টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের শেষটা হলো অ্যাডিলেডে। জেমি সিডন্সকে তাই আর নড়তে-চড়তে হলো না। অ্যাডিলেডের মানুষ তিনি, স্ত্রী কিম তিন সন্তানকে নিয়ে থাকেন এই শহরেই। ভারত সিরিজের আগপর্যন্ত ছুটি কাটাতে সিডন্সও থেকে গেছেন তাঁর চোখে অস্ট্রেলিয়ার ‘বেস্ট সিটি’তে। গতকাল দুপুরে শহরের গ্লেনেল সৈকতের পারে বসে কথা হলো বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং কোচের সঙ্গে। সিডন্স জানিয়েছেন বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত মত, কথা বলেছেন বিশ্বকাপের ঠিক আগে দল নিয়ে করা বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রসঙ্গেও—
আপনার দুই দলই তো বিশ্বকাপের বাইরে চলে গেল। বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া কোনো দলই সেমিফাইনালে উঠতে পারেনি। নিশ্চয়ই একটু হতাশ...
জেমি সিডন্স: অবশ্যই। অস্ট্রেলিয়ার জন্য এবং আমাদের (বাংলাদেশ) জন্যও একটু বিস্ময়কর। ভারতকে হারাতে পারলে কিন্তু আমরাও সেমিফাইনালে খেলার দাবি জানাতে পারতাম। পাকিস্তানের বিপক্ষেও সুযোগ এসেছিল এবং আমরা খুব রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছিলাম। তবে হয়তো একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল সেটা...সে জন্যই জিততে পারিনি।
অস্ট্রেলিয়ারও বিশ্বকাপ শেষ হয়েছে হতাশাজনকভাবে। ওরা বাদ পড়ে যাওয়ার পর পত্রিকায় কিছু লেখা পড়ছি, দলের মধ্যে একতা নেই...এ রকম। এটা আরও হতাশার। জানি না এগুলো সত্যি কি না।
বাংলাদেশ যেভাবে বিশ্বকাপ শেষ করল, তাতে আপনি কতটা সন্তুষ্ট?
সিডন্স: সন্তুষ্ট নই। তবে আমি বোলিং নিয়ে খুশি। আমরা দেখালাম আমাদের ম্যাচ জেতানোর মতো একটা বোলিং আক্রমণ আছে। যেটার অভাব রয়ে গেছে, সেটা ব্যাটিংয়ে। আমরা যেভাবে ভেঙে পড়েছি, তা ভালো লাগেনি। আমি মনে করি না এটা টেকনিক বা দক্ষতার অভাবে হয়েছে।
এটা হয়েছে শুধু চাপের কারণে। ম্যাচ জেতার চাপ। আমার মনে হয় এই সমস্যা শুধু কোচিং করিয়ে দূর করা যাবে না। খেলোয়াড়দের মানসিকতার প্রয়োগও প্রয়োজন। যখন আমাদের চার হলেও চলে, তখন ওরা ছয় মারতে গেছে, ছোট ছোট সব ভুল।
আমরা যত বেশি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলব, ততই আসলে এসব শিখব এবং টি-টোয়েন্টির জন্য সঠিক খেলোয়াড় খুঁজে পাব। যারা আছে তাদের দিয়েই হবে নাকি নতুন খেলোয়াড় খুঁজে বের করতে হবে...এটা জানাই এখন চ্যালেঞ্জ।
সবাই বলছে, এটাই বাংলাদেশের সেরা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। কারণ, সুপার টুয়েলভে এবারই প্রথম একের বেশি ম্যাচ জিতেছে বাংলাদেশ। আপনার কাছেও কি তাই মনে হচ্ছে?
সিডন্স: আমি মনে করি, দুই ম্যাচ জয় কেবলই একটা সংখ্যা। এই দুটি দলের বিপক্ষে আমাদের জেতারই কথা ছিল। আমরা সেই প্রত্যাশা পূরণ করেছি। তবে ওদের বিপক্ষে হারলে সেটা বেশি খারাপ হতো।
প্রশ্ন :
বিশ্বকাপের আগে তো আপনারা ব্যাটিং নিয়ে অনেক কিছু করলেন, বিশেষ করে ওপেনিং জুটি নিয়ে। ব্যাটিংটা তাহলে এমন হলো কেন?
সিডন্স: এটা ঠিক...আমরা হয়তো একটু বেশিই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ফেলেছি। আমার মতে, আমাদের হয়তো একটা জায়গায় থামা উচিত ছিল। কিছু খেলোয়াড়ের ওপর আস্থা রেখে তাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যথাযথ অনুশীলনের সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল। তবে এটাও ঠিক, সঠিক জায়গার জন্য সঠিক খেলোয়াড় খুঁজে বের করতেই আমাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো করতে হয়েছে।
এশিয়া কাপ এবং ত্রিদেশীয় সিরিজের আগে দলে অনেক খেলোয়াড় এসেছে। কেউ চোটের কারণে থাকতে পারেনি, কেউ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কিছু সময়ের জন্য ছিল না, কেউ মাত্র আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরেছে, কারও জন্য এটাই ছিল প্রথম বিশ্বকাপ...যেটা এমনিতেই একটা চাপ।
আমার মনে হয় বিশ্বকাপের আরও আগে আমাদের হয়তো আরও স্থির থাকা উচিত ছিল। এই একটা ভুল আমরা করেছি।
প্রশ্ন :
আপনি তাহলে বলছেন বিশ্বকাপের ঠিক আগে এত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার দরকার ছিল না...
