ভঙ্গুর জিমন্যাস্টিকসে কোরিয়ান স্বপ্ন
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পুরোনো জিমনেসিয়ামে এখন রোজ সকাল-বিকেল এক বিদেশির দেখা মেলে। ছোটখাটো গড়ন হলেও ৭৩ বছর বয়সেও শরীর বেশ শক্তপোক্ত। নিজের কাজে ভীষণ মনোযোগী। পাশেই একটা ফ্ল্যাটে থাকেন বলে শুক্রবার ছুটির দিনেও চো সুং ডং চলে আসেন জিমনেসিয়ামে। তাঁর নাকি বসে থাকতে ভালো লাগে না। ভালো লাগে এখন বাংলাদেশের কিশোর-তরুণদের জিমন্যাস্টিকস শেখাতে।
দক্ষিণ কোরিয়ার নামী এই কোচ গত ২৭ এপ্রিল ঢাকায় এসেছেন। ১৯৮২ সালের পর এই প্রথম কোনো বিদেশি কোচ এনেছে বাংলাদেশ জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশন। মাসিক তিন হাজার ডলার বেতনে আপাতত এক বছরের চুক্তি। অল্প কদিনেই তাঁর কাজে ফেডারেশন সন্তুষ্ট। বাংলাদেশের সঙ্গে চোয়ের গাঁটছড়া তাই লম্বা হতে পারে। দুই পক্ষের আস্থা আর ভালোবাসা কত দিন অটুট থাকে, তার ওপরই অবশ্য নির্ভর করবে চূড়ান্ত ভবিষ্যৎ।
আপাতত আগামী জুলাই-আগস্টে ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে কমনওয়েলথ গেমস ও আগস্টে তুরস্কে ইসলামিক সলিডারিটি গেমসের জন্য জাতীয় দল তৈরি করছেন চো। এই দুটি গেমসে তিনজন করে জিমন্যাস্ট পাঠাবে বাংলাদেশ।
চো সুং ডংয়ের বৃহত্তর লক্ষ্য বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৮ দলকে ভবিষ্যতে বিশ্বমঞ্চে নিয়ে যাওয়া। সেই প্রতিশ্রুতিই তিনি দিয়েছেন বলে জানালেন বাংলাদেশ জিমন্যাস্টিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আহমেদুর রহমান, ‘আমাদের অনূর্ধ্ব-১৪ থেকে অনূর্ধ্ব-১৮ গ্রুপটাকে চো ভালোভাবে ধরেছেন। যাতে আগামী দুই বছর পর আমরা আন্তর্জাতিক মানে চলে আসি। তাঁর মূল কাজ সেটাই। তিনি আমাদের কথা দিয়েছেন, আগামী তিন বছরের মাথায় বাংলাদেশকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে কোয়ালিফাই করাবেন। সেটা হলে আমরা অলিম্পিকে খেলার সুযোগ পাব।’
বাংলাদেশকে অলিম্পিকে শুধু নিয়ে যাওয়াই নয়, রীতিমতো পদক এনে দেওয়ার স্বপ্নের কথাও ঢাকায় এসে শুনিয়েছেন চো। এক মাসের বেশি প্রশিক্ষণ চালিয়ে দিন তিনেক আগে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে এই প্রতিবেদকেও তিনি বলেন, ‘দুই-তিন মাসে আমি কিছু করতে পারব না। তাই কমনওয়েলথ আর ইসলামিক গেমস নিয়ে তেমন আশা নেই। তবে চার বছর সময় পেলে অলিম্পিকে নিয়ে যাব বাংলাদেশকে এবং পদকও আনব, এটা বলতে পারি।’
চোয়ের ভাষায় বাংলাদেশের জিমন্যাস্টদের বর্তমান অবস্থা ‘ভেরি পুওর’। তাহলে তিনিই আবার কীভাবে এত বড় আশায় বুক বাঁধছেন? চো উদাহরণ টানেন নিজ দেশের, ‘আমি দক্ষিণ কোরিয়ার খেলোয়াড় থাকার সময় আমাদের দেশের জিমন্যাস্টিকসের অবস্থাও খারাপ ছিল। সেই কোরিয়া আজ অলিম্পিকে সোনা জেতে। সেটা সম্ভব হয়েছে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়ায়। বাংলাদেশও তেমন পরিকল্পনা নিলে অলিম্পিকে খেলতে পারবে এবং পদক জিতবে।’
কোচ হিসেবে অলিম্পিক এবং এশিয়ান গেমসে সোনা জয়ের অভিজ্ঞতা আছে চোয়ের। সেই অভিজ্ঞতার জোরেই আশা দেখাচ্ছেন বাংলাদেশকে। গোপনীয়তা বজায় রাখতে খেলোয়াড়দের অনুশীলনের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার না করতে ফেডারেশনকে অনুরোধ করেছেন।
অবশ্য বাংলাদেশে জিমন্যাস্টিকসের কোনো অবকাঠামোই যেখানে নেই, এই দেশের অনুশীলন দেখে অন্যদের আর কতটুকুই-বা লাভ হবে! বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা জিমন্যাস্টিকসে আসেই অনেক দেরিতে। দেশে জিমন্যাস্টের সংখ্যাও হাতে গোনা, নেই জিমন্যাস্টিকসের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধাও। সামান্য সরঞ্জাম যা আছে, সেগুলো নিয়ে অনুশীলন করতে হয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের উনুনের মতো গরম জিমনেসিয়ামে। এখন তো সেটাও পুরোপুরি সম্ভব হচ্ছে না।
ক্রীড়া পরিষদের জিমনেসিয়ামে কুস্তি ও তায়কোয়ান্দোও অনুশীলন করায় অল্প একটু জায়গায় কোনোমতে অনুশীলন চলছে জিমন্যাস্টদের। সম্প্রতি কুস্তিকে জিমনেসিয়াম ছাড়তে বলেছে ক্রীড়া পরিষদ। কিন্তু ‘আমরা কোথায় যাব’ প্রশ্ন তুলে জিমনেসিয়াম ছাড়েনি কুস্তি। এ কারণে জিমন্যাস্টিকসের ভল্টিং টেবিলের জন্য ২৫ মিটার রানিং ম্যাট বসানো যাচ্ছে না। জায়গা খুবই অল্প হওয়ায় আনইভেন বার, ব্যালান্স বিমের সরঞ্জাম গুটিয়ে রাখা হয়েছে। শুধু পমেল হর্সটাই কোনোভাবে করা যাচ্ছে।
দেশের জিমন্যাস্টিকসের চিত্র যেখানে এতটা করুণ, সেখানে পদক জয় দূরের কথা, অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার স্বপ্নটাকেই আকাশকুসুম কল্পনা মনে হয়। কিন্তু চো যেন স্বপ্ন দেখতেই ভালোবাসেন।