ঠাঁই হয়নি মা–বাবার সংসারে, ঠাঁই দিয়েছে আর্চারি
শ্রাবণ মাসে জন্ম, তাই নানি শখ করে নাম রাখেন শ্রাবণী আক্তার। কে জানত, শ্রাবণীর চোখে বেশির ভাগ সময় ঝরবে শ্রাবণের ধারা?
জন্মের পাঁচ বছরের মাথায় মা–বাবার ছাড়াছাড়ি। এরপর শ্রাবণীর মা অন্য জায়গায় বিয়ে করেন। কিন্তু সৎবাবার সংসারে ঠাঁই হয়নি শ্রাবণীর। মায়ের নতুন সংসার থেকে শ্রাবণীকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন নানি। এর পর থেকে নানিই শ্রাবণীর ‘মা–বাবা’।
কুষ্টিয়ার জগতির মেয়ে শ্রাবণী মনের মধ্যে বয়ে যাওয়া যন্ত্রণাগুলো ভুলতে আনন্দ খুঁজে নিয়েছেন খেলাধুলায়। কুষ্টিয়া সরকারি মহিলা কলেজে পড়ার সময় নিয়মিত ক্রিকেট খেলতেন। ‘একটু ভালো করে বাঁচবেন বলে’ ঢাকায় চলে আসা শ্রাবণীর। যে হাতে একসময় ব্যাট আর বল থাকত, সেই হাতেই তুলে নেন তির-ধনুক। কদিন আগে দ্বিতীয়বারের মতো জাতীয় আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়েছেন। বাংলাদেশ আনসারের আর্চার রিকার্ভের মিশ্র দলগত ইভেন্টে রোমান সানার সঙ্গে জুটি গড়ে জিতেছেন রুপা। আর মেয়েদের দলগত রিকার্ভ ইভেন্টে জিতেছেন ব্রোঞ্জ। পারফরম্যান্সের ধারাবাহিক উন্নতি দেখে জাতীয় দলের আবাসিক ক্যাম্পেও শ্রাবণীকে ডেকেছেন কোচ মার্টিন ফ্রেডরিখ।
লড়াই করেই এত দূর এসেছেন। পদকমঞ্চে উঠতে পেরে তাই অন্য রকম তৃপ্তি শ্রাবণীর চোখেমুখে। টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়ামে বসে নিজের সংগ্রামী জীবনের গল্প শোনাচ্ছিলেন শ্রাবণী, ‘ভালো একটা চাকরির খোঁজে এক বড় আপু আমাকে গাজীপুর এনেছেন। শফিপুর আনসার একাডেমির পাশেই থাকতাম। সেখানে থাকা আনসারের আর্চারি কোচের (জিয়াউল হক) আগ্রহে তির-ধনুকের খেলায় এসেছি। শুরুতে খুব কষ্ট হতো। হাত বাঁকা হয়ে থাকত। দলে সুযোগ পেতাম না বলে কান্নাকাটি করতাম। অনেক সময় দলের অন্য খেলোয়াড়দের জন্য পানি টেনেছি। এরপর সবার অনুশীলন শেষে জিমে গিয়ে নিজে নিজে পুশ আপ করেছি। শেষ পর্যন্ত সুযোগ পেয়েছি এবং পদকও জিতেছি। এ জন্য ভালো লাগছে।’
প্রথমবার রোমান সানার পাশে দাঁড়িয়ে তির ছুড়েছেন শ্রাবণী। মিশ্র ইভেন্টের দলে রোমানের সঙ্গে খেলতে পেরে রোমাঞ্চিত শ্রাবণী, ‘রোমান ভাইয়ার মতো এত বড় মাপের আর্চারের পাশে দাঁড়িয়ে তির ছুড়তে পেরেই খুশি। আমি তো শুরুতে খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু ভাইয়া আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন।’
গত নভেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপেও অংশ নিয়েছেন শ্রাবণী। এখন স্বপ্ন দেখছেন আগামী এপ্রিলে তুরস্কে বিশ্বকাপ আর্চারির স্টেজ ওয়ানে খেলার, ‘কখনো দেশের বাইরে খেলার সুযোগ পাইনি। এবার স্কোরিংয়ের উন্নতি করে বিশ্বকাপের জাতীয় দলে ঢুকতে চাই।’
শ্রাবণীর জন্য আর্চারি এখন আর শুধুই একটা খেলা নয়, জীবন বদলে ফেলার মাধ্যমও। সেই লক্ষ্য পূরণের ইঙ্গিতও মিলতে শুরু করেছে বলে জানালেন শ্রাবণী, ‘আমার বাবা কুষ্টিয়া শহরে অটোরিকশা চালান। মা–বাবা কেউ আমাকে কাছে রাখেননি। নানির কাছে বড় হয়েছি। কিন্তু এবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। এরই মধ্যে সেনাবাহিনী, পুলিশ দল থেকে চাকরির প্রস্তাব পেয়েছি। তবে আনসার ছেড়ে এখনই যেতে চাই না। গত মাস থেকে আনসারের বেতনভুক্ত খেলোয়াড় হয়েছি। আশা করি আর্চারি দিয়েই জীবনটা একদিন বদলে ফেলতে পারব।’