পর্দা নামল টোকিও অলিম্পিকের
১৭ দিনের উত্তেজনা, উৎকণ্ঠা, প্রত্যাশা আর আনন্দ-হতাশার শেষে উদ্বোধনী দিনের মতোই পরিমিত মাত্রার বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শেষ হলো ২০২০ টোকিও অলিম্পিক। ২৩ জুলাই টোকিওর যে জাতীয় স্টেডিয়ামে অগ্নিশিখা প্রজ্বালন করার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল টোকিও অলিম্পিকের, সেই একই স্টেডিয়ামে আজ রাতে অগ্নিশিখা নিভিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে এর সমাপ্তি টানা হয়।
২০২০ টোকিও অলিম্পিকের আয়োজন এক বছর পিছিয়ে যাওয়ার পরেও আদৌ এই আয়োজন বসবে কি না, তা নিয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সংশয় ছিল। নতুন করে নির্ধারিত সময়ে জাপানে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার হ্রাস না পেয়ে ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করলে অনেকেই মহামারিকালে সারা বিশ্বের ক্রীড়াবিদদের নিয়ে এই আয়োজন করতে যাওয়াটা আত্মঘাতী মনে করছিলেন।
তবে তা সত্ত্বেও জাপান সরকার এবং আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি আইওসিসহ অলিম্পিকের অন্য আয়োজকেরা বলা যায় ঝুঁকি নিয়ে তাদের সিদ্ধান্তে অটল থেকেছে। এমনকি জাপানের জনগণের বড় একটা অংশ যে গেমসের বিপক্ষে ছিলেন, সেটাও তারা পাত্তা দেয়নি।
আসলে অন্য কোনো পথ আয়োজকদের সামনে খোলাও ছিল না। আরও একবার স্থগিত করে দেওয়া মানে হতো, টোকিও অলিম্পিক একেবারেই না হওয়া। কারণ, অন্যান্য খেলাধুলার আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার সময়সূচি ইতিমধ্যে নির্ধারিত হয়ে যাওয়ায় নতুন সময়সূচি ঠিক করা আয়োজকদের পক্ষে আদৌ হয়তো সম্ভব হতো না। ফলে জাপান সরকার এবং জাপানের আয়োজক কমিটি চাইছিল, যেভাবেই হোক অলিম্পিক আয়োজন করতে।
আর এ কারণেই জাপানের নাগরিকদের আশ্বস্ত করতে দর্শক উপস্থিতি ছাড়া অলিম্পিক আয়োজন করার পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকদের জাপান আগমনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির মতো আর্থিক দিক থেকে ক্ষতিকর সিদ্ধান্ত আয়োজকদের গ্রহণ করতে হয়।
ফলে কেমন হবে এই অলিম্পিক, তা নিয়ে সন্দেহের কমতি ছিল না। তবে ১৬ দিন ধরে চলা অলিম্পিকের শেষে আয়োজকেরা তৃপ্তি বোধ করতেই পারেন, প্রায় সবদিক থেকেই সফলভাবে শেষ করা গেছে ২০২০ টোকিও অলিম্পিক।
শুরুর আগে এবং শুরু হয়ে যাওয়ার পর প্রথম কয়েক দিন পর্যন্ত টোকিওবাসীর মধ্যে অলিম্পিক নিয়ে নানা রকম সন্দেহ ছিল। তখন সংবাদমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়, ৬০ শতাংশের বেশি টোকিওবাসী চাইছেন না অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হোক।
