন্তু সর্বশেষ স্বীকৃত ব্যাটসম্যান ছিলাম। বল তখনো নতুন। আমি চেষ্টা করলে ভালো ব্যাটিং করতে পারি, এই বিশ্বাসটা সবার ছিল। আমারও ছিল। আর আমি যে জায়গায় নামি, সে জায়গাটাই এমন, এখানে যদি আমি ভালো খেলি, তাহলে ম্যাচ জেতার সুযোগটা বেড়ে যায়। এটা আমার মাথায় সব সময় কাজ করে।

প্রথম আলো:

সবাই বলছে, ৮ নম্বরে বিশ্বের ১ নম্বর ব্যাটসম্যান মেহেদী হাসান মিরাজ।

মিরাজ: কিন্তু আমি তো আরও ওপরে খেলতে চাই (হাসি)। আরও দায়িত্ব নিতে পারলে, আরও ওপরের দিকে খেলতে পারলে ভালো লাগবে। তবে দল আগে, দলের কম্বিনেশনটা আগে। তবে আমাকে নিজের উন্নতির জন্যও বড় আকারে ভাবতে হবে, নিজেকে বড় চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। আমি বিশ্বের সেরা ৮ নম্বর ব্যাটসম্যান হতে চাই না। আমি ব্যাটিং পজিশনের ওপরের দিকের বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যান হতে চাই।

প্রথম আলো:

২০২১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে চট্টগ্রামে যখন প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি করলেন, তখন বলেছিলেন, একটা সময় বাংলাদেশের ১ নম্বর অলরাউন্ডার হবেন। ওই পথে কতটুকু এগোলেন?

মিরাজ: অনেক কষ্ট করতে হবে। ধারাবাহিকভাবে রান করতে হবে। আমার যে ব্যাটিং গড়, সেটা বাড়াতে হবে। প্রতিদিন ভালো করার চেষ্টা করতে হবে। মানুষ পারে না এমন কিছু নেই। তবে এটা লম্বা প্রক্রিয়া। যদি বলি আগামী এক বছরের মধ্যেই পারব, বিষয়টা এমন নয়। কেউ তো একবারেই শীর্ষে উঠতে পারে না। চেষ্টা করে যেতে হবে, দেশকে জিতিয়ে যেতে হবে। ভাগ্য যদি থাকে, একটা সময় হয়ে যাবে আশা করি।

প্রথম আলো:

ব্যাটিংয়ে উন্নতির ক্ষেত্রে মুশফিকুর রহিমের ভূমিকাটা কতটুকু? আমরা জানি, তিনি আপনার একাধিক ব্যাটিং কোচের একজন।

মিরাজ: হ্যাঁ, তাঁর সঙ্গে ব্যাটিং নিয়ে অনেক কথা হয়। বিশেষ করে ম্যাচের কোন অবস্থায় কী করতে হবে, এসব নিয়ে অনেক আলাপ হয়। কোন বোলারকে কীভাবে খেলতে হবে, কোন লেংথের বল কখন কোন জায়গায় খেলতে হবে, আমাদের মধ্যে এ আলোচনা হয়। আর কোচদের মধ্যে আমি বাবুল স্যারের (মিজানুর রহমান) সঙ্গে অনেক কাজ করি। এবারের ক্যাম্পে অনেক কাজ করেছি তাঁর সঙ্গে। সোহেল স্যার (সোহেল ইসলাম) আমার বোলিংটা দেখেন।

প্রথম আলো:

প্রথম আলো: বোলিংয়ের প্রসঙ্গ যেহেতু এল, গত দুই বছরে আপনার দেশের বাইরের বোলিং রেকর্ডে বেশ উন্নতি হয়েছে। পরিবর্তনটা কীভাবে এল?

