সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের প্রথম অলিম্পিয়ান
‘১৮ কোটি মানুষের মধ্যে একজন ভালো অ্যাথলেট আসে না, এটা চরম হতাশার’
আশির দশকে বাংলাদেশের অ্যাথলেটিকসের অন্যতম জনপ্রিয় নাম সাইদুর রহমান। ‘ডন’ নামে বেশি পরিচিত এই অ্যাথলেট দেশের দ্রুততম মানব ছিলেন ১৯৮২-৮৪ পর্যন্ত। তবে তাঁকে বেশি মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের প্রথম অলিম্পিয়ান হিসেবে। ১৯৮৪ লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে প্রথমবার অংশ নেন সাইদুর। সেসব স্মৃতিই নিউইয়র্ক থেকে প্রথম আলোর সঙ্গে টেলিফোন সাক্ষাৎকারে বললেন দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসী সাবেক এই স্প্রিন্টার—
প্রশ্ন :
অনিশ্চয়তা কাটিয়ে টোকিও অলিম্পিকের পর্দা উঠেছে ২৩ জুলাই। বাংলাদেশ থেকে প্রথম আপনিই অলিম্পিক গেমসে অংশ নিয়েছিলেন ১৯৮৪ সালে। সেই অনুভূতি কেমন ছিল?
সাইদুর: অসাধারণ সেই অভিজ্ঞতা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসরের উদ্বােধনী মার্চ পাস্টে আমি দেশের পতাকা বহন করছি, সেই অনুভূতি তো ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আর সেটি যদি হয়, দেশের প্রথম, তাহলে তো কথাই নেই।
আমরা অনেক বছর সাফ গেমসে (বর্তমান নাম এসএ গেমস) গিয়ে কিছু পাই না। এটা লজ্জার কথা। অথচ সাফ গেমসে আমরা ভালো করেছি। শাহ আলম, বিমলরা সাফে ১০০ মিটারে সোনা জিতেছে। সাফে আমরা সোনা জয়ের কথা ভেবেছি। সাফ গেমসেই যেখানে আমাদের খাবি খাওয়া অবস্থা, অলিম্পিক তো দূর কল্পনা।
প্রশ্ন :
বাংলাদেশ দলে আর কারা ছিলেন?
সাইদুর: ‘শেফ দ্য মিশন’ জেনারেল কে এম ওয়াহেদ, ম্যানেজার খুলনার প্রফেসর আবদুর রহমান আর একমাত্র অ্যাথলেট আমি। বাংলাদেশের তিনজনের দল অংশ নেয় লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে।
প্রশ্ন :
রেকর্ড বই বলছে, লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে ১০০ মিটার স্প্রিন্টের হিটে আপনার টাইমিং ১১.২৫ সেকেন্ড। মোট ৮২ জনে ৭৮তম আপনি। ২০০ মিটারের হিটে আপনার টাইমিং ২২.৫৯ সেকেন্ড, ৮০ জনে ৬৮তম। সব মিলিয়ে নিজের পারফরম্যান্সকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
সাইদুর: আমরা তখন অলিম্পিকের মঞ্চে একেবারেই নতুন। দেশে অ্যাথলেটিকসের সুযোগ-সুবিধা তেমন ছিল না। তারপরও যতটা সম্ভব চেষ্টা করেছি ভালো করতে।
প্রশ্ন :
তখন তো আপনি দেশের দ্রুততম মানব...
সাইদুর: হ্যাঁ, ১৯৮২-৮৪ পর্যন্ত দেশের দ্রুততম মানব ছিলাম। ২০০ মিটারেও তখন দেশসেরা আমি। ১০০ ও ২০০ মিটারে ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় আমার তিনটি করে সোনা। আমি ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ প্রথম দুটি সাফ গেমসে খেলেছি। ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সাফ গেমসে ৪X১০০ মিটার রিলেতে সোনাজয়ী বাংলাদেশ দলের সদস্য ছিলাম। পাকিস্তানেও একটা মিটে রিলেতে আমরা সোনা জিতেছিলাম। ১০০ মিটারে ’৮৪ সাফ গেমসে ব্যক্তিগত ব্রোঞ্জ পেয়েছি আমি, আফতাব মোল্লা পায় রুপা। ভাবুন, তখন স্প্রিন্টে কতটা ভালো ছিলাম আমরা।
প্রশ্ন :
৩৭ বছর আগে অলিম্পিকে গিয়ে কেমন দেখেছিলেন সবকিছু?
