টোকিও অলিম্পিকে বাংলাদেশি স্বেচ্ছাসেবীর অভিজ্ঞতা
২০২০ টোকিও অলিম্পিকে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেছেন জাপানে উচ্চ শিক্ষায় নিয়োজিত বাংলাদেশের একদল তরুণ। সেই কাজ করতে গিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাদের হয়েছে এবং নানাদিক থেকে এটাকে তারা অভিজ্ঞতার ভান্ডারে জমা হওয়া অমূল্য এক সঞ্চয় হিসেবে দেখছেন। সবাই তারা মনে করছেন এই কাজ তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে নানাভাবে সহায়ক হয়ে উঠবে। পাশাপাশি এর মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা আন্তর্জাতিক বন্ধুত্বকেও এর সবাই মূল্যবান বিবেচনা করছেন। এর আগে দুটি লেখায় তিনজন বাংলাদেশি অলিম্পিক স্বেচ্ছাসেবক প্রথম আলোর কাছে তাদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন। আজ এখানে নিজের সেই কাজের কথা লিখেছেন অন্য এক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী মোহাম্মদ ফাহিম আলম। লেখাটি তাঁর ভাষাতেই এখানে দেওয়া হলো—
আমি টোকিও বিদেশ বিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। বাংলা ভাষা হচ্ছে এখানে আমার পাঠের মূল একটি বিষয়। অনেকের কাছে এটা বিস্ময়ের মনে হতে পারে। তবে একেবারে শিশু অবস্থা থেকে যেহেতু আমি জাপানে বড় হয়েছি এবং জাপানি স্কুলে লেখাপড়া করেছি, তাই বাংলা সেভাবে জানা না থাকায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগে নিজের মাতৃভাষাকেই মূল ভাষা হিসেবে আমি বেছে নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ২০২০ টোকিও অলিম্পিকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার সুযোগ থাকায় সেই কাজের জন্য আমি আবেদন করেছিলাম এবং এর ফলেই দুর্লভ সেই অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ আমার হয়। অলিম্পিক হচ্ছে প্রতি চার বছর অন্তর সারা বিশ্ব জুড়ে উত্তেজনা জাগিয়ে তোলা খেলাধুলার আয়োজন। ফলে আমার জন্য ২০২০ টোকিও অলিম্পিকের কাজে যুক্ত হতে পারা ছিল এমন এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা যা হয়তো জীবনে একবারই আসে। আমি সেখানে কাজ করেছি অলিম্পিক ব্রডকাস্টিং সার্ভিস বা অলিম্পিক সম্প্রচার সেবা কেন্দ্রে আর্থিক বিষয়ের একজন সহায়ক হিসেবে।
অলিম্পিক ব্রডকাস্টিং সার্ভিস আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি আই ও সি’র গড়ে তোলা একটি কোম্পানি, অলিম্পিকের সব রকম আয়োজন, যেমন গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন অলিম্পিক, প্যারালিম্পিক, যুব অলিম্পিক-এ রকম সব কটি ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ছবি এবং ধারণকৃত রেকর্ড সারা বিশ্বের কোটি কোটি দর্শকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব যে কোম্পানি পালন করে থাকে। এর সদর দপ্তর স্পেনের মাদ্রিদে এবং ৩০ টির বেশি দেশের ১৬০ জন পূর্ণ সময়ের কর্মী এখানে কাজ করছেন। তবে অলিম্পিক চলা সময় কর্মীর সংখ্যা আট হাজারের বেশিতে দাঁড়ায়।
২০২০ টোকিও অলিম্পিক জুলাই মাসের ২৩ তারিখে শুরু হলেও আমাদের কাজ শুরু হয়েছে এর দশদিন আগে টোকিওর বিগ সাইট প্রদর্শনী কেন্দ্রে। টোকিও অলিম্পিকের মূল প্রেস সেন্টার এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রচার কেন্দ্র ছিল সেখানে। আমাদের দলের যিনি তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে যিনি নিয়োজিত ছিলেন, কাজ শুরু হওয়ার প্রথম দিনে আমাদের কাজের জায়গায় নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব ছিল তার ওপর। নির্দিষ্ট সেই জায়গায় দলের অন্য সদস্যদের সঙ্গে আমার দেখা হয়। আমার ঠিক পাশে যিনি দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি যে বাংলাদেশি, সেই পরিচয় জানতে পেরে আমি অবাক এবং খুশি হয়েছিলাম। শুধু তাই নয়, ৎসুকুবা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর গবেষণায় নিয়োজিত সেই শিক্ষার্থী যে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আমার এক পরিচিত বাংলাদেশির বন্ধু, সেটা জানতে পারাও ছিল আনন্দের। ৎসুকুবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই শিক্ষার্থী নাইমুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করে জৈব প্রযুক্তি বা বায়ো ইঞ্জিনিয়ার বিষয়ে গবেষণায় নিয়োজিত আছেন।
