বাংলাদেশকে গর্বিত করা শাম্মীর কান্না কেউ শোনে না
খেলায় তো অনেকবারই জিতেছেন। কিন্তু জীবনের লড়াইয়ে কি হেরেই যাবেন তায়কোয়ান্দোর স্বর্ণকন্যা শাম্মী আক্তার! স্বামী সাইফুল ইসলামের অকালমৃত্যুর পর দুই শিশুসন্তান আবু হুরায়রা ও আবু হামজাকে নিয়ে কাটছে তাঁর মানবেতর জীবন।
গত ১৩ বছরে তায়কোয়ান্দোতে এসএ গেমসে সোনাজয়ী বাংলাদেশের চার খেলোয়াড়ের একজন এই শাম্মী। ২০১০ সালের গেমসে সোনা জেতেন। আছে ঘরোয়া অনেক সাফল্যও। টানা চারবার জাতীয় প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়েছেন। বাংলাদেশ আনসারের সাবেক এই খেলোয়াড় ঢাকায় কোরিয়ান কাপ তায়কোয়ান্দোয় জেতেন তিন সোনা। খেলেছেন ২০১০ গুয়াংজু এশিয়ান গেমস ও চেন্নাইয়ের কমনওয়েলথ তায়কোয়ান্দো চ্যাম্পিয়নশিপে। পেয়েছেন ব্ল্যাক বেল্ট উপাধিও।
খেলতে খেলতেই শাম্মীর পরিচয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিক ও তায়কোয়ান্দো খেলোয়াড় সাইফুলের সঙ্গে। পরিবারের সম্মতিতে ২০০৯ সালের ৫ জুন বিয়ে হয় তাঁদের। বিয়ের পরও দুজনেই খেলা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সমস্যার শুরু শাম্মীর ওজন কমানো নিয়ে। শুরুতে খেলতেন ৪৯ কেজি ওজন শ্রেণিতে। ওজন কমিয়ে ৪৬ কেজিতে খেলা শুরু। ওজন কমাতে গিয়ে দেখা দেয় শারীরিক নানা জটিলতা। একপর্যায়ে চিকিৎসকের পরামর্শে খেলা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন শাম্মী।
খেলা ছাড়লেও স্বামী-সংসার নিয়ে বেশ কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু কে জানত তাঁর জীবনে নেমে আসবে এমন বিপর্যয়! ২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট ঝিনাইদহে শাম্মীর শ্বশুরবাড়িতে ডাকাতের হাতে খুন হন সাইফুল। সন্তানদের নিয়ে অকূল পাথারে পড়েন শাম্মী।
সেনাবাহিনীর চাকুরে সাইফুলের পেনশনের জন্য শাম্মী যশোর সেনানিবাসে সশস্ত্র বাহিনী বোর্ডে আবেদন করেন। পেনশনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জোগাড় করতে করতে কেটে যায় ১৫ মাস। অবশেষে গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে স্বামীর পেনশনের সাত হাজার টাকা পাচ্ছেন। সন্তানদের জন্য সেনাবাহিনী দেয় বাড়তি চার হাজার টাকা। মাঝের এই সময়ে দুই সন্তান নিয়ে দিন কেটেছে অভাবে। লজ্জায় কারও কাছে হাত পাততে পারেননি। কান্নাভেজা কণ্ঠে শাম্মী বলছিলেন, ‘এমনও দিন গেছে, বাজার করার টাকা ছিল না। স্বামীর পেনশনের কাগজপত্র জোগাড় করতে অফিসে অফিসে ঘুরেছি পায়ে হেঁটে। রিকশাভাড়াও ছিল না। ছেলেদের এক ফোঁটা দুধ কিনে দিতে পারিনি। স্বামীর ব্যাচমেট বন্ধুরা মিলে আট হাজার টাকা দিয়েছিল। কিন্তু এই টাকায় কদিন চলে?’
বর্তমানে যশোর সেনানিবাসের কোয়ার্টারে থাকেন শাম্মী। আগামী মাসে কোয়ার্টার ছেড়ে দেওয়ার কথা ছিল। তবে শাম্মীর আবেদনের পর সেনাবাহিনী মেয়াদ বাড়িয়েছে এক বছর। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে দুশ্চিন্তায় ঘুম আসে না শাম্মীর, ‘বাসা ছেড়ে দিলে কোথায় গিয়ে উঠব? এত অল্প টাকায় সংসার চালাব কীভাবে?’
যশোর ক্যান্টনমেন্টের দাউদ পাবলিক স্কুলে শাম্মীর বড় ছেলেকে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ দিয়েছে সেনাবাহিনী। কিন্তু স্কুলের বেতন ছাড়াও তো খরচ আছে! সংসার চালাতে হিমশিম অবস্থা। তায়কোয়ান্দো ফেডারেশনের কাছে একাধিকবার ধরনা দিয়েও কোনো সহায়তা পাননি শাম্মী। তবে এসএ গেমসে সোনা জেতার পর পাঁচ লাখ টাকা পেয়েছিলেন। সেই টাকা কবেই ফুরিয়ে গেছে। শাম্মী বলেন, ‘ওই টাকাগুলো অসুস্থ মা-বাবার পেছনে খরচ করেছি। ভাইয়েরা মা-বাবার দায়িত্ব নেয় না। ওদের সংসারও আমাকেই চালাতে হয়।’
তবু দমে যেতে চান না এই স্বর্ণকন্যা। খেলায় আঘাত পেয়ে যেভাবে ঘুরে দাঁড়াতেন, সেভাবেই আবার ঘুরে দাঁড়াতে চান শাম্মী। হারতে চান না হারের আগে।