সাইদুর: তখন মাত্র ২১ বছরের তরুণ আমি। কার্ল লুইসের মতো বিখ্যাত অ্যাথলেটের সঙ্গে একই ভিলেজে ছিলাম। লুইসের সঙ্গে আমার ছবিও ছাপা হয় একটি পত্রিকায়। যেখানে ক্যাপশনে লেখা, ‘বিশ্বের এক নম্বরের সঙ্গে বাংলাদেশের এক নম্বরের সাক্ষাৎ’। বিশ্বের নামীদামি সব খেলোয়াড়ের সঙ্গে একই মাঠে অনুশীলন করেছি, একই ডাইনিংয়ে খেয়েছি, সে বিরাট এক ব্যাপার।
সেবার লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে ফিরেই আমি বলেছিলাম, আমরা অলিম্পিক থেকে ৫০ বছর পিছিয়ে আছি। এখন আরও পিছিয়েছে। কিন্তু তাই বলে সারা জীবন পিছিয়ে থাকতে পারি না।
প্রশ্ন :
লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস পত্রিকা ওই সময় আপনার ওপর বিরাট এক প্রতিবেদন করেছিল তাদের প্রথম পাতায়, যার শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশ পুটস ফাস্টেস ফুট ফরোয়ার্ড’। সঙ্গে গেমসের উদ্বোধনীতে বাংলাদেশের পতাকা হাতেসহ একাধিক ছবি ছাপা হয় প্রথম পাতায়...
সাইদুর: হ্যাঁ, ওই প্রতিবেদনের পর আমাকে নিয়ে বিরাট সাড়া পড়ে যায়। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাই। গেমস ভিলেজে তো বটেই, এমনকি বাইরেও লোকে আমাকে অভিনন্দন জানায়। আমি যেখানে যাই অটোগ্রাফ দিতে হয়, এমন একটা অবস্থা। লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস লিখেছিল, ‘বাংলাদেশ থেকে প্রথম কোনো অ্যাথলেট এসেছে অলিম্পিকে’...‘অনলি ওয়ান অ্যাথলেট ফ্রম বাংলাদেশ’...এমন কথাই তারা লিখেছিল। আমাকে সাধুবাদ জানানো হয় প্রতিবেদনে।
প্রশ্ন :
কিন্তু অলিম্পিকে বাংলাদেশের অ্যাথলেটরা আজও অনেকটা যাওয়ার আনন্দেই যান। এটা কেমন লাগে?
সাইদুর: দুঃখ লাগে। সেবার লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে ফিরেই আমি বলেছিলাম, আমরা অলিম্পিক থেকে ৫০ বছর পিছিয়ে আছি। এখন আরও পিছিয়েছে। কিন্তু তাই বলে সারা জীবন পিছিয়ে থাকতে পারি না। দুঃখজনক হলেও আমরা অলিম্পিক মানের চেয়ে যোজন যোজন পিছিয়ে। প্রবাসে বসে এটা ভাবলে ভীষণ খারাপ লাগে।
প্রশ্ন :
এই যোজন যোজন পিছিয়ে থাকার কারণ কী মনে হয়?
সাইদুর: অলিম্পিক দূরে থাক, অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ভালো করতে আমাদের আজও একটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেই। দেশে নেই সুনির্দিষ্ট কোনো ক্রীড়া নীতিমালা। আমরা আগে ভাবতাম, ভারত, পাকিস্তান যেন আমাদের ওপরে যেতে না পারে। কিন্তু আজ ওরা অনেক এগিয়ে গেছে। ভারতের টোকিও অলিম্পিকের প্রস্তুতি শুরু হয় চার থেকে পাঁচ বছর বছর আগে। অথচ আমাদের অ্যাথলেট জহির রায়হানের প্রস্তুতি মাত্র মাসখানেকের। এই ছেলেটা টোকিওতে দৌড়ে দেশে আসার পর আপনারা লিখবেন, ‘এই দেখুন, প্রথম রাউন্ডেই বাদ পড়েছে’। এক মাস আগে প্রস্তুতিতে নেমে কী আশা করা যায়! ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে একজন ভালো অ্যাথলেট আসে না, এটা চরম হতাশার। আমরা স্প্রিন্টে ভালো করতে পারতাম। তাহলে স্প্রিন্টার খুঁজে আনি না কেন? আসলে এসব নিয়ে ভাবার লোক কোথায়? সঠিক জায়গায় সঠিক লোক বসতে হবে।
প্রশ্ন :
প্রবাসে বসে দেশের অ্যাথলেটিকস কেমন দেখেন?
