আগের সাগর ইসলাম আর অলিম্পিকে সরাসরি সুযোগ পাওয়া সাগর ইসলামের মধ্যে কী পার্থক্য? গত এক মাসে সবকিছু কি একটু বদলে গেছে?
সাগর ইসলাম: আমার কাছে তো পার্থক্য কিছু মনে হচ্ছে না। তবে হ্যাঁ, অলিম্পিকে সুযোগ পাওয়ার রোমাঞ্চকর অনুভূতিটা তো আছেই। গত মাসে অলিম্পিকে কোয়ালিফাই করার পর কোচ মার্টিন ফ্রেডরিখ স্যার আমার অনুশীলনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছেন। সেটাই স্বাভাবিক। অলিম্পিকে যাব, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। প্রস্তুতিও তেমনই হতে হবে।
বাড়তি কী ধরনের অনুশীলন করছেন?
সাগর: অনুশীলনের পরিমাণ বেড়েছে, বাড়তি কিছু করছি না। তবে আগে রিকার্ভ ইভেন্টে দলগত অনুশীলন করাতেন কোচ, অলিম্পিকে যেহেতু আমি একা, তাই আলাদা করে অনুশীলন চলছে। তিনি আমাকে নিয়েই আছেন। এতে আমার জন্য খুব ভালো হয়েছে, আমি কোচের বাড়তি মনোযোগ পাচ্ছি। তবে একটা বিষয়ে সতর্ক আছি, অলিম্পিকে যাওয়ার আগে আমার মনোযোগের যেন কোনো ব্যাঘাত না ঘটে।
মনোযোগ ধরে রাখার কাজটা কীভাবে করেন? টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়ামে এ মুহূর্তে নির্মাণকাজ চলছে, স্টেডিয়ামের বাইরে ট্রাক–বাসের হর্নের শব্দ...
সাগর: এতে বরং ভালো হয়েছে। কিছুটা কঠিন পরিবেশে আমার অনুশীলন চলছে। এর মধ্যেও যদি আমি মনোযোগ দিয়ে অনুশীলন করতে পারি, তাতে আমারই লাভ। আর্চারি ফেডারেশন ও কোচ আমার জন্য রুটিন তৈরি করে দিয়েছেন। সেটা অনুসরণ করে যাচ্ছি। এই কয়টা দিন দৈনন্দিন জীবন থেকে কিছু জিনিস বাদ দিয়েছি।
গত মাসে তুরস্কের আনাতোলিয়ায় ওয়ার্ল্ড কোটা টুর্নামেন্টে খেলতে যাওয়ার আগে কি মনে হয়েছিল অলিম্পিকে সরাসরি সুযোগ পাবেন?
সাগর: সত্যি বলতে কি, আমাদের প্রত্যাশা ছিল। রোমান সানা ভাই এর আগের অলিম্পিকে কোয়ালিফাই করেছিলেন। আমরা এবার আমাদের দলটাকে নিয়ে অনেক বেশি আশাবাদী ছিলাম। প্রথমে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি, সেটি হতেই পারে, খেলায় তো হার–জিত থাকবেই। তবে দ্বিতীয় দিন আমি রিকার্ভের ব্যক্তিগত ইভেন্টে আমি সেমিফাইনালে উঠে অলিম্পিক কোয়ালিফাই করি। ফেডারেশনের সার্বিক সমর্থন ও মার্টিন স্যারের পরিশ্রম এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
অলিম্পিকে বিভিন্ন ইভেন্টে ৬২ জন আর্চার অংশ নিচ্ছেন। আপনি তাঁদের একজন, যিনি নিজের পারফরম্যান্স দিয়েই সেখানে যাচ্ছেন। এটা নিশ্চয়ই আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়াচ্ছে...
সাগর: এসব মাথায় রাখছি না। আমি শুধু আমার কাজটা করে যেতে চাই। তুরস্কে সেমিফাইনালে উঠেছিলাম ৬৬০ স্কোর করে। এই স্কোর ধরে রেখে এগোতে চাই। দেশে অনুশীলনে স্কোর কখনো বেশি হচ্ছে, কখনোবা কম। মার্টিন স্যার বলেছেন, অলিম্পিকে স্কোর কোনোমতেই ৬৬০–এর নিচে নামতে পারবে না। প্যারিস যাওয়ার আগে যে কয়েক দিন অনুশীলন সেশন হবে, আমি চাই স্কোরটা ৬৬০–এর বেশি করতে। সেটি টানা করে যেতে পারলে আত্মবিশ্বাস নিয়ে লড়াই করতে পারব।
আপনার আর্চার হয়ে ওঠার কথা বলুন...
সাগর: আর্চারি যে খুব বেশি দিন খেলছি, ব্যাপারটা তা নয়। ২০১৭ সালে রাজশাহীর এসবি আর্চারি ক্লাবে ভর্তি হয়েছিলাম। ২০১৯ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি হই। এরপর জাতীয় দলে চলে আসি। জাতীয় দলে ঢোকার পরের সময়টায় কোভিডের সময় ছিল। অনুশীলন কিছুটা সীমিত পরিসরেই হয়েছে। তারপরও আমি ইসলামিক সলিডারিটি গেমসে দলগত ইভেন্টে ব্রোঞ্জ জিতি। আমার টিমমেট ছিলেন রোমান সানা ভাই ও হাকিম আহমেদ রুবেল ভাই। এরপর সিঙ্গাপুরে এশিয়া কাপ স্টেজ–২ ও স্টেজ–৩–এ আবার দলগত ব্রোঞ্জ, এ বছর ইরাকে স্টেজ–১–এ দলগত রুপা জিতেছি।
আপনার বড় হওয়াটাও তো সংগ্রাম করে...
সাগর: সংগ্রাম আমি করিনি, করেছেন আমার মা। ২০০৯ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবার বেশ কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যায়। মা একটা ছোটখাটো চা–বিস্কুটের দোকান দিয়ে পরিবার চালিয়েছেন। সেই উপার্জন দিয়ে পড়াশোনা করেছি। আমি যখন আর্চারিতে আগ্রহী হলাম, তখন মায়ের দারুণ উৎসাহ পেয়েছি। আসলে তিনিই আমার সব, মা না থাকলে এই জায়গায় আসতে পারতাম না।
অলিম্পিকে যাবেন, মা এখন কী বলছেন?
সাগর: তিনি খুব সিরিয়াস। উনি তো এসব বেশি বোঝেন না। তবে আমাকে বলেছেন, তোমাকে মেডেল নিয়ে আসতে হবে। আমি বলেছি, মা, অলিম্পিক গেমস অনেক বড় ব্যাপার। সেখানে মেডেল জেতা খুব কঠিন। তাঁর কথা, চেষ্টা করে যাও। চেষ্টায় কত কিছুই তো হয়। তিনি অলিম্পিক নিয়ে এমনভাবে আমার সঙ্গে কথা বলেন, যেন মনে হয় আমি বড় কোনো পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি। এমনও বলেছেন, ‘এই কয়টা দিন একটু কষ্ট করো বাবা, অলিম্পিক শেষ হলে আবার আরাম করো।’ (হাসি)।
প্যারিসে লক্ষ্যটা কী থাকবে আপনার?
সাগর: ওই যে চেষ্টা করে যাব। এত দিন যা করেছি, তার চেয়ে বেশি কিছু করা, ভালো কিছু করা।