সিডন্স: আমি তাই মনে করি। দলটাকে বিশ্বকাপের যথেষ্ট আগে থিতু হতে না দেওয়া একটা ভুল ছিল। তবে আমরা সেরা একাদশ খুঁজে বের করতেই এটা করেছি।
প্রশ্ন :
আপনি নিজেও তো কোচিং দলের অংশ। আপনার কী মতামত ছিল তখন?
সিডন্স: দেখুন, আমি দল নির্বাচনের অংশ নই। দল নির্বাচনে স্বাভাবিকভাবেই আমার কথা বলার সুযোগ নেই। এই জায়গাটায় মনে হয় কিছু পরিবর্তন দরকার। আমি যেহেতু ব্যাটিংয়ের দায়িত্বে, কে কোন জায়গার জন্য ভালো ব্যাটসম্যান হবে, আমি সে মতামতটা জানাতে চাই। আমার নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে কিছু বলার থাকবে।
প্রশ্ন :
বিশ্বকাপের ঠিক আগে বিসিবি টি-টোয়েন্টি দলের কোচিংয়ের শীর্ষ পর্যায়েও বদল আনল। পুরো পরিকল্পনাই বদলে গেল। আপনার কি মনে হয় এটা আদর্শ ছিল?
সিডন্স: আমার জায়গা থেকে আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, যেটা হয়েছে বা যেভাবে হয়েছে, সেটা খুব ‘ইন্টারেস্টিং’। কেউ নিশ্চয়ই ভেবেছে এটা করলে ভালো হবে বা এটা করা দরকার, সে জন্যই হয়েছে। এ নিয়ে আমার কিছু বলা ঠিক হবে না। শেষ সময়ে দলেও কিছু অদলবদল হয়েছে। সেটাও ‘ইন্টারেস্টিং’।
এটা বোর্ডের সিদ্ধান্ত হোক বা যাই হোক, যেটা হয়েছে সেটা তো হয়েছেই। আমরা চেষ্টা করেছি আমাদের কাজটা ঠিকভাবে করতে এবং খেলোয়াড়েরাও ভালো কিছুর জন্যই চেষ্টা করেছে।
প্রশ্ন :
ব্যাটসম্যানদের ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স নিয়ে কী বলবেন?
সিডন্স: আগেই বলেছি ব্যাটিংয়ে আমাদের জন্য হতাশার বিশ্বকাপ গেছে। আফিফ, নুরুল, ইয়াসির, মোসাদ্দেক—কারোরই বিশ্বকাপটা ভালো যায়নি। ইয়াসির মাত্র চোট থেকে ফিরলেও সম্ভবত পুরো ছন্দে আসতে পারেনি। এর আগে খুব বেশি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিও সে খেলেনি।
সৌম্য সরকার দলে ফিরেছে অনেক দিন অনিয়মিত থাকার পর। এভাবে বিশ্বকাপে এসে ভালো করাটা আসলেই কঠিন, বিশেষ করে পাওয়ার প্লের পরের ব্যাটিংটা বেশি কঠিন।
প্রশ্ন :
ব্যাটিংয়ে সাকিবের ফর্মে না থাকা কতটা প্রভাব ফেলেছে?
সিডন্স: সাকিবের রান না করা অবশ্যই প্রভাব ফেলে। তিন-চার নম্বরে ব্যাট করে সে। এবার আসলেই ও কিছু করতে পারেনি। এটা দল এবং তার জন্যও হতাশার।
প্রশ্ন :
ভারতের বিপক্ষে বৃষ্টি এবং পাকিস্তানের বিপক্ষে সাকিবের আউট—এই দুই ম্যাচের ফলাফলে এসবের কতটা প্রভাব দেখেন?
সিডন্স: ভারত ম্যাচের কথা বলি, বৃষ্টির আগে এবং পরেও যে পরিস্থিতি ছিল, আমাদেরই সেদিন জেতা উচিত ছিল। লিটনের রানআউটটা আমাদের জন্য খুব বাজে হয়েছে। সে–ই পারত ম্যাচ বের করে নিতে। পাকিস্তানের বিপক্ষে সাকিবের আউটটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত।
টেলিভিশন রিপ্লে দেখে মাঠে সেদিন সবাই বলেছে কোনোভাবেই ওটা আউট ছিল না। কোনো কারণে তারপরও তাকে আউট দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের দলকে সেটাই পেছনে ঠেলে দিয়েছে। এরপর আমরা আর সংগঠিত হতে পারিনি। তরুণ খেলোয়াড়েরা এসে চাপ নিয়ে নেয়।
প্রশ্ন :
সামনে ভারতের বিপক্ষে হোম সিরিজ। যদিও ভিন্ন সংস্করণের খেলা, তারপরও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের হতাশা তাতে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে?
সিডন্স: আমরা ওয়ানডে ক্রিকেটে ফিরব, যেখানে আমাদের দল খুবই ভালো খেলছে এবং সিরিজ জিতছে। তবে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আমরা তেমন ভালো খেলিনি। আমাদের পুরো দলও ছিল না। সাকিব ছিল না, মুশফিকও ছিল না। তারা ফিরে এলে নিশ্চয়ই দলটা আরও ভালো হবে।
ভারতের বিপক্ষে অতীতে আমরা কিছু ভালো ম্যাচ খেলেছি। বিশ্বকাপের পর ছেলেরা নিশ্চয়ই নতুন করে ভাববে এবং ৫০ ওভারের ক্রিকেটে জন্য প্রস্তুত হবে।