চোটে ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যেতে বসেছে বাকির
ঘরে আসবাব নেই। মেঝেতে তোশক বিছানো। এক পাশে বসানো এয়ারকুলার ফ্যান। বিছানার ওপরে এলোমেলো পড়ে আছে মশা মারার ইলেকট্রিক ব্যাট, চিকিৎসাপত্রের ফাইল, এক্স–রে, এমআরআই রিপোর্ট। ভাটারার নতুন বাজার এলাকার ছোট্ট এই ঘরে কদিন আগেই পাড়ি জমিয়েছেন আবদুল্লাহ হেল বাকি। যেখানে বেশির ভাগ সময় শুয়ে-বসেই দিন কাটছে তাঁর।
গুলশান শুটিং কমপ্লেক্সে অন্য শুটাররা যখন বিশ্বকাপের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, তখন কোমরের চোটে শুটিং থেকে ছিটকে যাওয়ার আশঙ্কা রাইফেলের দেশসেরা শুটার বাকির। ওয়ালথার এলজি ৪০০ মডেলের প্রিয় রাইফেলটা যে সর্বশেষ কবে কাঁধে তুলেছিলেন, তা ভুলতেই বসেছেন। চোটের যা অবস্থা, তাতে ক্যারিয়ার নিয়ে শঙ্কায় পড়ে গেছেন কমনওয়েলথ গেমসে রূপাজয়ী শুটার।
সর্বশেষ শুটিং রেঞ্জে দাঁড়িয়েছিলেন গত বছরের জুলাইয়ে, টোকিও অলিম্পিকে। এরপর চোটের কারণে প্রায় সাড়ে আট মাস ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারেননি। চোটের জন্য অনুশীলনও করতে পারছেন না।
ভারী রাইফেল বা পিস্তল নিয়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার কারণে বেশির ভাগ শুটার ঘাড়, কাঁধ বা পিঠের ব্যথায় ভোগেন। কিন্তু বাকির চোট কোমরে।
মাঝেমধ্যে ব্যথার তীব্রতা এত বেশি হয় যে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না। চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধের পাশাপাশি চলছে নিয়মিত থেরাপি ও গরম জলের সেঁক। কিন্তু চোট এত গুরুতর যে শেষ পর্যন্ত তা থেকে মুক্তি পেতে অস্ত্রোপচারের টেবিলেই যেতে হতে পারে বাকিকে।
২০১৯ সালে কলকাতায় শুটিং লিগে অংশ নিতে গিয়ে ব্যথাটা প্রথম টের পান বাকি। সমস্যাটার শুরুটা হঠাৎ করেই। শুনুন বাকির মুখেই, ‘হোটেল থেকে বের হওয়ার জন্য সেদিন জুতা পরছিলাম। হঠাৎ কোমরে ব্যথা অনুভব করি। এমন তীব্র ব্যথা যে বিছানায় শুয়ে পড়ি। শুটার জেসিমুজ্জামান হিমেলের সহযোগিতায় বাথরুমে, ডাইনিংয়ে যেতে হতো।’ ভারতে একজন চিকিৎসক দেখানোর পর ঢাকায় ফিরে বিসিবির চিকিৎসক দেবাশীষ চৌধুরীকে দিয়ে চিকিৎসা করান। সেরেও উঠেছিলেন।
এরপর টোকিও অলিম্পিকে যাওয়ার আগে গত বছরের জুনে সমস্যাটা আবার দেখা দেয়, ‘একদিন ডাইনিংয়ে যাওয়ার পথে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় আবার কোমরে ব্যথা পাই। অবস্থা এত খারাপ ছিল যে খাওয়া শেষে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে পারছিলাম না। সেই ব্যথাও বিশ্রাম নেওয়ার পর সেরে গিয়েছিল।’
বাকি সর্বশেষ চোটে পড়েন গত জানুয়ারিতে। ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত আইএসএসএফ গ্রাঁ প্রি টুর্নামেন্টের বাছাইয়ের জন্য অনুশীলনের চেষ্টা করছিলেন তখন। কিন্তু কাঁধে রাইফেল তুলে পজিশন নিলেই কোমরের বাঁ পাশে ব্যথা বাড়তে শুরু করে। ব্যথার তীব্রতা এত বেশি ছিল যে শেষ পর্যন্ত ক্যাম্প ছেড়ে বাড়িতে চলে যান বাকি।
এরই মধ্যে দেশের চারজন চিকিৎসককে দেখিয়েছেন। একই ধরনের চোটে পড়া ভারতীয় ও জার্মানির কয়েকজন শুটার বন্ধুর কাছে পরামর্শ নিয়েছেন। জাতীয় দলের সাবেক কোচ ক্লাভস ক্রিস্টেনসনের সঙ্গেও চোট নিয়ে আলাপ করেছেন। কিন্তু স্বস্তি মিলছে না কারোর পরামর্শেই।
সর্বশেষ যে চিকিৎসক দেখছেন, তিনি এক মাসের পর্যবেক্ষণে রেখেছেন বাকিকে। স্থায়ী সমাধানের জন্য ছুরির নিচেই যেতে হতে পারে বলেও জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। বর্তমান চিকিৎসা সম্পর্কে বাকি বললেন, ‘ডাক্তার আমাকে ইলেকট্রিক থেরাপি দিচ্ছেন। কিছু টেস্টও দিয়েছেন। সেগুলোর রিপোর্ট এখনো পাইনি। আপাতত এক মাস দেখবেন ডাক্তার। স্থায়ী সমাধান পেতে অপারেশনের কথা বলেছেন।’
২০০৮ সালে পাকিস্তানে দক্ষিণ এশিয়ান শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু বাকির। ১৪ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে চোটের কারণে কখনো দলের বাইরে থাকেননি। কিন্তু এবার যা অবস্থা, তাতে বড় একটা ভয়ও পেয়ে বসেছে তাঁকে, ‘ইনজুরি থেকে সেরে উঠতে না পারলে এখানেই ক্যারিয়ার শেষ।’
দিনের বেশির ভাগ সময় নিশানাভেদে মগ্ন থাকতেন যিনি, সেই বাকির সময় কাটছে এখন সিনেমা দেখে আর মেডিটেশন করে। মেডিটেশনেও মন শান্ত হচ্ছে না, ‘শুটিং আমার জন্য নেশার মতো। প্রতিদিন ১০-১৫টা গুলি করলেও শান্তি লাগত।’
ডিসেম্বরে বিয়ে করে নতুন সংসার পেতেছেন। স্ত্রী সাফারিয়া আক্তারও বিকেএসপির সাবেক শুটার। বাকির যন্ত্রণা ভালোই বুঝতে পারেন তিনি। মাঝেমধ্যে সাফারিয়ার কথাতেই সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করেন বাকি, ‘আমার চেহারা দেখে ও বুঝতে পারে, কী যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। চোট যে খেলাধুলারই অংশ, সেটা বলে আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে। ও বলে, আমার সেরে ওঠাটা সময়ের ব্যাপার।’
ফিট হয়ে আবারও শুটিং রেঞ্জে ফিরতে চান। কিন্তু অজান্তেই যেন অজানা শঙ্কা বাজছে বাকির মনে, ‘যত দিন বেঁচে আছি, শুটিং নিয়েই থাকতে চাই। শুটিং আমার প্রথম ও শেষ ভালোবাসা। চেয়েছিলাম ক্যারিয়ারের শেষটা সুন্দর হোক। সেটা হয়তো হবে না। শেষ পর্যন্ত খেলা ছেড়ে দিতে হলে কোচিংয়ের দিকেই মনোযোগী হব।’