মিরাজ: এটা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। অনেক সমালোচনা হয়েছে। তবে সমালোচনাটা যদি ইতিবাচক হয়, তাহলে খেলোয়াড়ের জন্য ভালো। আমি বলছি না যে সমালোচনা হবে না, খেলোয়াড়ের সমালোচনা হবেই। এটাই স্বাভাবিক। আপনি একজন সাংবাদিক, আপনি দেশে যেভাবে কাজ করেন, বিদেশে গিয়ে কিন্তু সেভাবে করেন না। দেশে যেটা শিখতে আপনার দুই বছর লেগেছে, বিদেশে সেটা চার বছর লাগতে পারে। আমরাও ব্যতিক্রম নই। আমাদেরও সময় দিতে হবে, ধৈর্য ধরতে হবে। আমি যদি বলি, আপনি সাংবাদিক, দেশের মাটিতে খুব ভালো কিন্তু দেশের বাইরে একদম চলেনই না! এটা এক রকম মন্তব্য। আরেক রকম মন্তব্য, আপনি দেশে অনেক ভালো সাংবাদিক, কিন্তু দেশের বাইরে ভালো করতে পারছেন না। যদি সুযোগ ও অভিজ্ঞতা আসে, তাহলে দেশের বাইরেও ভালো করবেন। আমার ক্ষেত্রেও বিষয়টা এমনই। আমাকে নিয়েও বলা হয়েছে, আমি দেশের বাইরে ভালো করতে পারি না। কিন্তু আমাকে তো সময় দিতে হবে, খেলতে হবে। দেশের স্পিন উইকেটে প্রথম ওভার থেকে বল ধরছে। দেশের বাইরে প্রথম তিন-চার দিন বল ধরে না। আমাকে তো ওই তিন-চার দিনের বোলিং শিখতে হবে। কীভাবে ওই সময়টা আমি ম্যাচে থাকব, সেটা বুঝতে হবে। এটা পুরোটাই মানসিকতার ব্যাপার। এই পরিবর্তনটা এলে সাফল্য আসবে। কেউ কি কখনো চিন্তা করেছে, পাকিস্তানে প্রথম ইনিংসে একজন ফিঙ্গার স্পিনার ৫ উইকেট নেবে? আমি নিজেও চিন্তা করিনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই বিশ্বাসটা এসেছে। ভালো উইকেটে ব্যাটসম্যান ভুল না করলে আউট হবে না। আমি জোর করে উইকেট নিতে পারব না। আমাকে ব্যাটসম্যানের ভুল করার অপেক্ষা করতে হবে। ধৈর্য ধরতে হবে।

প্রথম আলো:

এই সিরিজে পেসারদের পারফরম্যান্স কেমন দেখলেন?

মিরাজ: ওয়াও...একদম ওয়াও। আমাদের দলে জোরে বল করার যে শক্তি আছে, সঙ্গে যে দক্ষতা, সুইং ও সিম...আল্লাহর রহমতে এখন আমাদের ১৪০-এ বল করতে পারে দু-তিনজন। ১৩৫-এর আশপাশের স্কিলফুল বোলার আছে। নাহিদ রানা তো ১৫০-এ করে। তার মানে বিশ্ব ক্রিকেটে কিন্তু আমরা একটা বার্তা দিয়েছি যে আমাদেরও পেস আক্রমণ আছে। এটা অন্য দলের জন্য চিন্তার বিষয়।

প্রথম আলো:

পরের সিরিজটাই ভারতের মাটিতে। কোনো বার্তা দিতে চান?

মিরাজ: অনেক চ্যালেঞ্জিং সিরিজ হবে। সহজ হবে না। আমরা কিন্তু একটু একটু করে উন্নতি করছি। ভাবলে ভুল হবে যে আমরা ভারত-অস্ট্রেলিয়া হয়ে গেছি। আমরা পাকিস্তানকে হারিয়েছি। এখন চ্যালেঞ্জ হবে আমরা যেন ভারতে ভালো ক্রিকেট খেলি, ধারাবাহিকতা ধরে রাখি। আমরা যদি সেখানে ভালো খেলতে পারি, ম্যাচ বা সিরিজ ড্র করতে পারি, তাহলে আমাদের ভবিষ্যতের জন্য একটা রেফারেন্স পয়েন্ট সৃষ্টি হবে। আত্মবিশ্বাসটা আসে রেফারেন্স ও রেকর্ড থেকে। যেমনটা পাকিস্তানে করতে পেরেছি।