মুখে কাপড় বাঁধা তরুণীর হাতের আঙুল বেয়ে পড়ছে রক্ত। কপালে লেখা-‘হেল্প মি’। প্রতীকী এই ছবি জাতীয় নারী দলের ফুটবলার মারিয়া মান্দার ফেসবুক প্রোফাইলে দেওয়া। ছবিটার ওপরে লেখা-‘প্লিজ স্টপ রেপ’।
শুধু মারিয়া মান্দা নন, ধর্ষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার গোটা দেশ। একের পর এক ঘটে যাওয়া ধর্ষণের ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসছে মানুষ। প্রতিবাদের মিছিলে যোগ দিয়েছেন ক্রীড়াঙ্গনের মেয়েরাও।
আগে খেলাধুলা হতো প্রচুর। এখন দেশে খেলাধুলা কমে গেছে। এ জন্য মানুষের নৈতিক অবক্ষয় ঘটেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘটে যাওয়া ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনায় ক্ষুব্ধ জাতীয় নারী দলের ক্রিকেটার সালমা খাতুন, ‘চারপাশে যা ঘটছে, তা মোটেও কাম্য না। এই ঘটনাগুলো যখন শুনি বা ভিডিওগুলো চোখের সামনে চলে আসে, তখন কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলি। খেলার সুবাদে আমাকে অনেকে চেনে। তবু মাঝেমধ্যে বাইরে বের হতে ভয় লাগে। নিজেকে অনিরাপদ মনে হয়।’
জাতীয় নারী দলের ওয়ানডে অধিনায়ক রুমানা আহমেদের কথা, ‘আমরা ক্রীড়াঙ্গনের মেয়েরা মোটেও নিরাপদ নই। দিন দিন দেশের যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকি। স্বস্তিতে চলতে-ফিরতে পারি না। যখন এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় যাই, তখন খুব ভয় লাগে।’ মনের এই ভয়-আতঙ্ক দূর করতে সবাইকে প্রতিবাদী হতে বললেন রুমানা, ‘ভয় দূর করতেই সবার প্রতিবাদ করা উচিত। আমরা জেগে উঠেছি। অন্যদেরও জেগে উঠতে হবে।’
খেলার সুবাদে আমাকে অনেকে চেনে। তবু বাইরে যেতে ভয় লাগে। নিজেকে অনিরাপদ মনে হয়।
বছরের বেশির ভাগ সময় বাড়ির বাইরে থাকেন জাতীয় নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন। ঢাকায় আসার সময় অজানা আতঙ্কে ভোগেন সাতক্ষীরার গোলমেশিন, ‘এমনিতেই ক্রীড়াঙ্গনের মেয়েদের অনেকে আড়চোখে দেখে। যখন বাসা থেকে ঢাকায় আসি, অভিভাবকেরাও খুব একটা স্বস্তিতে থাকেন না। শুধু ফুটবলে নয়, সব জায়গায় নারীরা অনিশ্চয়তায় ভোগে। মেয়েদের সঙ্গে যা হচ্ছে, এটা খুব দুঃখজনক। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক, এটাই চাওয়া।’
মতিঝিল বাফুফে ভবনে জাতীয় দলের মেয়েদের আবাসিক ক্যাম্প চলে বছরজুড়ে। বাফুফে ভবনে মেয়েরা নিরাপদ। খেলার মাঠেও কোচসহ অন্যরা থাকেন। তবে ব্যক্তিগত কাজের সময় বাইরে যেতে নিজের ওপরই ভরসা রাখতে হয় মিডফিল্ডার মারিয়া মান্দাকে। চারপাশের ধর্ষণের ঘটনাগুলো শুনে আতঙ্ক বেড়ে গেছে ময়মনসিংহের কলসিন্দুরের ফুটবলারের, ‘আমরা ক্যাম্পে থাকি বলে নিরাপদে আছি। কিন্তু নিজের প্রয়োজনে যখন বের হতে হয়, সঙ্গে কেউ থাকে না। একা বলেই তখন ভয় লাগে বেশি, রীতিমতো আতঙ্কে ভুগি।’
