অনেক ছবি তুলতে হলো দেখলাম আপনাকে। এ রকম পরিস্থিতিতে মনে হয় নিয়মিতই পড়তে হয়…
মোহাম্মদ রিজওয়ান: সত্যি বলতে কি, বাংলাদেশে এলে আমার মনেই হয় না ভিন্ন কোনো দেশে আছি। এখানে যে ভালোবাসা পাচ্ছি, সেটা পাকিস্তানের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। শুধু আমি নই, বাবর আজম, নেওয়াজরাও বলেছে, এখানে অনেক ভালোবাসা পাচ্ছে মানুষের। তবে আমি মনে করি, আমাদের মধ্যে শহীদ আফ্রিদিই এখানে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়।
আর বিপিএলে খেলা, সেটা কেমন উপভোগ করছেন? এ নিয়ে দ্বিতীয়বার খেলছেন টুর্নামেন্টটাতে…
রিজওয়ান: আগেও বলেছি, বিপিএল আমি খুবই উপভোগ করছি। গতবারও আমি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসে ছিলাম। এই দলটা অন্য রকম। মালিকপক্ষ ও কোচ সালাউদ্দিন স্যারের সঙ্গে কথা বলেও সেটাই মনে হয়েছে। তাঁরা বলেছেন, কুমিল্লা চ্যাম্পিয়ন দল এবং চ্যাম্পিয়নই হতে চায়। একই সঙ্গে তাঁরা চান বাংলাদেশের জন্য নতুন নতুন খেলোয়াড় তৈরি করতে, যারা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পারফর্ম করবে।
এ ধরনের টুর্নামেন্টে ভালো বিদেশি খেলোয়াড়ের উপস্থিতি স্থানীয় ক্রিকেটারদের কীভাবে উপকৃত করে?
রিজওয়ান: বড় খেলোয়াড়েরা খেলতে এলে তাদের কাছ থেকে অবশ্যই অনেক কিছু শেখার থাকে। নিজের কথাই বলি, এটা কীভাবে আমার উপকারে এসেছিল। খেলোয়াড়ি জীবনে নেওয়া প্রথম সিদ্ধান্তটা আমার জন্য ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঘরোয়া ক্রিকেটে একটা দল আমাকে ১ লাখ ২৫ হাজার রুপি প্রস্তাব করলেও আমি গিয়েছিলাম ২৫ হাজার রুপি প্রস্তাব করা সুই গ্যাস দলে। কারণ, ওই দলে খেললে আমি হাফিজ ভাই, মিসবাহ–উল–হক, উমর আকমল, আদনান আকমলদের সঙ্গে খেলতে পারব। খেলার সুযোগ যদি না–ও পাই, ওখানে অনেক কিছু শিখতে পারব এবং আমি শিখেছিও। বড় খেলোয়াড়দের সঙ্গে খেলতে পারলে তরুণদের অনেক কিছু শেখার সুযোগ হয়, যদি তাদের শেখার আগ্রহ থাকে।
বাংলাদেশের তরুণ খেলোয়াড়দের কেমন দেখছেন?
রিজওয়ান: কুমিল্লার জাকেরকে আমার কাছে একটু অন্য রকমই মনে হয়েছে। অন্যভাবে চিন্তা করে। কোচ যদি বলেন ২০ বলে ২০ রান কর, সেটাই করে। আবার যদি বলে ৮ বলে ২০ রান কর, জাকের তা–ও করার চেষ্টা করে। এর মানে সে টিম ম্যান, দলের জন্য খেলে। দল যখন যেটা চায়, ও সেটা করার চেষ্টা করে। ব্যাটিংয়ের সময়ও সব সময় ড্রেসিংরুমের বার্তা অনুযায়ী খেলার চেষ্টা করে। এটা সবাই সব সময় করতে পারে না। এটা বলছি না যে শান্ত বা তাওহিদ বা অন্য খেলোয়াড়দের আমি এটা করতে দেখিনি। তারাও প্রতিভাবান। যেমন ধরুন আমাদের দলের অঙ্কন (মাহিদুল ইসলাম), টেকনিক্যালি খুবই ভালো। বোলার আলিস ব্যতিক্রম। তানভীরও দু–তিন বছর ধরে ভালো করছে।
আপনার কথা বলুন, টি–টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের শুরুতে আপনাকে নিচের দিকেই খেলতে হয়েছিল বেশি। কতটা হতাশাজনক ছিল সেটা?
