সাক্ষাৎকারে রোমান সানা

'দেশকে তো শুধু দিয়েই গেলাম, দেশ তো কিছু দিল না'

বিশ্বকাপ ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে পদক জিতেছেন। আন্তর্জাতিক আর্চারিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন হয়ে ওঠেন সেই সুবাদে। কিন্তু বাংলাদেশের হয়ে আর না খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রোমান সানা। আন্তর্জাতিক আর্চারি থেকে অবসরের সিদ্ধান্ত জানিয়ে বাংলাদেশ আর্চারি ফেডারেশনকে চিঠিও দিয়েছেন। কিন্তু ২৮ বছর বয়সেই কেন এই সিদ্ধান্ত? প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে রোমানের হতাশা, মান–অভিমান, ক্ষোভ মিলেমিশে একাকার।
প্রথম আলো:

হঠাৎ করে জাতীয় দল থেকে অবসর নিয়ে নিলেন। এত বড় একটা সিদ্ধান্ত কেন নিলেন?

রোমান সানা: একটু চোটের সমস্যা আছে। তবে এখন আর আসলে খেলতে ইচ্ছা করে না, ভালো লাগে না। বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত সর্বোচ্চ রেজাল্টধারী অ্যাথলেট হচ্ছি আমি। অথচ না পেলাম কোনো জায়গা থেকে ভালো একটা অফার, না পেলাম কোনো কিছু। সরকার থেকেও আজ পর্যন্ত কোনো কিছু করেনি। এই জিনিসগুলো দিনে দিনে অনেক বড় আকার ধারণ করেছে। এ জন্য অভিমান করে...আসলে আর ভালো লাগে না।

প্রথম আলো:

তাহলে আপনি বলতে চাইছেন খেলার প্রতি একটা বিরক্তি চলে এসেছে?

রোমান: বিরক্তি বলতে আসলে দেখেন; ক্রিকেট, ফুটবলের মতো আমাদের সুযোগ–সুবিধা তেমন নেই বলতে গেলে। কিন্তু সাফল্যের কথা যদি বলেন, প্রচুর সাফল্য বাংলাদেশকে এনে দিয়েছি। সে তুলনায় আমাদের ফ্যাসিলিটিজ অনেক কম। প্রতি মাসে আমাদের ১ হাজার ৫০০ টাকা করে দেওয়া হতো। সেটা বলেকয়ে গত বছর থেকে ৩ হাজার টাকা করা হয়েছে।

প্রথম আলো:

এটা কি আর্চারদের প্রতি মাসে বাংলাদেশ আর্চারি ফেডারেশন দেয়?

রোমান: হ্যাঁ, ফেডারেশন দেয়, স্পনসরদের টাকা থেকে। আর আমরা যারা বিবাহিত আছি, যদি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকি, তাদের জন্য ২ হাজার টাকা অতিরিক্ত। অথচ বাসা ভাড়াই ১০-১৫ হাজার টাকা লাগে।

রোমান সানাই অলিম্পিকে সরাসরি কোয়ালিফাই করা প্রথম বাংলাদেশি আর্চার
শামসুল হক
প্রথম আলো:

তাহলে আপনি চলেন কীভাবে?

রোমান: সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। বিদেশে খেলতে গেলে প্রতিদিন ১০ ডলার বা ১৫ ডলার করে দেওয়া হয়। তাতে হয়তো একটা সফরে ১০০ ডলার হয়। এ দিয়ে তো আসলে চলা মুশকিল হয়ে যায়।

প্রথম আলো:

আপনি বাংলাদেশ আনসারের সৈনিক পদে আছেন। আনসার থেকে কত পান?

রোমান: ২৫ হাজার টাকা।

আর্চারির মঞ্চে রোমান ও দিয়া। সম্পর্কে দুজন স্বামী–স্ত্রী
ফাইল ছবি
প্রথম আলো:

তাহলে আপনার মাসিক আয় সব মিলিয়ে মাত্র ৩০ হাজার টাকা?

রোমান: জি। তা ছাড়া অসুস্থ মা আছেন খুলনায়। তাঁর ওষুধ, হাতখরচ আছে। মনে করেন ৮-১০ হাজার টাকা যায় তাঁর জন্য। এখন চাকরি–বাকরি ঢাকায় হওয়ায় ঢাকাতেই থাকতে হবে আমাকে। চাইলেই সব ছেড়ে খুলনার বাড়ি চলে যেতে পারব না। বিয়ে করেছি, সংসার হয়েছে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আছে। সুযোগ–সুবিধা যদি না থাকে, তাহলে কীভাবে হবে? আমরা তো উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যই খেলি। অথচ আমাদের একটা প্লেয়ারের চাকরির জন্য বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়, হাত–পা ধরতে হয়।

প্রথম আলো:

কোন খেলোয়াড়ের চাকরির কথা বলছেন?