ক্রীড়াঙ্গনে মেয়েদের নিরাপত্তা নেই। অনেকের ঘটনা প্রকাশ্যে আসে, অনেকের ঘটনা আড়ালে থেকে যায়।
ধর্ষণ বন্ধে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শক্ত অবস্থান নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন এসএ গেমসে সোনাজয়ী সাঁতারু মাহফুজা খাতুন, ‘যা হচ্ছে, এগুলো জঘন্য ব্যাপার। শিশু থেকে বৃদ্ধা-সবাই এর শিকার হচ্ছে। ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া উচিত। একটা সময় অ্যাসিড নিক্ষেপ, ইভ টিজিং প্রচুর ছিল। অনেক মেয়ে এ জন্য আত্মহত্যা করেছে। শাস্তি দেওয়ার কারণে সেটা কমেছে। ধর্ষণের বিরুদ্ধেও সরকারে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। ভবিষ্যতে যেন আর কেউ এমন কাজ করতে সাহস না পায়।’
নারী নির্যাতন-লাঞ্ছনার কথা ক্রীড়াঙ্গনেও শোনা যায়। দুই বছর আগে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ভবনে এক নারী ভারোত্তোলক ধর্ষণের অভিযোগ করেন ফেডারেশনেরই এক অফিস সহকারীর বিরুদ্ধে। সংবাদমাধ্যম স্বাভাবিকভাবেই ভুক্তভোগীর নাম প্রকাশ করেনি। অনেকে তাই ভুল বুঝে এসএ গেমসে সোনাজয়ী ভারোত্তোলক মাবিয়া আক্তারকে ভুক্তভোগী ভারোত্তোলক ধরে নিয়েছিলেন। সেই কথা মনে করে মাবিয়া বলছিলেন, ‘ক্রীড়াঙ্গনে মেয়েদের নিরাপত্তা নেই। অনেকের ঘটনা প্রকাশ্যে আসে, অনেকের ঘটনা আড়ালে থেকে যায়। ভারোত্তোলনের ওই ঘটনার জন্য ব্যক্তিগতভাবে আমিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। যখন ঘটনাটা ঘটে, এলাকার অনেকে ভেবেছিল মেয়েটি আমি। সবাই বাসায় এসেছে আমাকে দেখতে। বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছে, সত্যিই কিছু হয়েছে কি না। ওই ঘটনার পর আমাদের খেলায় মেয়েরা আসতে চায় না। আমাদের একটাই দাবি, ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি হোক।’
জাতীয় টেবিল টেনিসে ১৬ বারের চ্যাম্পিয়ন জোবেরা রহমান মনে করেন, মাঠে খেলা থাকলে যুবসমাজের এমন নৈতিক অবক্ষয় হতো না, ‘আমরা যখন আশি-নব্বইয়ের দশকে খেলেছি, তখন পরিবেশ ছিল সুন্দর। আগে খেলাধুলা হতো প্রচুর। এখন দেশে খেলাধুলা কমে গেছে। এ জন্য মানুষের নৈতিক অবক্ষয় ঘটছে।’ তাঁর বিশ্বাস, সবাই খেলাধুলায় সক্রিয় থাকলে অন্তত ক্রীড়াঙ্গনে এমন ঘটনা ঘটবে না, ‘মন্ত্রণালয় যেন এমন গঠনতন্ত্র করে দেয়, যেখানে বছরে ৮-১০টি খেলা মাঠে গড়ানো বাধ্যতামূলক। এটা যিনি করবেন না, সেই সাধারণ সম্পাদককে অব্যাহতি দেওয়া হোক। নিয়মটা চালু হলে খেলার মধ্যে সক্রিয় থাকবে সবাই। সারা বছর খেলা থাকলে এমন জঘন্য কাজ করার সময় থাকবে না কারও।’