রাজনীতিমুক্ত হবে কি ক্রীড়াঙ্গন

আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে ক্রীড়াঙ্গনে চলেছে দেদার দলীয়করণ। সেই অধ্যায়ের সমাপ্তি টানতে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সংস্কারের রূপরেখা পাওয়া যাবে কিছুদিনের মধ্যেই। তার আগে বিগত দিনে ক্রীড়াঙ্গনের হালচাল নিয়ে এই ধারাবাহিকের আজ দ্বিতীয় পর্ব

বাংলাদেশ কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খানের চেয়ারটা এমন শূন্যই পড়ে থাকতপ্রথম আলো

রাজনীতিমুক্ত ক্রীড়াঙ্গনের অঙ্গীকার করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি তারা রাখেনি। দেদার দলীয় লোক বসিয়েছে ক্রীড়া ফেডারেশনের শীর্ষ পদে। দলীয়করণের ফলে ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোতে ক্রীড়াসংশ্লিষ্ট সংগঠক এখন খুবই কম। আগে যেমন নিবেদিতপ্রাণ অনেক সংগঠক ছিলেন, এখন তা অনেক কমে গেছে। নেতৃত্বে আসার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় তাঁরা টিকতে পারেননি।

গোপালগঞ্জের যুবলীগ নেতা এমবি সাইফ হয়েছেন সাঁতার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক। মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় ক্যাসিনো–কাণ্ডে অভিযুক্ত আলোচিত যুবলীগ নেতা মমিনুল হক সাঈদ হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক পদে বসেন আওয়ামী লীগের প্রভাব কাজে লাগিয়ে। ক্যাসিনো নিয়ে পুলিশের অভিযানের পর পালিয়ে যাওয়া মমিনুল অনেক দিন পর দেশে ফিরে আবার হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক পদে বসে যান।

গত ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের আগে ২৪ খেলোয়াড়সহ জাতীয় হকি দলের ৩০ জনের জিও (সরকারি আদেশ) করান তিনি জার্মানিতে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের জন্য। যে দলের ম্যানেজার করা হয়েছিল ক্যাসিনো-কাণ্ডে জেলে যাওয়া বিতর্কিত যুবলীগ নেতা ও পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটকে। দলনেতা হিসেবে জিও নেন মমিনুল হক সাঈদ নিজেই। সরকার বদলের পর সেই জিও বাতিল করা হয়েছে। ফলে হকি দলের ইউরোপে যাওয়া হয়নি।

বিভিন্ন ক্রীড়া ফেডারেশনের কয়েকজন সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ক্রীড়া উপকমিটির সদস্য। তাঁদের মধ্যে উশু ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক দুলাল হোসেন, সাইক্লিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক তাহেরুল আলম চৌধুরী, বক্সিংয়ের সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম ও রোলার স্কেটিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আহমেদ আসিফুল হাসানের নাম উল্লেখযোগ্য। আসিফুল অবশ্য বলেছেন, ক্রীড়াঙ্গনে তাঁর কাজ দেখে তাঁকে আওয়ামী লীগের উপকমিটিতে নেওয়া হয়েছে। তাহেরুল দাবি করেছেন, তিনি রাজনীতি করেন না এবং উপকমিটির সভায়ও কখনো যাননি।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পরপরই ২০০৯ সালে আহাদ আলী সরকার ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী থাকার সময় শেখ পরিবারের প্রভাব খাটিয়ে দাবা ফেডারেশনের অ্যাডহক কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদে বসে পড়েন আওয়ামী লীগসংশ্লিষ্ট মোকাদ্দেস হোসাইন। কিন্তু তাঁকে সাধারণ সম্পাদক পদে মানতে পারেননি দেশের পাঁচ গ্র্যান্ডমাস্টারের চারজনই। তাঁদের মধ্যে তিনজন খেলার বাইরে চলে যান।

