রাসেল ডমিঙ্গোর সাক্ষাৎকার: দ্বিতীয় পর্ব
‘আমি যখন আসি, তখন সংস্কৃতি ছিল তরুণদের দমিয়ে রাখার’
সিনিয়র ক্রিকেটারদের সঙ্গে রাসেল ডমিঙ্গোর সম্পর্ক নিয়ে টানাপোড়েনের কথা গোপন কিছু নয়। বাংলাদেশের কোচ হয়ে আসার পর নিয়মিতই সংবাদমাধ্যমে এসেছে এসব। এ প্রসঙ্গে রাসেল ডমিঙ্গো সব সময় নীরবই থেকেছেন। এসব নিয়ে প্রথমবারের মতো খোলামেলা কথা বলেছেন দক্ষিণ আফ্রিকান কোচ। মোহাম্মদ জুবাইর-এর নেওয়া সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব—
প্রশ্ন :
মাহমুদউল্লাহর টি-টোয়েন্টি অধিনায়কত্বকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ডমিঙ্গো: আমার দৃষ্টিতে সে দারুণ একজন অধিনায়ক। কঠিন সময়ে দারুণ কাজ করেছে। তার ব্যাটিংয়ের অনেক সমালোচনা হয়। কিন্তু ওর টি-টোয়েন্টি ব্যাটিংয়ে আমার যথেষ্ট আস্থা আছে। তার কাছ থেকে অধিনায়কত্ব কেড়ে নিতে দেখে খুব অবাক হয়েছি। ওর জন্য আমার খারাপ লাগছে। কারণ, আমি জানি, ও আরেকটা বিশ্বকাপে নেতৃত্ব দিতে চেয়েছিল। যাহোক, এটা বোর্ডের ব্যাপার। বোর্ড যা ভালো মনে করেছে, তা করেছে।
প্রশ্ন :
মুমিনুল হকের ব্যাপারে কী বলবেন?
ডমিঙ্গো: মুমিনুলকে বলতে পারেন ‘রিলাকট্যান্ট ক্যাপ্টেন’, অধিনায়কত্ব করাটা ও ঠিক উপভোগ করত বলে মনে হয় না। আমি তাকে বারবার অধিনায়কত্বের জন্য উৎসাহিত করতাম। এ জন্য আমার ওপর ওর কখনো কখনো একটু রাগও হয়ে থাকতে পারে। মজা করে বারবার বলত, ‘তোমার জন্য আমার জীবন কঠিন হয়ে গেল।’ কিন্তু আমি চাইছিলাম, অধিনায়ক হিসেবে সে নিজেকে গড়ে তুলুক। কারণ, টেস্ট ক্রিকেটের জন্য ধ্যানজ্ঞান যেমনটা হওয়া উচিত, তার সেটা আছে। ওর দায়িত্ব ছাড়াটা আমাকে তাই একটু হতাশ করেছে। আমরা তার নেতৃত্বে ম্যাচ হেরেছি অনেক, কিন্তু কতগুলো ম্যাচে জয়ের সম্ভাবনাও জাগিয়েছি। খুব কাছে গিয়ে হেরেছি। তার সময়ে টেস্ট দল অনেক উন্নতি করেছে। ফল হয়তো সেটা বলছে না, কিন্তু উন্নতি করেছে। মুমিনুল ওর সবটা দিয়ে চেষ্টা করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর পারছিল না।
প্রশ্ন :
সাকিব আল হাসানকে অধিনায়ক হিসেবে কেমন দেখলেন?
ডমিঙ্গো: সাকিবকে টেস্টে ফিরে পাওয়া বড় ব্যাপার। সে টেস্ট খুব কম খেলেছে। মুমিনুলের অধিনায়কত্বের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জ ছিল সাকিবের না থাকা। এখন যেহেতু সে অধিনায়ক, তার মানে সে নিয়মিত টেস্ট খেলবে। এটা দলের জন্য ভালো। আমি সব সময় সাকিবকে বলি, তোমার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মাঠে নয়, মাঠের বাইরে। কারণ, ট্যাকটিক্যালি সে ভালোই করবে। পারফর্মও করবে। এটা নিশ্চিত করতে হবে, সে যেন সব সময় টেস্ট খেলার জন্য মুখিয়ে থাকে। কারণ, সে অসাধারণ একজন ক্রিকেটার। এখন মনে হচ্ছে, সে টেস্ট দলটাকে ভালো করার চেষ্টা করছে। এটা ভালো লক্ষণ।
প্রশ্ন :
বাংলাদেশ দলের অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। এখন তাঁদের সঙ্গে আপনার বোঝাপড়া কেমন?
ডমিঙ্গো: আমি বাংলাদেশে তিন বছর ধরে কাজ করছি। সব ক্রিকেটারের সঙ্গে আমার সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক ছিল কোন সময়ে, এটা বলতে হলে আমি বলব, সেটা এখন। বিশেষ করে অভিজ্ঞদের সঙ্গে। অনেক সময় লেগেছে এই সম্পর্কটা গড়তে। অনেকে হয়তো শুরুতে ভেবেছে, আমি কেন এই সংস্করণে খেলছি না, কেন এই সংস্করণে খেলছি। এখন সব অভিজ্ঞ ক্রিকেটারই এখন এসব ব্যাপারে পরিষ্কার বলে সম্পর্কটা খুবই ভালো। এতে সময় লেগেছে। অভিজ্ঞদের ক্ষেত্রে এটা লাগেই। আমার ডি ভিলিয়ার্সের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক গড়তে আমার দুই বছর লেগেছে। অভিজ্ঞদের একটা ব্যক্তিত্ব থাকে, অহংকারের জায়গা থাকে। সেই বাধা দূর করে আস্থার জায়গা তৈরি করতে সময় সব জায়গায়ই লাগে।
প্রশ্ন :
তাঁদের ক্ষেত্রে আপনি কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মাশরাফি বিন মুর্তজার কথাই যদি বলি, তাঁর বাদ পড়াটা কীভাবে সামলেছেন?
