৮০ টাকায় দিন কাটানো আলামিনের স্বপ্ন পূরণ হবে?
এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণের জন্য টাকার প্রয়োজন। রিকশাচালক বাবা না করে দিয়েছেন। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নেমেছেন আগেই, সে জন্য রাজমিস্ত্রির জোগালের কাজ করতেন। কিন্তু সে কাজও জুটছিল না বেশ কিছুদিন। তাহলে কোথায় পাওয়া যাবে সেই টাকা?
হাতে একটাই উপায় ছিল। দৌড়াতে হবে, অনেক জোরে দৌড়াতে হবে। দৌড়ে সবাইকে ছাড়িয়ে যেতে পারলেই পাওয়া যাবে প্রয়োজনীয় অর্থ। কাজটি সহজ নয়, কিন্তু অভাবের মহাসড়কে বহু আগেই যাকে দৌড় শুরু করতে হয়েছিল, তাঁর জন্য এটা তো শুধু গতিটা আরেকটু বাড়ানোর পালা। সেদিন জোরে দৌড়ানো ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না মোহাম্মদ আলামিনের। নামকাওয়াস্তে কোনোমতে এক জুতা পায়ে গলিয়ে দিনাজপুর ম্যারাথনে নামলেন। ১ ঘণ্টা ১৬ মিনিট সময় নিয়ে ২১ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে দ্বিতীয় হলেন।
সেদিন পুরস্কার হিসেবে হাতে উঠছিল সাত হাজার টাকা। মিলেছিল ফরম পূরণের প্রয়োজনীয় অর্থ। সে সঙ্গে আরেকটি অর্জনও ছিল, শিকল ভাঙার স্বপ্ন। এলাকাবাসীর চোখে যা ‘গরিবের দৌড়ানোর রোগ।’
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ম্যারাথনকে খেলা হিসেবে স্বীকৃতি দিতেও অনেকের কার্পণ্য হতে পারে। তাই আলামিনের নামটিও অচেনা লাগার কথা। কয়েক দিন আগে হাতিরঝিলে অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক ম্যারাথনের সুবাদে আলামিনকে চেনা। ২১ কিলোমিটার হাফ ম্যারাথন ইভেন্টে ২১ বছরের তরুণ প্রথম হননি। দ্বিতীয় বা তৃতীয়ও হননি, হয়েছেন সপ্তম। গলায় পদক ওঠেনি। জ্বলে ওঠেনি ক্যামেরার ফ্ল্যাশ লাইটও। তবে কখনো কখনো নিজেকে চ্যাম্পিয়ন প্রমাণ করতে সেরা না হলেও চলে!
হাতিরঝিলের ঝাঁ–চকচকে রাস্তায় আলামিনের প্রতিযোগিতা পেশাদার দৌড়বিদদের সঙ্গে এক অপেশাদারের। ট্রেনার, কোচ, নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে অভ্যস্ত দৌড়বিদদের সঙ্গে ছোলা ও গুড় খেয়ে আসা এক দৌড়বিদের। শুধু ইচ্ছাশক্তিটাই যাঁর পুঁজি, হার মানতে না শেখাটাই যাঁর একমাত্র আশ্রয়।
‘অ্যামেচার’ দৌড়বিদ হিসেবেই পেশাদার দৌড়বিদদের সঙ্গে প্রায় সমানতালে দৌড়ে যাচ্ছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ুয়া আলামিন। বঙ্গবন্ধু ম্যারাথনে তাঁর সামনে থাকা ছয়জনই বিভিন্ন সার্ভিসেস সংস্থায় অ্যাথলেট হিসেবে চাকরিরত। তাঁর পেছনে থাকাদের মধ্যেও পেশাদার অ্যাথলেট ছিলেন কয়েকজন। এবার প্রথমবারের মতো অংশ নিয়েছিলেন সদ্য সমাপ্ত জাতীয় অ্যাথলেটিকসের ১০ কিলোমিটারে। সব পেশাদার অ্যাথলেটদের সঙ্গে দৌড়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন পঞ্চম হয়ে।
ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াতে আলামিনের জন্ম। চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। মায়ের ইচ্ছায় দিনাজপুরে নানাবাড়িতে তাঁর বেড়ে ওঠা। রিকশাচালক বাবার কথা, পড়াশোনার প্রয়োজন নেই। বরং খেতখামারে কাজ করে সংসারে কিছু টাকাপয়সার জোগান দিক। কিন্তু মায়ের স্বপ্ন বড় ছেলেটা লেখাপড়া করুক। তাই ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন নানির কাছে পড়াশোনা করানোর জন্য।