রোমান: যেমন ধরুন, আমাদের আর্চার এস কে মামুন ভাই, অসীম কুমার...তাঁদের বয়স ৩০–এর বেশি হয়ে গেছে। কিন্তু একটা সরকারি চাকরি কোথাও হয়নি। তাঁরা ভালো খেলোয়াড় ছিলেন, আন্তর্জাতিক পদক জিতেছেন। খেলোয়াড়দের চাকরির বিষয়টা সরকার থেকে বিবেচনা করা উচিত। ক্রিকেটার–ফুটবলাররা তো এক–দুবছর খেললে প্রচুর টাকার মালিক হয়ে যায়।  

প্রথম আলো:

কিন্তু আপনার পারফরম্যান্সও কি একটা ব্যাপার নয়? এখন দলেই আসতে পারছেন না। গত মাসে বাগদাদে এশিয়া কাপের দলে জায়গা পাননি, এ কারণেই কি আপনার মধ্যে হতাশা চলে এসেছে?

রোমান: ওটা জাস্ট অজুহাত (পারফরম্যান্স)। আমার পারফরম্যান্স সব জায়গাতেই ভালো। ফেব্রুয়ারিতে স্কোর করেছি ৩৩৯–৩৪০। কোচের প্যাডে লেখা আছে। এখনো আমিই এক নম্বর। হ্যাঁ, আন্তর্জাতিক খেলায় ভালো করতে পারিনি, থাইল্যান্ডে যেটা হয়েছে। ওখানে আবহাওয়া অনেক খারাপ ছিল। ওখানে অন্যরাও তো আহামরি কিছু করতে পারেনি। কেউ গোল্ড–সিলভার পেয়েছে, আমি রেজাল্ট করতে পারিনি, তাহলে একটা কথা ছিল। এই যে বাগদাদে খেলে এসেছে, কেউ তো ব্যক্তিগত পদক পায়নি।

বৈশ্বিক আর্চারিতে বাংলাদেশের হয়ে রোমান সানা ২০১৯ সালের বিশ্ব আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন
ফেসবুক
প্রথম আলো:

কিন্তু অজুহাত দেখিয়ে আপনাকে বাদ দেওয়া হবে কেন?

রোমান: আসলে টানা খেলার চাপ, নিজের মানসিক চাপ, অনেক সমস্যা আছে। এ কারণে চিন্তাভাবনা করেছি যে এর থেকে একটু দূরে থাকি। নিজেকে সময় দিই।

প্রথম আলো:

শোনা যাচ্ছে, আপনি ব্যবসা করতে চান? কী ব্যবসা?

রোমান: ব্যবসা...ওটা বলার দরকার বলেছি (হাসি)।

প্রথম আলো:

এ–ও শোনা যাচ্ছে, খুলনায় আপনি মাছের ঘের করবেন?

রোমান: এটা আমার বাপ–দাদারা করে এসেছে। তাই একটা ইচ্ছা তো আছেই। সবাই জানে, দক্ষিণাঞ্চলে মাছের ঘের করে অনেকে। বাবা তো চাকরি করেন না এখন, টুকটাক এগুলো করেন। এগুলো বড় আকারে করা গেলে ভালো। এখন আমাকে কিছু না কিছু তো করতেই হবে, ব্যস্ত থাকতে হবে।

প্রথম আলো:

এমনিতে ঘরোয়া আর্চারিতে তো খেলে যাবেন?

রোমান: ঘরোয়া খেলায় তো অবশ্যই খেলব।

রোমান সানার আর্চার–জীবন এখন অনিশ্চয়তায়
ফাইল ছবি: ওয়ার্ল্ড আর্চারি
প্রথম আলো:

কোচ মার্টিন ফ্রেডরিখ বলেছেন, আপনার জন্য দরজা খোলা। ফেডারেশন কি কিছু বলেছে?

