২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরের এক সকাল। যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে এলথ্যাম এলাকায় অস্থিরভাবে অপেক্ষায় ২২ বছর বয়সী জন ম্যাকাভয় ও তাঁর সঙ্গী। তাঁদের অপেক্ষা একটি সিকিউরিটি গাড়ির জন্য। যে গাড়িতে আছে ১ লাখ পাউন্ড। অর্থটা স্থানীয় এক ব্যাংকের। অস্ত্রে সজ্জিত ম্যাকাভয় ও তাঁর সঙ্গীর লক্ষ্য ওই অর্থ লুটে নেওয়ার।
ভাগ্যটা সেদিন ভালো ছিল না ম্যাকাভয়দের। ম্যাকাভয় জানতেন না তাঁর সঙ্গী কেভিন ব্রাউনের ওপর আগে থেকেই নজরে রেখেছে পুলিশ। প্রায় মাসখানেক ধরেই লন্ডনের পুলিশ তক্কে তক্কে ছিল ব্রাউনকে হাতেনাতে ধরার।
টাকাভর্তি সেই গাড়িটি কাছে আসতেই ব্রাউন নেমে যান কাজে। ম্যাকাভয়কে নিজেদের গাড়িতে রেখে অস্ত্র হাতে চলে যান টাকাভর্তি গাড়িটির কাছে। ওই সময়েই ম্যাকাভয়ের চোখে পড়ে নীরবে এগিয়ে আসা পুলিশের এক গাড়ি। পুলিশ এসে ব্রাউনকে তো আটক করলই, তাঁরা ধরতে চাইল ম্যাকাভয়কেও। সহজে অবশ্য ধরা দিতে চাননি ম্যাকাভয়, কেই-বা জেলে পচে মরতে চায়। গাড়ি নিয়ে পালাতে গিয়ে ভুল করে অন্ধ এক গলিতে ঢুকেই সর্বনাশ। পালানোর কোনো উপায়ই ছিল না তাঁর।
এরপর যা হলো সেটিই বদলে দিল ম্যাকাভয়ের জীবন। ওই ঘটনা নতুন করে প্রমাণ দিল খেলাধুলা মানুষের জীবন কতটা বদলে দিতে পারে। খেলাধুলা কোনো মানুষের জীবনে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে সেটিরই অন্যতম বড় উদাহরণ হতে পারে ব্রিটিশ এই ট্রায়াথলেটের জীবনকাহিনি।
ম্যাকাভয়ের বয়স তখন ২৪, ডাকাতির অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়ে যায় তাঁর। ১৮ বছর বয়সে এক বছর জেলে পার করেছিলেন। ডাকাতি করে দ্বিতীয়বার ধরা পড়ায় জেলের নিঃসঙ্গ সেলেই জায়গা মেলে ম্যাকাভয়ের। আর জেলের ওই নিঃসঙ্গ কক্ষটাই বিশ্ব রেকর্ড উপহার দিয়েছে ম্যাকাভয়কে, তাঁকে বানিয়েছে ক্রীড়াবিদ। আর সবচেয়ে বড় কথা ম্যাকাভয়কে ভালো মানুষও বানিয়ে দিয়েছে ওই নিঃসঙ্গ কুঠুরি।
জেলজীবনের একঘেয়েমি ঘোচাতেই নিয়ম করে শরীরচর্চা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ম্যাকাভয়। ওই শরীরচর্চা করতে গিয়েই নিজের নৌকা বাইচ বা রোয়িং সত্তা আবিষ্কার করেন তিনি। বন্দী অবস্থাতেই রোয়িং মেশিনে বসে রোয়িং অনুশীলন শুরু করেন। তা করতে করতেই রোয়িং মেশিনের তিনটি বিশ্ব রেকর্ড ভেঙে ফেলেন ম্যাকাভয়।
২০১২ সালে ম্যাকাভয় যখন প্যারোলে জেল থেকে বেরোলেন চোখে স্বপ্ন বাস্তবের রোয়িংয়ে ক্যারিয়ার গড়ার। অলিম্পিকে ব্রিটেনের প্রতিনিধিত্ব করার স্বপ্নও ছিল তাঁর। কিন্তু কিছুদিন পরই বুঝতে পারেন বয়সটা একটু বেশিই হয়ে গেছে। তাই ওই স্বপ্ন ছেড়ে যোগ দেন ট্রায়াথলনে। পেশা হিসেবেই বেছে নেন দৌড়, সাইক্লিং ও সাঁতার—এই তিন ইভেন্ট মিলে গড়া ট্রায়াথলনে। সেই খেলার অন্যতম তারকাও তিনি এখন।
ম্যাকাভয়ের বয়স এখন ৩৬। কিছুদিন আগে অলিম্পিক চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নিজের কলঙ্কিত অতীত নিয়ে কী অকপটেই না কথা বলেছেন। ম্যাকাভয়দের পারিবারিক ইতিহাসই অবশ্য কলঙ্কিত। জন্মের আগেই মারা যান তাঁর বাবা। তাঁর চাচা মিকির নাম জড়িত ব্রিটেনের ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত ডাকাতির ঘটনায়। ১৯৮৩ সালে লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরের কাছে এক গুদাম থেকে প্রায় আড়াই কোটি পাউন্ডের সোনা ও হীরা চুরি করেন মিকিরা।