বাংলাদেশের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সংগঠকদের গায়ে রাজনৈতিক রং দেখা হয় আগে। সরকার বদলের সঙ্গে ফেডারেশনের নেতৃত্বও বদলে যায়।

মোকাদ্দেসের বিরুদ্ধে দাবাড়ুরা অনেক আন্দোলনও করেছেন। বাংলাদেশের দাবা যে ১৫ বছর ধরে কোনো গ্র্যান্ডমাস্টার পাচ্ছে না, এর কারণ হিসেবে মোকাদ্দেসের সেই সময়টাকে সামনে আনেন অনেকে। কয়েক বছর ধরে মোকাদ্দেস ফ্রান্সপ্রবাসী।

গত প্রায় ১৬ বছরে ফেডারেশনগুলোতে দলীয়করণ একেবারে মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে সত্যি, তবে এর আগে বিএনপির সময়ও দলীয়করণ হয়েছে। দলের নেতাদের বিভিন্ন ফেডারেশনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদে বসানো হয়েছে। বাফুফের সভাপতি ছিলেন দলটির সাবেক সংসদ সদস্য এস এ সুলতান, বিসিবির সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য আলী আসগর।

অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সভাপতি হয়েছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আবদুস সালাম; একই ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক পদে বসেন টাঙ্গাইলের আলী ইমাম, যিনি তখন টাঙ্গাইল জেলা যুবদলের সভাপতি ছিলেন। সাঁতার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হন বগুড়ার আমিনুল হক দেওয়ান। কুস্তির সভাপতি হন বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ। ছাত্রদলের প্রয়াত সভাপতি নাসির উদ্দীন পিন্টুকে সাইক্লিং ফেডারেশনের সভাপতি করা হয়েছিল, একই ফেডারেশনে সভাপতি হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের হাজি সেলিমও।

আরও পড়ুন

নানা রঙের সভাপতি

ক্রীড়া ফেডারেশনে সভাপতি নিয়োগে সরকারের কোনো নীতিমালা নেই। সরকার চাইলে যে কাউকে বসাতে পারে এই পদে। আর সেই সুযোগে আওয়ামী লীগ সরকারদলীয় নেতা, মন্ত্রীদের ফেডারেশনের শীর্ষ পদে বসিয়েছে। সরকার মনোনীত সর্বশেষ সভাপতির তালিকায় মন্ত্রী ছিলেন চারজন—খালিদ মাহমুদ চৌধুরী (টেনিস), জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক (ক্যারম), ফারুক খান (স্কোয়াশ), ডা. দীপু মনি (খিউকুশিন কারাতে অ্যাসোসিয়েশন)। সভাপতি ছিলেন সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান (কুস্তি) ও সাবেক হুইপ মাহবুবা আরা বেগম গিনি (মহিলা ক্রীড়া সংস্থা)। ২০০৯ সাল থেকে কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খান ১৫ বছরে ১৫ বারও ফেডারেশনে এসেছেন কি না সন্দেহ।

বাংলাদেশ অ্যামেচার রেসলিং ফেডারেশনের ভেতরের ছবি
প্রথম আলো

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক কাজী মোরশেদ হোসেন ছিলেন তায়কোয়ান্দো ফেডারেশনের সভাপতি। চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন চুকবল অ্যাসোসিয়েশের সভাপতি হন। মহাজোটের অন্য নেতারাও ফেডারেশন সভাপতির পদ অলংকৃত করেছেন। যেমন, জাসদের হাসানুল হক ইনু বাংলাদেশ মার্শাল আর্ট কনফেডারেশনের। জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ বাংলাদেশ সার্ফিং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হয়েছিলেন। ৫৫টি ক্রীড়া ফেডারেশন/অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকার সর্বশেষ যে ৫৩টিতে সভাপতি নিয়োগ দিয়েছে, তার মধ্যে ১৪ জনই ছিলেন দলীয় নেতা। সংসদ সদস্য ছয়জন, সাবেক সংসদ সদস্য দুজন। সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন সাতজন। সাবেক-বর্তমান সেনা কর্মকর্তা ছয়জন। পুলিশ কর্মকর্তা দুজন। এ ছাড়া ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ, মিডিয়া ব্যক্তিত্বও ছিলেন সভাপতিদের তালিকায়।