সাইদুর: আমাদের সময় দেশের অ্যাথলেটিকস ভালোই ছিল। এখন তো নিঃস্ব। দেশে ভালো অ্যাথলেট নেই। ভালো প্রস্তুতি নেই। আমরা অনেক বছর সাফ গেমসে (বর্তমান নাম এসএ গেমস) গিয়ে কিছু পাই না। এটা লজ্জার কথা। অথচ সাফ গেমসে আমরা ভালো করেছি। শাহ আলম, বিমলরা সাফে ১০০ মিটারে সোনা জিতেছে। সাফে আমরা সোনা জয়ের কথা ভেবেছি। সাফ গেমসেই যেখানে আমাদের খাবি খাওয়া অবস্থা, অলিম্পিক তো দূর কল্পনা।
প্রশ্ন :
আজকের অ্যাথলেটদের সামনে কোনো আদর্শ নেই। আপনি, শাহান উদ্দিন, শাহজালাল মবিন, সাইদুর রব, বিমল চন্দ্র তরফতাররা দেশান্তরি হলেন। শাহ আলম, মাহবুব আলম মারা গেলেন সড়ক দুর্ঘটনায়। আপনারা নতুন অ্যাথলেট তৈরিতে কোনো ভূমিকা রেখেছেন?
সাইদুর: কয়েক বছর আগে দেশে সামার গেমস করা যাচ্ছিল অর্থাভাবে না। আমরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে টাকা পাঠাই সেই প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে। অথচ এক–দুটি পত্রিকা মাত্র তিন থেকে চার লাইন লিখল। অ্যাথলেটদের জন্য আমি ব্যক্তিগত কিছু অর্থ পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু পরে দেখলাম আমার নামও বলে না কেউ। এতে হতাশ হই। তবে আমি দেশে যত দিন ছিলাম, ভালোভাবেই অ্যাথলেটিকসে সেবা করেছি। বাংলাদেশে অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য, অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক ছিলাম। অথচ দেখুন, বাংলাদেশের প্রথম অলিম্পিয়ান জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পর্যন্ত পায়নি।
প্রশ্ন :
কিন্তু গণহারে দেশসেরা অ্যাথলেটদের দেশ ছাড়ার ফলে তাঁদের অনেকে গায়ে লেগে আছে পালিয়ে যাওয়ার অপবাদ। কী বলবেন?
সাইদুর: জীবনের তাগিদেই যে যার পথ বেছে নিয়েছে। এ নিয়ে আমার বলার কী আছে! আমি তো ১৯৮৬ সালে খেলার ছাড়ার অনেক পর ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আসি।
প্রশ্ন :
সাফ গেমসে আপনারা রিলেতে সোনা জয়ের পর আর আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় এই ইভেন্টে সোনা পায়নি বাংলাদেশ। কেমন লাগে ভাবলে?
সাইদুর : খুবই খারাপ। ১৯৮৪ সালে কাঠমান্ডুতে প্রথম সাফ গেমসে ৪ গুণিতক ১০০ মিটার রিলেতে সোনা জয়ী বাংলাদেশ দলের গর্বিত সদস্য ছিলাম। ১৯৮৫ ঢাকা সাফ গেমসেও আমরা একই ইভেন্টে সোনা জিতি। পাকিস্তানে ইন্টারন্যাশনাল গেমসে ৪ গুণিতক ১০০ মিটার রিলেতেও সোনা আসে। ৮৪ সালের রিলে দলে ছিলাম আমি, মজিবর রহমান মল্লিক, শাহ আলম ও আফতাব মোল্লা। ১৯৮৫ সালের রিলেতে আমি, আনোয়ার হোসেন, শাহ আলম ও শাহজালাল মবিন। পাকিস্তানে আমি, আনোয়ার হোসেন, শাহ আলম ও শাহ জালাল মবিন। ১৯৮৪-৮৬ পর্যন্ত বাংলাদেশের টিম ক্যাপ্টেন ছিলাম। আমরা খেলা ছাড়ার পর আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের কেউ রিলেতে সোনা পায়নি। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় দ্বিতীয় সাফ গেমসে রিলেতে আমাদের গোল্ড মেডেল দেখার জন্য মাঠে ছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সবই আজ অতীত। তবে খারাপ লাগে আমাদের কোনো উন্নতি না হওয়ায়, বরং অবনতিই হয়েছে অনেক।