ম্যাকাভয়ের মা পরে বিয়ে করেন বিলি টবিন নামের অপরাধজগতে নাম কেনা এক লোককে। ম্যাকাভয়ের বয়স যখন আট তখনই তাঁকে নিজের শিষ্য বানিয়ে নেন টবিন। ম্যাকাভয়কে কথার ফাঁদে ফেলেছিলেন টবিন। টবিন ম্যাকাভয়কে বুঝিয়েছিলেন তাঁর কথা মতো চললে ২১ বছর বয়সেই কোটি টাকার মালিক হয়ে যাবেন।
কিশোর বয়সেই একবার ডাকাতি করতে গিয়ে ভুয়া অস্ত্রসহ ধরা পরে জেলে যেতে হয় ম্যাকাভয়কে। এরপর ২০০৫ সালের ওই ডাকাতির ঘটনা আর যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া। পারিবারিক ইতিহাসকে মনে রেখেই হাইসিকিউরিটি জেলে বন্দী রাখা হয় তাঁকে।
ওই জেলে গিয়েই মানসিকতায় পরিবর্তন আসে ম্যাকাভয়ের, ‘তরুণ বয়সে যা করেছি সবকিছুর জন্য অনুতপ্ত হতে থাকলাম। আমি সব সময়ই নিজের পরিণতির জন্য শুধু নিজেকেই দায়ী করেছি। আমি যা করেছি নিজের ইচ্ছেতেই করেছি, কেউ আমাকে বাধ্য করেনি। আমার দুঃখ হতো। ভাবতে লাগলাম আমার মতো বাজে জীবন যেন অন্য কেউ বেছে না নেয়।’
তবে ১০ বছরের জেল খাটা নিয়ে কোনো দুঃখ নেই ম্যাকাভয়ের, ‘জেলে যে ১০ বছর কাটিয়েছি তা নিয়ে আমার কোনো দুঃখ নেই। এখানেই তো আমি মানুষ হয়েছি। এখানেই আমার মানসিকতার পরিবর্তন এসেছে। জীবন নিয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গিই বদলে দিয়েছে জেল।’
কারাকক্ষে বসে কীভাবে জীবনটা বদলে গেল তা শোনা ম্যাকাভয়ের মুখেই, ‘কারাগারে বসে একদিন মনে হলো এই ৮ ফুট বাই ১২ ফুট কক্ষে আমাকে এতটা সময় কাটাতে হবে। তখন ভাবতে থাকলাম কীভাবে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া যায়। আমি নিজেকে সতেজ দেখতে চাইলাম ও কিছু শরীর চর্চা শুরু করলাম। বার্পিস, প্রেস আপস, স্টেপ আপস, সিট আপস এগুলো করা শুরু করলাম নিয়ম করে।’
আরেকটি ঘটনাও প্রভাব ফেলে ম্যাকাভয়ের জীবনে। কারাদণ্ডের তৃতীয় বছরে জেলে বসেই একদিন খবর পান তাঁর সবচেয়ে কাছের বন্ধু নেদারল্যান্ডসে এটিএম বুথ লুট করে পালানোর সময় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। জীবন কত মূল্যবান সেটি ওই সময়েই বুঝেছেন ম্যাকাভয়, ‘ওই খবর পাওয়ার পরদিন যখন ঘুম থেকে উঠলাম আমি পুরোপুরি উদ্ভ্রান্ত। সবকিছুই অর্থহীন মনে হলো। নিজের দিকে তাকালাম। ভাবলাম জীবনটাকে এভাবে নষ্ট করার মানে নেই। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম—এভাবে জীবনযাপন এখানেই শেষ।’
ওই সময়ে একদিন ম্যাকাভয় ইনডোর রোয়িং মেশিনের সন্ধান পান জেলে। রোয়িংয়ের কোনো চ্যালেঞ্জে অংশ নিলে একটু বেশি সময় সেখানে কাটানোর সুযোগটাও নেন তিনি। শুরুতে জেলাখানার প্রতিযোগীদের মধ্যে সবার ওপরে নাম থাকত তাঁর। পরে কারারক্ষী ড্যারেন ডেভিড কোচিং করানো শুরু করেন ম্যাকাভয়কে। বিশ্ব রেকর্ডগুলো এরপরই গড়েন তিনি।
জেল থেকে বের হয়ে পেশাদার রোয়ার হতে চেয়েছিলেন ম্যাকাভয়। কিন্তু বয়সটা একটু বেশি হয়ে যাওয়ায় সেটি আর করা হয়নি। দমে না গিয়ে ম্যাকাভয় এরপর ট্রায়াথলনে মন দেন। সেখানেও ভালো করে নাইকির মতো প্রতিষ্ঠানের স্পনসরশিপও জোগাড় করে নেন। জেল থেকে বের হওয়ার পর কিছুদিন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী দপ্তর ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে চাকরিও করেন ম্যাকাভয়।
অলিম্পিক চ্যানেল ম্যাকাভয়ের কাছে জানতে চেয়েছিল জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন কী। উত্তরটা সংক্ষেপেই দিয়েছেন তিনি, ‘বেঁচে থাকা। কত মানুষ গত রাতে বিছানায় গিয়ে আর জেগে ওঠেননি। তাই আমার কাছে বেঁচে থাকাটাই হলো জয় ও সুখ।’