ডমিঙ্গো: আমি মাশরাফিকে নিয়ে কিছু বলতে চাই না। কারণ, তাকে মাত্র তিন ম্যাচের জন্য পেয়েছি।
প্রশ্ন :
বাকিদের ব্যাপারে কী বলবেন?
ডমিঙ্গো: বাকিরা এখন জানে, আমি কোন ভাবনা থেকে তাদের ব্যাপারে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার মনে হয়, এখন ওরা এটা বোঝে।
আমি চেয়েছি, নিজেকে টি-টোয়েন্টিতে প্রমাণের চেষ্টায় মুশফিক যেন ওয়ানডে ও টেস্টের ব্যাটিংটা হারিয়ে না ফেলে।রাসেল ডমিঙ্গো
প্রশ্ন :
মুশফিকুর রহিমের ব্যাপারটা যদি ব্যাখ্যা করতে বলি...
ডমিঙ্গো: মুশির টি-টোয়েন্টির কথাই যদি বলি, আমি চাইনি টি-টোয়েন্টি ব্যাটিংয়ের কারণে তার টেস্ট ও ওয়ানডে ব্যাটিং নষ্ট হোক। আমি দেখেছি, এটা অভিজ্ঞদের কতটা ক্ষতি করতে পারে। হাশিম আমলার কথাই ধরুন। ওর সঙ্গে সাত বছর কাজ করেছি। সে টি-টোয়েন্টি খেলার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিল। যে কারণে ক্যারিয়ারের শেষ দুই বছরে টেস্ট গড় ৫৫ থেকে নেমে এসেছে ৪৫-এ। মুশি যেন সে পথে না যায়, সে জন্যই তাকে সতর্ক করছিলাম। সে যেন নিজেকে টি-টোয়েন্টিতে প্রমাণের চেষ্টায় তার ওয়ানডে ও টেস্টের ব্যাটিংটা হারিয়ে না ফেলে।
রিয়াদ টেস্টে থেকে গেলে আমরা ইয়াসিরকে পেতাম না। লিটনকে নিয়মিত খেলাতে পারতাম না।রাসেল ডমিঙ্গো
প্রশ্ন :
মাহমুদউল্লাহকে টেস্ট থেকে বাদ দেওয়ার পেছনে কী কারণ ছিল?
ডমিঙ্গো: রিয়াদের বয়স ৩৮। আরেকজন মিডল অর্ডার আমাকে তৈরি করতে হতো ভবিষ্যতের জন্য। হুট করে যদি অভিজ্ঞরা চলে যায় আর হুট করে নতুনরা আসে, তাহলে তো দলের লাভ হলো না। আমি চেয়েছি দু-একজন অভিজ্ঞ থাকতে থাকতে আরও দু-একজন নতুন ব্যাটসম্যান তৈরি করতে। রিয়াদ থেকে গেলে আমরা ইয়াসিরকে পেতাম না। লিটনকে নিয়মিত খেলাতে পারতাম না। এসব বিষয় ওরা হয়তো তখন বুঝতে পারেনি। কিন্তু এখন বড় ছবিটা দেখতে পাচ্ছে।
কিছু সময়ের জন্য সম্পর্ক খুব ভালো ছিল না। গত ৮ থেকে ৯ মাস আমাদের সম্পর্ক খুবই ভালো যাচ্ছে।রাসেল ডমিঙ্গো
প্রশ্ন :
তামিম ইকবালের সঙ্গে আপনার বড়সড় ঝগড়া হয়েছিল শুনেছি…
ডমিঙ্গো: শুরুতে মনে হয়েছে, ওর সঙ্গে আমার ভালোই সম্পর্ক। এরপর আমাদের কিছু বিষয়ে ঝামেলা হয়। কিছু সময়ের জন্য সম্পর্ক খুব ভালো ছিল না। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। সে দলের অধিনায়ক। আমি কোচ। দলের ভালোর জন্য আমাদের একসঙ্গে কাজ করার উপায় খুঁজে বের করতে হতো। গত ৮ থেকে ৯ মাস আমাদের সম্পর্ক খুবই ভালো যাচ্ছে। ৫০ ওভারের খেলা নিয়ে আমাদের ভাবনা একই। নিজের ব্যাটিং নিয়ে আমার মন্তব্য সে গুরুত্বসহকারে নেয়।
প্রশ্ন :
প্রথম দায়িত্ব নেওয়ার পর ড্রেসিংরুমে তরুণদের অবস্থান কেমন ছিল?
ডমিঙ্গো: বেশির ভাগই ছিল অভিজ্ঞদের ছায়ায়। আমি ওদের বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। স্বাধীনচেতা হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছি। নিজের পারফরম্যান্সের দায়ভার নিতে বলেছি। এখন ওরা সরাসরি টিম মিটিংয়ে কথা বলে। নিজেদের মতামত ভাগাভাগি করে। ওরাও যে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা এখন তারা বোঝে। আমি যখন আসি, তখন পুরো সংস্কৃতিই ছিল অভিজ্ঞদের দাপটের আর তরুণদের দমিয়ে রাখার। কিন্তু একটা দলে সবাই গুরুত্বপূর্ণ। তরুণ, অভিজ্ঞ, সহকারী কোচ কিংবা ফিজিও।