রিজওয়ান: এটা ঠিক যে একটা সময়ে হতাশা এসেছিল। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একজন ব্যাটসম্যানের মধ্যে দুইভাবে হতাশা আসতে পারে। এক হলো ভালো না খেলতে পারলে; দুই, ব্যাটিং অর্ডারে নিজের জায়গা ঠিক না থাকলে। ব্যাটিং অর্ডারের কথা যদি বলেন, টপ অর্ডার ভালো রান করায় যদি আপনার সুযোগ না আসে, তখন আপনাকেই বুঝে নিতে হবে যে আপনার জন্য আসলে ওই মুহূর্তে ওপরে জায়গা নেই।
পাকিস্তানে এমন অনেক খেলোয়াড় আছে, ভালো ব্যাটিং টেকনিক থাকা সত্ত্বেও যারা পাকিস্তানের হয়ে খেলতে পারছে না; কারণ, ৫–৬ নম্বর পর্যন্ত সবাই থিতু। আসলে এটা নিয়ে অভিযোগ করার বা এটাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানোর কোনো সুযোগ নেই। কারণ, আল্লাহ নির্দিষ্ট সময়েই আপনাকে আপনার প্রাপ্যটা দেবেন। জীবনে কঠিন সময় আসে। যত ওপরে উঠবেন, সমস্যাগুলো তত বড় হয়ে দেখা দেবে। আপনি যদি সেগুলো কাটিয়ে উঠতে পারেন, তাহলে আরও ওপরে উঠবেন। খেলোয়াড়দেরও সেই পরীক্ষাই দিয়ে যেতে হয়। যার মধ্যে যত বেশি যোগ্যতা, সে তত দূরে যায়।
২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চলাকালে কয় দিন হাসপাতালে কাটিয়েও আবার খেলায় ফিরেছিলেন। আপনার মানসিক দৃঢ়তাটা তখনই বোঝা গিয়েছিল। এখন আপনার কথা শুনে সেটি আরও পরিষ্কার হচ্ছে…
রিজওয়ান: কঠিন সময়ে আসলে এভাবেই চিন্তা করতে হয়। এই দুনিয়ায় সবাইকেই কঠিন সময় পার করতে হয়। আমাদের কোচ সালাউদ্দিন স্যারের কথাই ধরুন। তিনি যার কাছে যান, তাকে নির্ভার করে দেন। সুখ–দুঃখ জীবনের অংশ, তবে এর কোনোটাই সারা জীবন ধরে থাকে না। একজন মানুষ যে রকম সারা জীবন সুখী থাকতে পারে না, সে রকম অসুখীও থাকতে পারে না। কেউ যদি এভাবে ভাবে যে এই সব কিছুই সৃষ্টিকর্তার হাতে, তার কাঁধ থেকে সব চাপ নেমে যাবে। সে কোনো কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তা করবে না।
বিপিএলের শুরুতে এবার রান পাচ্ছিলেন না কুমিল্লার অধিনায়ক লিটন দাস। আপনার চোখে তাঁর কী সমস্যা ধরা পড়েছে?
রিজওয়ান: লিটনকে দুই বছর ধরেই আমি কাছ থেকে দেখছি, বাংলাদেশ দলেও খেলতে দেখেছি। ভালো খেলোয়াড়, টেকনিক ভালো। সে জানে তাকে কী করতে হবে। সবার জীবনেই বাজে সময় আসে, আপনাদের জীবনেও নিশ্চয়ই আসে, পরীক্ষা দিতে হয়। কিন্তু আমাদের সে পরীক্ষাটা দিতে হয় সবার সামনে। আপনাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সে রকম নয়। লিটন দাসেরও নিশ্চয় সে রকমই কোনো পরীক্ষা নিচ্ছেন সৃষ্টিকর্তা। তবে আমার মনে হয়, মানসিকভাবে সে–ও খুব শক্ত। সেটা হলে খারাপ সময় থেকে সে খুব ভালোভাবেই ফিরবে।
বিপিএলের পর শুরু হয়েও ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট হিসেবে পিএসএল এখন অনেক এগিয়ে গেছে। এটা কীভাবে সম্ভব হলো?