তবে বিভিন্ন ইভেন্ট শুরু হয়ে যাওয়ার পর অলিম্পিক গতি পেতে থাকায় বিরোধিতাও কমতে থাকে। এর বড় কারণ হতে পারে, এবারের অলিম্পিকে স্বাগতিক দেশ জাপানের প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সাফল্য। খেলাধুলার প্রতিযোগিতা মানুষের মনে পরোক্ষে হলেও একধরনের জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগিয়ে তুলে, মানুষ যেখানে নিজের দেশ কিংবা অঞ্চলের সাফল্যে কেবল অনুপ্রাণিতই হয় না, একই সঙ্গে গর্ব বোধও করতে শুরু করে। জাপানের বেলাতেও হয়েছে তাই।
আসলে অন্য কোনো পথ আয়োজকদের সামনে খোলাও ছিল না। আরও একবার স্থগিত করে দেওয়া মানে হতো, টোকিও অলিম্পিক একেবারেই না হওয়া।
ঘরের ছেলেমেয়েদের আশাতীত সাফল্য জাপানের জনগণকে কেবল তৃপ্তিই দেয়নি, দেশ ও জাতিকে নিয়ে গর্ব করার অনুভূতিও জাগিয়ে তোলে। আর অবচেতন সেই জাতীয়তাবাদই অলিম্পিক বিরোধিতাকে প্রায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
অন্যদিকে করোনা সংক্রমণ জাপানে বৃদ্ধি পেতে থাকলেও সেই বৃদ্ধির পেছনে অলিম্পিকের তেমন কোনো ভূমিকা খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে অলিম্পিকবিরোধী অবস্থান থেকে সরে আসেন অনেকে। জাপানে দুই সপ্তাহ ধরে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দৈনিক হিসাব পাঁচ থেকে দশ হাজারের মধ্যে ওঠা–নামা করলেও জুলাই মাসের শুরু থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত অলিম্পিকের সঙ্গে সম্পর্কিত সংক্রমণের মোট সংখ্যা ছিল মাত্র ৪৩০।
ফলে এটাও টোকিওর মানুষকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বৃদ্ধি পেতে থাকা অবস্থায় অলিম্পিকের আয়োজন করা নিয়ে শঙ্কামুক্ত হতে সাহায্য করেছে।
১৬ দিন ধরে চলা প্রতিযোগিতায় জাপানের সাফল্যে অনেকেই এখন অভিভূত। ২৭টি স্বর্ণপদকসহ মোট ৫৮টি পদক জাপান এর আগে কখনো পায়নি। ফুটবলের মতো অল্প কয়েকটি খেলায় প্রত্যাশা পূরণ না হলেও পদকের সার্বিক হিসাব বলছে, অলিম্পিক নিয়ে জাপানিদের আনন্দ বোধ না করার কোনো কারণ নেই। ফলে অলিম্পিকের আয়োজনকে কেন্দ্র করে সরকারের যে সমালোচনা গেমস শুরু হওয়ার আগে হতে দেখা গেছে, সেটা এখন অনেকটাই স্তিমিত।
তবে তাই বলে খুব বেশি তৃপ্তি বোধ করার সুযোগও জাপান সরকারের নেই। কারণ, যে বিশাল অঙ্কের ব্যয় অলিম্পিকের আয়োজনের জন্য জাপান সরকারকে করতে হয়েছে, দর্শকবিহীন গেমসের আয়োজনের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকদের ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে এর ছোট অংশও উঠে আসার সম্ভাবনা নেই। বিশাল এই ব্যয়ের বোঝা সরকার কীভাবে সামাল দেবে, সেটা এখনো পরিষ্কার নয়।
ধারণা করা হচ্ছে, নানা রকম পরোক্ষ কর আরোপ ছাড়াও অন্যান্য খাতের ব্যয় কমানোর মাধ্যমে ভবিষ্যতে সরকার হয়তো এটা করার উদ্যোগ নেবে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সাধারণ নাগরিকেরা।
তবে আপাতত তা নিয়ে কেউ তেমন একটা ভাবছেন না। অলিম্পিকের সাফল্য সবাইকে এতটাই আচ্ছন্ন করে রাখছে যে সেসব ভাবার সময় এখন জাপানিদের হাতে মনে হয় একেবারেই নেই।