মোট পাঁচজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে আমাদের এই আর্থিক বিষয়ের স্বেচ্ছাসেবী দলটি গঠিত ছিল। এদের মধ্যে কয়েকজন কেবল গেমস উপলক্ষে জাপানে এসেছিলেন। আমাকে ছাড়া দলের অন্য সদস্যরা হচ্ছেন জাপানে লেখাপড়া করা বাংলাদেশের নাইমুল, টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কান, নরওয়ের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক গ্রিসের এইরিনি, এবং যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করা ভিয়েতনামের উয়েন। ফলে বলা যায় আমাদের এই দলটি ছিল ভিন্ন কয়েকটি প্রেক্ষাপট থেকে আসা ছোট একটি আন্তর্জাতিক দল।
আমাদের এই ছাত্র দলটির মূল দায়িত্ব ছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রচার সেবা কেন্দ্রে কাজ করা সকল ক্রু সদস্যের কাজের সময়ের হিসাব রাখা। কেবল উয়েন ছিল হিসাব রক্ষণের ভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত। আট হাজারের বেশি ক্রু এখানে এবং জাপানের অন্যত্র ছড়িয়ে থাকা অন্যান্য ভেন্যুতে কাজ করেছেন। এদের সকলের কাজের সময়ের হিসাব রাখার দায়িত্ব আমাদের চারজনের মধ্যে বণ্টন করা হয়। ক্রুরা টিম শিটে উল্লেখ থাকা সময়ে সবকিছুর সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে পারছেন কিনা, তা জেনে নেওয়ার জন্য অন্যান্য ভেন্যুর সম্প্রচার ম্যানেজারদের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ আমাদের রাখতে হতো।
নিয়মিত এই দায়িত্বের বাইরে ভেন্যুর সম্প্রচার ব্যবস্থাপকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরও আমাদের দিতে হতো। এ ছাড়া আমাদের তত্ত্বাবধায়কদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ সম্পর্কিত কিছু দায়িত্বও আমাদের পালন করতে হয়েছে, এক্সেল শিটে যে কাজ করা আমার জন্য ছিল একেবারেই নতুন। তবে তত্ত্বাবধায়কেরা সবাই ছিলেন খুবই সদয় এবং এদের সাহায্য সব সময় আমরা পেয়েছি। কাজের পরিবেশ তাই ছিল চমৎকার, এবং সহকর্মীদের সঙ্গে অনেকটা আমোদ-ফুর্তিতে থেকে আমরা কাজ করেছি। যেমন, আমাদের এক সহকর্মীর জন্মদিনে সেখানেই তড়িঘড়ি করে আয়োজন করা পার্টিতে কেক এবং অন্যান্য খাবারের ব্যবস্থাও হয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া টেলিভিশনের বড় পর্দায় অলিম্পিকের বিভিন্ন খেলাও আমরা কাজ করে যাওয়া অবস্থায় দেখেছি। তবে সম্প্রচার সেবা কেন্দ্রের অধিকাংশ কর্মী স্পেন ও গ্রিস থেকে আসায় সেই দুটি দেশের অংশগ্রহণের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা সেখানে প্রাধান্য পেয়েছে।
আমার কাজ নিয়মিত স্বাভাবিক কাজ হলেও কখনো কখনো কঠিন কিছু দায়িত্বও আমার ওপর এসে পড়েছিল। সেগুলো মূলত ছিল সম্প্রচার সেবা কেন্দ্রের কর্মীরা যেন বুঝতে পারেন, যে জন্য জাপানি ভাষা থেকে ইংরেজিতে বিভিন্ন চুক্তি পত্র অনুবাদ করা। তবে যা কিছুই সেখানে আমি করেছি, এর সবটাই ছিল আমার জন্য খুবই উপভোগ্য ও মূল্যবান। ফলে আমি জানি এই অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতের পেশা জীবনে আমাকে নানাভাবে সাহায্য করবে, বিশেষ করে এ কারণে যে আগামী বছর থেকে আমি জনসম্পদ বিভাগে আমার কর্ম-জীবন শুরু করব।
অলিম্পিকে কাজ করার এই সুযোগ পাওয়ার জন্য সবাইকে আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই, বিশেষ করে আমার তত্ত্বাবধায়ক যারা ছিলেন এবং সেই সঙ্গে চমৎকার সেই অভিজ্ঞতা আমি যাদের সঙ্গে আমি ভাগাভাগি করে নিতে পেরেছি, আমাদের ছাত্র দলের সেই সব সুহৃদ-সহকর্মীকে।
সবশেষে একটি কথা না বললেই নয়। অলিম্পিকের কাজ করতে গিয়ে খেলার মাঠে আমাকে যেতে হয়নি। তবে আমার কিন্তু এতে কোনো দুঃখ নেই। অনেকের ধারণা যে অলিম্পিক যেহেতু খেলাধুলার বিষয়, ফলে সবকিছুই সেখানে হয়তো মাঠ কেন্দ্রিক। আমি নিজেও আগে এ রকমই মনে করতাম। তবে এই কাজে জড়িত হয়ে আমি বুঝতে পেরেছি অলিম্পিক হচ্ছে বিশাল এক আয়োজন-যজ্ঞ, যেটাকে সফলভাবে সকলের কাছে নিয়ে যাওয়ার পেছনে সক্রিয় থাকছে সহস্র হাত, যার অনেকগুলোই আবার মাঠের বাইরে। সেরকম সহস্র হাতের একটি হতে পেরে নিজেকে আমি সৌভাগ্যবান মনে করছি।