২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বাসের সবাই তাকিয়ে ছিল মাহফুজার দিকে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন মাহফুজা খাতুন। ছবি: সংগৃহীত
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন মাহফুজা খাতুন। ছবি: সংগৃহীত
>ক্রিকেট, ফুটবলের বাইরে অন্য খেলাগুলোতেও আছেন অনেক বড় তারকা । সাফল্যের আলো জ্বেলেই নিজেদের অঙ্গনে আলোকিত তাঁরা । ছোট খেলার সেই সব বড় তারকাদের নিয়েই এই ধারাবাহিক। আজ শেষ পর্বে থাকছে সাঁতারু মাহফুজা খাতুনের তারকা হওয়ার গল্প—

গভীর রাতে আকাশের দিকে চেয়ে কত কি যে ভাবেন মাহফুজা খাতুন। কেমন করে বদলে গেল জীবন!যশোরের নওয়াপাড়া থেকে উঠে আসা মেয়েটি কিনা আজ বাংলাদেশের মেয়েদের খেলাধুলার একজন 'আইকন'! গত কয়েক বছর ধরে নারী দিবসের অনুষ্ঠানে সব আলো কেড়ে নেন সাঁতারু মাহফুজা । প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে খেলোয়াড়েরা দেখা করতে গেলেও সাহস করে কথা বলতে হয় তাঁকেই। বাংলাদেশের মেয়েরা সাঁতার পুলে নেমেই প্রথম যে কথাটা বলে, 'আমি শিলা (মাহফুজা) আপুর মতো হতে চাই ।' 

বুড়িয়ে যাওয়ার অপবাদে ফেডারেশন যখন তাঁকে ছুঁড়ে ফেলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন এগিয়ে আসেন সাঁতারের তখনকার কোচ পার্ক তে গুন । ২০১৬ সালে ভারতের গুয়াহাটি এসএ গেমসে মাহফুজাকে এক রকম জোর করেই নিয়ে যান এই কোরিয়ান কোচ। গুয়াহাটির হারুহজাই স্পোর্টস কমপ্লেক্সে সেই মাহফুজার সুবাদেই বেজে ওঠে 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি ।' তাও একবার নয়, দু বার।

এসএ গেমসের পদক গলায় উচ্ছ্বসিত মাহফুজা খাতুন। ছবি: প্রথম আলো
এসএ গেমসের পদক গলায় উচ্ছ্বসিত মাহফুজা খাতুন। ছবি: প্রথম আলো

গেমসের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের কোনো নারী সাঁতারু জিতেছিলেন সোনার পদক । এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় মাহফুজা সব মিলিয়ে জিতেছেন পাঁচটি সোনা। এর মধ্যে ভারতের এসএ গেমসেই দুটি। বাকি তিনটি ইন্দো-বাংলাদেশ গেমসে। এছাড়া এসএ গেমসে ২টি রুপা ও ২টি ব্রোঞ্জ জেতেন মাহফুজা। জুনিয়র অ্যাকুয়াটিকস চ্যাম্পিয়নশিপে জিতেছেন রুপার পদক। ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় নিজের ইভেন্টে প্রায় দেড় যুগ ধরে সেরা। ২০০৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত টানা জিতেছেন সোনার পদক। জাতীয় ও জুনিয়র প্রতিযোগিতা মিলিয়ে সংখ্যাটি ৪৮।

দিল্লি ও গ্লাসগো কমনওয়েলথ গেমস, গুয়াংজু এশিয়ান গেমস, দুবাই ও বার্সেলোনায় বিশ্ব সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপ এবং বাকুতে ইসলামিক সলিডারিটি গেমসে অংশ নিয়েছেন মাহফুজা । আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) আমন্ত্রণে বিশেষ সেমিনারে অংশ নিতে গিয়েছিলেন গ্রিস ও কলম্বোতে। ভারত সরকারের আমন্ত্রণে খেলোয়াড়দের প্রতিনিধি হয়ে ঘুরে এসেছেন ভারতের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান। সর্বশেষ এসএ গেমসে কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশের পতাকা বাহক ছিলেন এই মাহফুজাই।