আরও পড়ুন

কেউ ৩৩ বছর, কেউ ৪৩ বছর

বিভিন্ন ফেডারেশনে সাধারণ সম্পাদক পদে এমন বেশ কয়েকজন আছেন, যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে চেয়ার আঁকড়ে ধরে আছেন। দীর্ঘ ৪৩ বছর ধরে কুস্তি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক পদে আছেন তাবিউর রহমান পাহলোয়ান। ৩৩ বছর ধরে বাংলাদেশ হ্যান্ডবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান কোহিনুর। ১৯৯৮ সালে তায়কোয়ান্দোর প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই ২৬ বছর ধরে সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল ইসলাম। দীর্ঘ এই সময় ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক পদে থাকা নিয়ে যাঁর নিজের ভাষ্য, ‘মিলেঝিলে সবাইকে নিয়ে থাকি বলেই এত দিন টিকে আছি।’

৪৩ বছর ধরে কুস্তি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক পদে আছেন তাবিউর রহমান পাহলোয়ান

ভলিবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক পদে আশিকুর রহমান আছেন ২২ বছর ধরে। একই সঙ্গে জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংগঠক পরিষদ ফোরামের অন্যতম নীতিনির্ধারকও তিনি। ভেঙে দেওয়ার আগপর্যন্ত নড়াইল জেলা ক্রীড়া সংস্থারও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ৩ মেয়াদে ২০ বছরের ওপরে রোইং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক পদে আছেন ৯৩ বছর বয়সী হাজী খোরশেদ আলম। আর্চারির সাধারণ সম্পাদক পদে কাজী রাজীব উদ্দীন আহমেদ আছেন ১৮ বছর। কাজী রাজীব সেপাক টাকরো অ্যাসোসিয়েশনেরও সভাপতি। বাস্কেটবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক পদে এ কে সরকার আছেন ১৬ বছর ধরে।

আরও পড়ুন

বলা হয়, সংগঠক সমৃদ্ধ হন অভিজ্ঞতায়। কিন্তু নতুন নেতৃত্বও তো দরকার। অনেক খেলাতেই সেটা গড়ে ওঠেনি। ফলে বছরের পর বছর একক রাজত্ব চলছে। সরকার বদলালেও এই মুখগুলো থেকে যায়। এ প্রসঙ্গে সাবেক সচিব ও ক্রীড়া বিশ্লেষক আখতার হোসেন খান বলেন, ‘নতুন নেতৃত্ব এলে ভালো হয়। তবে নতুন নেতৃত্ব সেভাবে চোখে পড়ছে না, এটাও বাস্তবতা।’ বাংলাদেশের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সংগঠকদের গায়ে রাজনৈতিক রং দেখা হয় আগে। সরকার বদলের সঙ্গে ফেডারেশনের নেতৃত্বও বদলে যায়। যে কারণে অনেক ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হয় খেলাটা। এবার কি সেই ধারা বদলাবে?

বিএনপির ক্রীড়া সম্পাদক ও বাংলাদেশ ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল হক বদলাবে বলে আশাবাদী হতে চান। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর তিনি অঙ্গীকার করেছেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে ক্রীড়াঙ্গনে দলীয়করণ করা হবে না, ‘ক্ষমতায় এলে আমরা চাইব, খেলার অঙ্গনের মানুষেরাই ক্রীড়াঙ্গন পরিচালনা করুন। আমরা কোনোভাবেই দলীয় লোক দিয়ে খেলাধুলা পরিচালনা চাই না।’