রিজওয়ান: আলহামদুলিল্লাহ, পিএসএল ভালো অবস্থায় চলে গেছে। কিন্তু আমি বলব, বিপিএলেরও একটা ভালো সময় ছিল। পাকিস্তানে বসে আমরা তখন দেখতাম, বড় খেলোয়াড়েরা এখানে খেলতে আসছে, টুর্নামেন্টের মানও খুব ভালো ছিল। সেই মান এখন নিচে নেমে গেছে। কারণটা আমার জানা নেই, আমি টুর্নামেন্টের সব আসরে খেলিনি। তবে এখন আবার ভাবা যেতে পারে, কীভাবে এর মান ভালো করা যায়।
সমস্যা হলো, একই সময়ে তিনটি অন্য লিগ হয়। সূচিটা এমন হতে হবে যেন সবাই সব টুর্নামেন্টে খেলতে পারে। একটার সঙ্গে আরেকটা সাংঘর্ষিক না হয়। বিপিএলের মান অবশ্যই আবার ভালো হবে, তবে এর জন্য চিন্তাভাবনা করতে হবে। সিনিয়র ক্রিকেটাররা যেন এখানে আসতে পারেন, কোচরা আসতে পারেন। বিপিএল কমিটি সেই পথ খুঁজে বের করতে পারলে এই টুর্নামেন্টও আবার ওপরের দিকে যাবে।
সাবেক অধিনায়ক মোহাম্মদ হাফিজ এখন পাকিস্তান জাতীয় দলের পরিচালক। ক্যারিয়ারের শুরু থেকে তিনি আপনাকে দেখেছেন। আপনার জীবনে তাঁর ভূমিকা কতটা?
রিজওয়ান: ডিপার্টমেন্টে খেলার সময় থেকেই হাফিজ ভাইকে চিনি। শুনেছি, তখনই আমার আড়ালে হাফিজ ভাই ম্যানেজমেন্টকে বলেছিলেন, এই ছেলে বেঞ্চে বসে থাকার ছেলে নয়। এটা ওই সময়ের কথা, যখন আমি ১ লাখ ২৫ হাজার রুপির প্রস্তাব ছেড়ে ২৫ হাজার রুপিতে খেলেছি। আমি উইকেটকিপার–ব্যাটসম্যান, ওদিকে টেস্ট খেলোয়াড় আদনান আকমলও দলে। হাফিজ ভাই বলেছিলেন, আমাকে বসিয়ে না রেখে শুধু একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে হলেও খেলানো হোক। আমি যখন প্রথম দলে আসি, তখনই উনি আমার মধ্যে কিছু দেখেছিলেন। হাফিজ ভাইয়ের কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি, যেটা আমি আমার জীবনে কাজে লাগিয়েছি। আসলে কেউ একজন লাগে যে আপনাকে পুরোপুরি বুঝবে। সালাউদ্দিন স্যারের কথাই ধরুন।
অনেক জুনিয়রকেই দেখি তাঁর সঙ্গে কাজ করতে চায়। এমনকি অভিজ্ঞ সাকিবও, যার আসলে কাউকে দরকারই নেই! আমি দেখেছি, সাকিব যখন ব্যাটিং নিয়ে সমস্যায় ভুগছে, আমাদের নেট শেষ করে সালাউদ্দিন স্যার তার নেটে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তাকে তিনি সময় দিয়েছেন; কারণ, সাকিব সময়টা তাঁর কাছ থেকে চেয়েছিল। কাউকে ১০–২০ বছর যাবৎ দেখে আসলে আমি জানব, কীভাবে তার সমস্যা দূর করতে হবে। কখনো কখনো টেকনিকে নয়, সমস্যা থাকে মনে। কোচ সেটা বোঝেন। সালাউদ্দিন স্যার জানতেন সাকিবের কী প্রয়োজন এবং সেটাই তিনি তাকে বলেছেন। আসলে কোচ যদি একজন খেলোয়াড়কে ছোটবেলা থেকে চেনেন, সেটা ওই খেলোয়াড়ের জন্য বিরাট পাওয়া। সাকিবের ক্ষেত্রে সালাউদ্দিন স্যার সে রকমই একজন, আমার জন্য যেমন হাফিজ ভাই।
টি–টোয়েন্টি আর ওয়ানডেতে আপনাকে ভিন্ন ভূমিকায় নামতে হয়। কীভাবে মানিয়ে নেন?
