ফাইনালে আপনার গোলেই এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। সেই গোলেই প্রথম স্তব্ধ হয় কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামের দর্শক।
মনিকা চাকমা: দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার ফাইনালে গোল করা অবশ্যই বিশেষ কিছু। তবে গোলটা করার সময় খুব দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখাতে হয়েছে। সাবিনা আপুর কাছ থেকে বল পেয়ে তহুরা বক্সের মাথা থেকেই বলটা ডান দিকে ঠেলে দেয়। আমি একটু পেছনে ছিলাম। দ্রুত দৌড়ে বলটা ধরে সেটা জালে পাঠাতে হয়েছে। নেপালি গোলকিপার এগিয়ে এসেছিল, আমার সঙ্গেও একজন ডিফেন্ডার দৌড়াচ্ছিল। তবে বলে পা লাগিয়েই আমি পড়ে যাই, দেখলাম ঠিকই সেটা জালে গিয়েছে। এরপর পুরো স্টেডিয়াম চুপ। দারুণ একটা অনুভূতি।
কিন্তু গোলটা তো বেশিক্ষণ ধরে রাখা যায়নি। তবে নেপাল সমতা ফেরানোর পর ৮১ মিনিটে ঋতুপর্ণা জয়সূচক গোল করেন। সেই গোলের সময় আপনি মাঠের কোন জায়গায় ছিলেন?
মনিকা: আমি মাঠের মাঝখানে ছিলাম। একটু ওপরের দিকে। ঋতু যখন শটটা নিল, তখন আমার কাছে ওটা ক্রসই মনে হয়েছিল। শটটা সোজা গোলে ঢুকে গেল। তবে মাঠে দাঁড়িয়ে বুঝতে পেরেছি, ওই শটে ঋতু কতটা পাওয়ার ব্যবহার করেছে। ভিডিওতে দেখলে সেটা ঠিক বোঝা যায় না। দারুণ গোল। এসব গোলই তো ম্যাচ জেতায়।
সাফের আগে ভুটানে খেলতে গিয়েছিলেন। মেয়েদের এএফসি চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলেছেন ভুটানের থিম্পু কলেজের হয়ে। ঋতুপর্ণা, মারিয়া ও আপনি সাফের আগে কতটা উপকৃত হয়েছেন চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলে?
মনিকা: দারুণ একটা অভিজ্ঞতা। ইরান আর হংকংয়ের ক্লাবের বিপক্ষে খেলে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। তবে সেটি ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমাদের তিনজনকে উপকৃত করেছে। জুলাই মাসে ভুটানের বিপক্ষে দুটি প্রীতি ম্যাচ আর তার আগে দেশের মাটিতে চীনা তাইপের বিপক্ষে আরও দুটি আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ দলগতভাবে আমাদের খুব কাজে এসেছে।
প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানকে আপনারা হারাতে পারেননি। যদিও আপনি ম্যাচসেরা হয়েছিলেন। কিন্তু তার পরদিনই কোচ বাটলারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুললেন…
মনিকা: আসলে কোচের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিইনি। পিটার বাটলার দারুণ কোচ। তবে তিনি কিছুটা পরীক্ষা–নিরীক্ষা করছিলেন। আমরা মনে করেছি, দলে সিনিয়র খেলোয়াড়দের খেলানো দরকার। আমরা চেয়েছি সিনিয়ররা খেলুক। আমি সেটাই বলেছি। কোচের কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছি। আমরা কেউই তাঁর বিরুদ্ধে নই। দলের স্বার্থেই আমরা চেয়েছিলাম সিনিয়রদের অভিজ্ঞতা কাজে আসুক।
কিন্তু আপনার সেই অভিযোগ নিয়ে তো কোচ বাটলারও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
মনিকা: এরপর ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে আমরা যখন ৩–১ গোলে জিতলাম, তখন কোচ আমাদের সবার খেলার প্রশংসা করেছেন। হাতে ধরে ধরে সবার ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়েছেন। ফাইনালে যখন আমরা নেপালকে হারালাম, তখন আমাদের সঙ্গে তিনিও আনন্দ করেছেন। কোনো সমস্যা নেই।
ফাইনালে দশরথ স্টেডিয়ামের সেই পরিবেশ। পুরো গ্যালারি আপনাদের বিপক্ষে। মাঠে নেমে কেমন মনে হচ্ছিল?
মনিকা: আমরা জানতাম নেপালের পক্ষেই পুরো স্টেডিয়াম থাকবে। তাই এসব নিয়ে মোটেও বিচলিত হইনি। আমরা আমাদের খেলাটা খেলে গিয়েছি। তা ছাড়া, এমন পরিবেশে খেলার অভিজ্ঞতা আমাদের ২০২২ সালের সাফের ফাইনালেই হয়েছিল। আমরা শুধু নিজেদের পারফরম্যান্সে মনোযোগী ছিলাম।
বাফুফের নতুন সভাপতি তাবিথ আউয়াল বুধবার আপনাদের সঙ্গে দেখা করলেন। কী কথা হলো তাঁর সঙ্গে?
মনিকা: স্যার আমাদের সাফ জয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন। সবার সঙ্গে আলাদা আলাদা কথা বলেছেন। আমরা স্যারের কাছে বেশি করে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার কথা বলেছি। আরও কিছু ব্যাপার নিয়ে তাঁর সঙ্গে বসতে চেয়েছি। তিনি বলেছেন, বসবেন সবকিছু নিয়ে। আরও বিশদ আলোচনা করবেন।
আপনার ফুটবলার হয়ে ওঠার গল্পটা…
মনিকা: আমি খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার মেয়ে। সেখানে ২০১১ সালে বঙ্গমাতা টুর্নামেন্টে খেলি লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার হয়ে। ওই সময় আমি ক্লাস ফাইভে পড়তাম। ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি আকর্ষণ ছিল। আমাদের স্কুলের স্যার ছিলেন গোপাল স্যার। তিনি আমাদের হাতে ধরে ফুটবল খেলা শিখিয়েছেন। এরপর রাঙামাটিতে এসে ভর্তি হই মগাইছড়ি স্কুলে, সেখানে বীরসেন স্যারের কথা বলতে হয়। স্বপ্নটা আসলে তিনিই মাথায় ঢুকিয়ে দেন। বাবাকে বলে নিজেদের একাডেমিতে ভর্তি করান। রাঙামাটিতেই পরিচয় হয় ঋতুপর্ণা আর রুপনার সঙ্গে। আমরা ছোটবেলা থেকে একই সঙ্গে বেড়ে উঠেছি। রাঙামাটিতে কোচ বরুণ বিকাশ দেওয়ান আর অরুণ বিকাশ দেওয়ান স্যার আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছেন। তাঁরা না থাকলে এই পর্যায়ে আসতে পারতাম না।