ভার তুলে জীবন বদলে গেল মারজিয়ার

মারজিয়াছবি: প্রথম আলো

জন্মের সময় রুবিনা আক্তার মেয়ের নাম রেখেছিলেন ইকরা। আরবি শব্দটির অর্থ পড়ুন। কিন্তু পড়ার টেবিলের চেয়ে খেলাধুলা বেশি টানত মারজিয়া আক্তার ইকরাকে। মা–বাবা কখনোই চাইতেন না, মেয়ে খেলাধুলা করুক। কিন্তু বাড়ি থেকে লুকিয়ে জিমনেসিয়ামে যেতেন ভারোত্তোলন শিখতে। আর সেই ভারোত্তোলন খেলেই বদলে গেছে মারজিয়ার জীবন।

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ জিমনেসিয়ামে গতকাল শুরু হয়েছে জাতীয় ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপ। প্রথম দিন অভিজ্ঞ ভারোত্তোলকদের ছাপিয়ে সব আলো কেড়ে নিলেন মারজিয়া। মেয়েদের ৪৯ কেজি ওজন শ্রেণিতে রেকর্ড গড়ে সোনা জিতেছেন। স্ন্যাচে ৫৫ কেজি তোলার পর মারজিয়া ক্লিন অ্যান্ড জার্কে তোলেন রেকর্ড ৭৬ কেজি ওজন। সব মিলিয়ে ১৩১ কেজি ওজন তুলে সোনা জেতেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভারোত্তোলক মারজিয়া।

মারজিয়া
ছবি: প্রথম আলো

২০১৯ সালেও এই ইভেন্টে সোনা জিতেছিলেন। বাংলাদেশ গেমস ও যুব গেমসে জিতেছেন রুপা। কিশোরগঞ্জের মেয়ে মারজিয়াকে শুরুতে খেলতে দিতে চাইতেন না বাবা শহীদুল ইসলাম। সেই কষ্টের কথাগুলো বলছিলেন মারজিয়া, ‘মা–বাবা কেউই চাইতেন না যে আমি খেলাধুলা করি। বাবা বাজারে গেলে লোকে ডেকে ডেকে বলত, “তোমার মেয়ে ছেলেদের পোশাক করে খেলতে যায়। এগুলো ঠিক না।” বাবা বাড়িতে এসে আমাকে বকাবকি করতেন।’

বাবার বকুনি আর শাসনও দমিয়ে রাখতে পারেনি মারজিয়াকে। মাকে বুঝিয়ে চুপিসারে চলে যেতেন জিমনেসিয়ামে, ‘ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘুম থেকে উঠে মায়ের সব কাজে সাহায্য করতাম। ঘরের সব কাজ করে রান্না সারতাম; যাতে মা আমার কাজ দেখে খুশি হয়, আমাকে যেন রাগ না করে, এ জন্যই এসব করতাম। এরপর বোরকা পরে বেরিয়ে যেতাম ঘর থেকে। ব্যাগের মধ্যে স্কুলের ড্রেসও নিয়ে যেতাম। এরপর সকালে অনুশীলন শেষে স্কুলে যেতাম। বিকেলে স্কুল শেষ করে কোচিং করার পর রাতে বাসায় ফিরতাম।’

মারজিয়া
ছবি: প্রথম আলো

মারজিয়ার খেলার প্রতি আগ্রহ দেখে বড় ভাই মাহফুজুর রহমান সম্মতি দেন অনুশীলনে যাওয়ার। পাশাপাশি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক অ্যাথলেট আজহারুল ইসলামও দায়িত্ব নেন মারজিয়ার। কিশোরগঞ্জের আজহার ভারোত্তোলন একাডেমিতে ভর্তি করে নেন মারজিয়াকে। মারজিয়ার অভিভাবকদের আজহারুল বুঝিয়েছিলেন, মেয়ে ভালো খেললে সেনাবাহিনীর চাকরি হবে। ভবিষ্যৎও উজ্জ্বল হবে।

মারজিয়ার নির্মাণশ্রমিক বাবার চার সন্তানের বড়সড় সংসার চালাতে তখন হিমশিম খাওয়ার মতো অবস্থা। গত দুই বছর সেনাবাহিনীর চুক্তিভিত্তিক খেলোয়াড় হিসেবে খেলেছেন মারজিয়া। এ বছরের শুরুতে স্থায়ী চাকরি হয়েছে সেনাবাহিনীতে।

এখন আমাকে দেখলে বলে, এই মেয়েটা আমাদের এলাকার গর্ব।
মারজিয়া আক্তার

খেলাধুলায় মেয়েদের আনার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা এই সার্ভিসেস সংস্থার প্রতি কৃতজ্ঞ মারজিয়া, ‘সেনাবাহিনীর স্যারদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। বিশেষ করে কোচ সুলতানা শারিয়ার প্রতি। দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বাবার হাতে চাকরির টাকা তুলে দিতে পারছি, বাবার সংসারে সাহায্য করতে পারছি—এই ভেবে আমি খুব খুশি। সেনাবাহিনীর চাকরি হওয়ার পর আমার জীবনটাই বদলে গেছে। আমি এখানে থেকে পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে পারব।’

যাঁরা মারজিয়াকে দেখলে নেতিবাচক কথা বলতেন, তাঁরাও এখন প্রশংসা করেন, ‘যারা বাবার কাছে আমার সম্পর্কে খারাপ কথা বলত, তারাও এখন আমাকে দেখলে বলে, এই মেয়েটা আমাদের এলাকার গর্ব। অন্যরাও এখন ভারোত্তোলনে আসতে চায় আমাকে দেখে।’

ভারোত্তোলন খেলে জীবন বদলে গেছে দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা এসএ গেমসে সোনাজয়ী অ্যাথলেট মাবিয়া আক্তারের। মারজিয়া তাই মাবিয়াকেই আদর্শ মানেন। স্বপ্ন দেখেন একদিন এসএ গেমসে সোনা জেতার, ‘কে না চায় মাবিয়া আপুর মতো হতে? আমিও একদিন এসএ গেমসে সোনা জেতার স্বপ্ন দেখি। হতে চাই মাবিয়া আপুর মতো।’