রিজওয়ান: প্রথম কথা হলো, কোনো একটা দলে খেলতে গিয়ে যদি আপনি নিজের কথাই বেশি ভাবেন, তাহলে মনে হয় না আপনি সফল হবেন। যে শুধু নিজেকে বাঁচানোর চিন্তা করে, সে বেশি দূর যেতে পারে না। যারা অ্যাভারেজের দিকে তাকিয়ে খেলে, তারা অ্যাভারেজ খেলোয়াড়ই রয়ে যায়। এটা নিয়ে আলোচনা করবে অন্য মানুষ। বিরাট কোহলির রানের গড় তো বেড়েই চলেছে, কিন্তু সে সেদিকে তাকায়ও না। কারণ, অ্যাভারেজ খেলোয়াড়েরাই অ্যাভারেজের দিকে তাকায়। বড় খেলোয়াড়েরা ভাবে দলের কথা, পরিস্থিতি অনুযায়ী খেলার কথা। আমার মনোযোগ সব সময় দলের প্রয়োজনের দিকে থাকে। আর দল চায় আমি যেন স্কোরবোর্ডের দিকে তাকাই, সেখানে কী হচ্ছে তা দেখি, সেভাবে ভাবি। আমিও ওটা মেনেই খেলতে পছন্দ করি। ব্যক্তিগত জীবনেও এটা আমার দর্শন। তবে হ্যাঁ, সব সময় সহজ নয় কাজটা। টি–টোয়েন্টিতে নতুন বলে খেলা এবং ওয়ানডেতে ২৫ ওভারের পর যাওয়া, যখন বল অনেকটাই পুরোনো হয়ে যায়, দুটোর সঙ্গে তাল মেলানো কঠিন। তবে এর পুরোটাই মনস্তাত্ত্বিক বিষয়।
বাবর আজমের সঙ্গে আপনার থিতু ওপেনিং জুটি ভাঙা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। এ নিয়ে কোনো মন্তব্য?
রিজওয়ান: এ নিয়ে সমালোচনা করা উচিত নয়। ম্যানেজমেন্টের কথা সবাই ভুল বুঝেছে হয়তো। ম্যানেজমেন্ট এবং অধিনায়ক বলেছেন, বিশ্বকাপের সেরা একাদশটা কেমন হতে পারে, সেটাই তাঁরা দেখতে চাইছেন। আমরা ডানহাতি–বাঁহাতি সমন্বয় চেষ্টা করতে পারি। সাইম আইয়ুব বাঁহাতি ও বাবর আজম ডানহাতি। ফখর জামানও আছে। বিশ্বকাপের জন্যই আমরা ডানহাতি–বাঁহাতি সমন্বয় নিয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষা চালাচ্ছি। আমি এটাকে ভুল সিদ্ধান্ত মনে করি না। ভাগ্যে থাকলে ভবিষ্যতে আমি আবার ওপেন করব। এ নিয়ে আমার বা বাবরের কোনো ক্ষোভ নেই। সব দেশই এখন ডানহাতি–বাঁহাতি সমন্বয়ের চেষ্টা করছে। আমাদের ম্যানেজমেন্টও তার ব্যতিক্রম নয়।