রোমান: ফেডারেশনের ট্রেনিং কমিটির আহ্বায়ক ফারুক ঢালি স্যারকে প্রথমে যখন চিঠি দিতে যাই, তিনি বলেন, ‘এখন এটা করো না। ধৈর্য ধরে থাকো।’ তিনি বলেন, ‘তোমাদের বেতন বাড়ানো নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে, ক্যাটাগরি করবে।’ কিন্তু অপেক্ষা করতে করতে তো জীবন শেষ! এভাবে তো জীবন চলে না। স্যারদের সবকিছু আমি খুলে বলেছি।

প্রথম আলো:

১৪ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে সেরা অর্জন কোনটাকে বলবেন?

রোমান: বাংলাদেশের প্রথম আর্চার হিসেবে অলিম্পিকে কোয়ালিফাই করা। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে কোয়ালিফাই করি। এরপর ব্রোঞ্জ জিতি। বাংলাদেশের প্রথম আর্চার হিসেবে প্রথম পদক জিতি। ওটা ছিল ইতিহাস। দিয়াকে নিয়ে বিশ্বকাপ আর্চারিতে রুপা জিতি। আমার জীবনে প্রতিটাই বড় অর্জন। কোনো ছোটখাটো অর্জন আমার নেই। সব ওয়ার্ল্ড র‍্যাঙ্কিং টুর্নামেন্টে বড় অর্জন। আন্তর্জাতিক পদক হবে ২০টির কাছাকাছি। গোল্ড ১০টার মতো। সঠিক বলতে পারব না। তবে বেশিই হবে, কম না। গোল্ড ছাড়া সিলভার, ব্রোঞ্জও আছে। আমাদের দেশে গোল্ডই কাউন্ট করা হয়, সিলভার -ব্রোঞ্জের কোনো মূল্যায়নই নেই।  

প্রথম আলো:

কিন্তু আইকন খেলোয়াড় হিসেবে আপনার কি মনে হয় না বাংলাদেশকে আরও কিছু দিতে পারতেন?

রোমান: এখনো অনেক দিন আর্চারি করতে পারব। কিন্তু দেশকে তো শুধু দিয়েই গেলাম, দেশ তো কিছু দিল না। আমারও তো কিছু চাহিদা থাকতে পারে। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য চাকরি হোক, ব্যবসা হোক, মানুষের একটা লক্ষ্য থাকে। সে জানে এটা পাব, ওটা পাব। আমার একটা ব্যক্তিগত স্পনসর এসেছিল, তখনই আমি সাসপেন্ড হলাম।

প্রথম আলো:

কোন স্পনসর ছিল এটা?

রোমান: জাপানের একটা প্রতিষ্ঠান। ২০২২ সালের ২২ নভেম্বর তাদের সঙ্গে সাইনিং ছিল, কিন্তু ১৫ ফেব্রুয়ারি আমি সাসপেন্ড হই। এটা কোচ মার্টিনও জানে। ও আর আমি এক বছর দৌড়িয়েছি এই স্পনসরের পেছনে। ওরা আমাকে স্পনসর করতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু সেই স্পনসর চলে গেছে।

বিশ্ব আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে বাংলাদেশকে প্রথম পদক এনে দিয়েছিলেন রোমান সানা
সংগৃহীত
প্রথম আলো:

কিন্তু এটা তো আপনার দোষেই হয়েছে। ক্যাম্পে সতীর্থ এক আর্চারের সঙ্গে খারাপ আচরণ করার কারণেই সাসপেন্ড হয়েছিলেন। এখন কি মনে হয়, ওটা ভুল ছিল?

রোমান: হ্যাঁ, অবশ্যই ভুল ছিল।

প্রথম আলো:

নিজের ভুলের কারণেই কি আজ এই পরিণতি হলো আপনার, নাকি অন্যদেরও ভুল আছে?

রোমান: যা–ই হয়েছে, সব আমারই ভুল। আর কারোরই ভুল নেই। কারণ, আমি ভুল না করলে সুযোগটা পেত না। তো যত যা–ই করছি, সব আমারই ভুল (দীর্ঘশ্বাস)। কারোরই হাত ছিল না। এটা নিয়ে দুঃখ নেই, কষ্ট নেই।

প্রথম আলো:

দাঁড়ান, দাঁড়ান। আর একটা প্রশ্ন। আন্তর্জাতিক আর্চারি ছাড়ার সিদ্ধান্তটা কি অনেক ভেবে নিলেন নাকি আচমকা। বাগদাদ সফরে দলে সুযোগ না পেয়ে?

রোমান: হঠাৎ করে। ঠিক আছে? আল্লাহ হাফেজ।