বিকেএসপির ছাত্রী মাহফুজা স্নাতকোত্তোর করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে। খেলাধুলা না করলে নাকি সাংবাদিকতা পেশাকেই বেছে নিতেন, 'সাংবাদিকতা খুব ভালো লাগে । এজন্যই পড়াশোনার জন্য বেছে নিই বিষয়টি। এখনও আমাদের অনেক শিক্ষক বলেন, তুই সাংবাদিকতা করলেই পারতিস।'

নেপালের কাঠমান্ডুতে মাহফুজা খাতুন। ছবি: সংগৃহীত
নেপালের কাঠমান্ডুতে মাহফুজা খাতুন। ছবি: সংগৃহীত

নারী দিবস উপলক্ষ্যে গত মার্চে গ্রামীণফোন মাহফুজাকে নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছিল। নারী দিবসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে টেলিভিশনেও তাকে নিয়ে তৈরি হয়ে নানা প্রামাণ্যচিত্র। এসএ গেমসে সোনা জয়ের পর জাতীয় সংসদে মাহফুজাকে অভিনন্দন জানানোর জোয়ার বয়ে গিয়েছিল। সেই দিনটা মাহফুজার জীবনের স্মরণীয় হয়ে থাকবে সবসময়, 'ওই সময় ক্রীড়া উপমন্ত্রী জয় ভাই (আরিফ খান) সংসদে আমাকে নিয়ে কবিতা পাঠ করেন । এরপর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সবাই সংসদে সোনা জেতায় আমাকে অভিনন্দন জানান। ক্রিকেটের বাইরে আর কাউকে নিয়ে এভাবে সংসদে আলোচনা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় দিন সেটা।'

সাঁতারুদের অনেকে মাহফুজাকে আদর্শ মানবেন, এটাই স্বাভাবিক। এর বাইরে সাধারণ মানুষের ভালোবাসায় কম পান না, 'বাড়ি গেলে আম্মার সঙ্গে বাজারে যাই । যে দোকানে যাই, আমাকে ঘিরে জটলা লেগে যায়। কে কার আগে আমার সঙ্গে কথা বলবে, ছবি তুলবে এই নিয়ে প্রতিযোগিতা। এমনও হয়েছে অনেক দোকানি আমাকে বিনামূল্যে জিনিসপত্র দিচ্ছেন। বলে, তুমি এটা নিলে আমরা খুশি হবো।'

অলিম্পিকের তীর্থভূমি গ্রিসে ভিনদেশি বন্ধুর সঙ্গে মাহফুজা খাতুন। ছবি: প্রথম আলো
অলিম্পিকের তীর্থভূমি গ্রিসে ভিনদেশি বন্ধুর সঙ্গে মাহফুজা খাতুন। ছবি: প্রথম আলো

একটা ঘটনা মনে করে সবসময়ই বেশ মজা পান মাহফুজা, 'তখন সবে এসএ গেমসে সোনা জিতেছি । বাসেই যাতায়াত করি। একদিন বাসে ওঠার পর, দেখি সবাই আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছে। আমাকে দেখছে। আমি খুব অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। একজন এসে বলল, আপু আপনি আমাদের গর্ব। এ কথা শুনে বাসের সবাই হাততালি দিতে শুরু করলো। ঘটনাটা কোনোদিন ভুলব না।'

ক্রিকেটারদের বাইরে অন্য খেলোয়াড়দের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ কমই হয়। তবে ব্যতিক্রম সম্ভবত মাহফুজা। তিনিই বলছিলেন, ' আমি আটবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছি । শুরুর দিকে আমাকে ডেকে হাসতে হাসতে বলতেন, তুমি এত প্রতিবাদী মেয়ে! এত সাহস কোথায় পাও। তোমার ভয় করে না?'

ভয়ের সঙ্গে লড়াই করেছেন বলেই তো অনন্যা হয়ে উঠেছেন মাহফুজা।