সেখানে রাজমিস্ত্রির জোগাল ও কিষানি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়া। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ৪০০ ও ৮০০ মিটারে আলামিন থাকেন সবার থেকে যোজন যোজন এগিয়ে। ২০১৫ সালে এসএসসি পরীক্ষার আগে কাজে লেগে যায় সেই লম্বা দৌড়ের সক্ষমতাই। দিনাজপুর ম্যারাথনে দৌড়ানোর আগে বড় অর্জন বলতে এলাকার একটি লাইব্রেরির আয়োজনে ১০ কিলোমিটার প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়া।
মাধ্যমিক পেরিয়ে উচ্চমাধ্যমিকে পা রাখা আলামিন খেতখামারে কাজ বাদ দিয়ে টিউশনি করিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে নেন। তখন কয়েক বছর বন্ধ ছিল দৌড়ানোও। ২০১৮ সালে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে শিক্ষক ড. জাফিরুল ইসলামের সহযোগিতায় দৌড়ানোর জন্য পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পান আলামিন।
সকালে ছোলা ও গুড় খেয়ে অনুশীলনে যাওয়া। হাড়ভাঙা খাটুনি শেষে হলে ফিরে রুটির সঙ্গে ডাল। দুপুরে ও রাতে হলের ডাইনিংয়ে ২৫ টাকায় খাবার খেয়ে দিন পার। ৮০ টাকার খাবার খেয়ে দিন পার করার ছেলেটির তবু দৌড়ানোর ‘রোগ’ ছাড়ে না।
সাফল্য ধরা দিতে শুরু করেছে গত বছর থেকে। দেশের বিভিন্ন জেলায় আয়োজিত ম্যারাথনে অংশ নেন আলামিন। দৌড়ানো ‘রোগে’র সুফলও পেতে শুরু করেছেন তিনি। সিলেটে হাফ ম্যারাথনে চ্যাম্পিয়ন হওয়া দিয়ে শুরু। একই জেলায় অনুষ্ঠিত ওসমানী ম্যারাথনেও চ্যাম্পিয়ন। এরপর কুমিল্লা ও গাজীপুরেও হয়েছেন প্রথম। এতে হাতে অল্পবিস্তর টাকাও পেতে শুরু করেছেন তিনি। কিন্তু দৌড়ানোর জন্য এক জোড়া ভালো কেডসের পেছনেই চলে যায় প্রাপ্তির বড় অংশ।
ফোনে বলছিলেন, ‘হলে ৮০ টাকার খাবারে দিন পার করি আমি। হলের বাইরে থাকলেও তো ভালো খেতে পারি না। সে জন্য অনুশীলনও কম করতে বাধ্য হই। না খেয়ে পরিশ্রম করা যায় না। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে প্রতিযোগিতায় নামলেই চ্যাম্পিয়ন হচ্ছি।’
এভাবেই দিন কাটছে আলামিনের। একজন অ্যাথলেটের জন্য মহাগুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নিয়ম মেনে একটি ডায়েট প্ল্যান অনুসরণ করা। নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার খাওয়া। বিশ্বের অনেক সেরা অ্যাথলেট অনুশীলনের কঠোর পরিশ্রমের ঘাটতি পূরণে দিনে ১০ হাজার ক্যালরিরও বেশি খান। মাঝারি মানের অ্যাথলেটদেরও দৈনিক ক্যালরি গ্রহণের সীমাটা বেশ উঁচু। কিন্তু কষ্টেসৃষ্টে দিন পার করা আলামিনের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। তবু স্বপ্ন দেখতে তাঁর বাধে না। আর স্বপ্নটাও তাঁর অনেক উঁচু।
‘এখন তো স্বপ্ন দেখি, ম্যারাথন দৌড়বিদ হওয়ার। খেলাতেই ক্যারিয়ার গড়ার ইচ্ছা। কিছু মানুষ আমাকে সহযোগিতাও করছেন।’
ক্রিকেটার আর ফুটবলার হওয়া যে দেশে সবার লক্ষ্য, সে দেশে এক তরুণ অ্যাথলেট হতে চান। কোনো সার্ভিসেস দলের সঙ্গে যুক্ত না থেকেও নিজ উদ্যোগে এক ইভেন্ট থেকে আরেক ইভেন্টে ছুটে যাচ্ছেন। পাগলামি বলুন, আর রোগ বলুন, এতেই মেতে আছেন আলামিন। কেউ কি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেবেন তাঁর স্বপ্নপূরণে?
দৌড়বিদ হওয়ার স্বপ্ন!