গল্পটা ১৪ মাস বয়সে শরীরে মা-বাবার বেঁধে দেওয়া বোমা থেকেও বেঁচে ফেরার
হাভেন শেফার্ডের বয়স তখন মাত্র ১৪ মাস। পরকীয়ার জেরে তাঁর মা-বাবার সংসারে কলহ লেগেই থাকত। ভিয়েতনামে থাকতে শেফার্ডের মা–বাবা আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিলেন। একসঙ্গে যেহেতু বসবাস করা সম্ভব নয়, তাই সবাই মিলে শেষ হয়ে যাওয়াই উচিত! এমন ভাবনা থেকে মাত্র ১ বছর ২ মাস বয়সী মেয়ের শরীরে বোমা বেঁধে তাঁকে কোলে নিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন মা–বাবা।
মা–বাবার সেই চেষ্টা ‘সফল’ হয়। বোমার বিস্ফোরণে তাঁরা মারা যান। কিন্তু অলৌকিকভাবে বেঁচে যায় মেয়েটি—হাভেন শেফার্ড। তবে নিজের শরীরটা আর আস্ত পাননি তিনি। বিস্ফোরণে তাঁর হাঁটুর নিচ থেকে শরীরের বাকি অংশ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হাঁটুর নিচ থেকে পায়ের বাকি অংশ কেটে ফেলতে হয়। সেই মেয়েটি এখন সাঁতারু, টোকিও প্যারালিম্পিকে অংশ নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে।
তবে মা–বাবার প্রতি শেফার্ডের কোনো ক্ষোভ নেই, ‘ওই জীবন আমি কাটাইনি। তখনকার কিছুই মনে নেই।’ কিছুদিন আগে ‘পিপল’ ম্যাগাজিনকে তিনি বলেছেন, ‘আমি শুধু পা হারিয়েছি। জীবনও তো হারাতে পারতাম।’
১৮ বছর বয়সী শেফার্ডের এটাই প্রথম প্যারালিম্পিক আসর। যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে ১০০ মিটার ব্যাকস্ট্রোক এসবি৭ এবং ২০০ মিটার এসবি৮ সাঁতার ইভেন্টে অংশ নেবেন তিনি।
মা–বাবাকে খুব অল্প বয়সে হারিয়েও থেমে থাকেনি শেফার্ডের জীবন। শেলী ও রব শেফার্ড দম্পতি তাঁকে দত্তক নেন। এই পরিবারের মাধ্যমে মিজৌরির কার্থেজে নিজের দ্বিতীয় জীবন ফিরে পান শেফার্ড। তাঁর ভাষায়, ‘আমাকে বাঁচানোর জন্য তাঁদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তাঁরা আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন।’
শেলী ও রবের পরিবারে চার বড় বোন ও দুই ভাইয়ের সঙ্গে বেড়ে উঠেছেন শেফার্ড। ভাইদের সঙ্গে খুনসুটিও জমেছে বেশ। শেফার্ডের ভাষায়, ‘আমি তাঁদের অলৌকিক সন্তান, আমিই মা–বাবার সবচেয়ে প্রিয়, এটা বলে ওদের সঙ্গে মজা করেছি।’
শেফার্ডের জীবনকে দেখার চোখটা একটু আলাদা। যেসব বিষয় কখনো পাল্টাতে পারবেন না, তা মেনে নিয়ে ইতিবাচক চোখে জীবনকে দেখেন তিনি। এ কারণে রসবোধ ও জীবনদর্শনও দারুণ, ‘জীবনকে ইতিবাচক চোখে দেখতে হবে। জানি, আমি খুব বাজে সময় পেরিয়ে এসেছি। জীবনে বেঁচে থাকার দ্বিতীয় সুযোগ পেয়েছি। নিজেকে তাই আলাদা ভাবি, এ কারণে জীবনে পার্থক্য গড়তে পেরেছি। যা পাল্টাতে পারবেন না, তা মেনে নিন। যেসব বিষয় পাল্টাতে পারবেন, সেসব পাল্টে ফেলুন।’
জীবনকে সহজে নিতে পারার ক্ষমতার কারণেই কি না, টোকিওতে শেফার্ড লক্ষ্য ঠিক করেছেন নিজের মতো করে, ‘টোকিওতে আনন্দ করাই আমার লক্ষ্য। কোনো উচ্চাশা নেই। কারণ, উচ্চাশা থাকলে ব্যর্থ হব এবং মন খারাপ হবে।’
প্যারালিম্পিকে ১৩ বারের চ্যাম্পিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের জেসিকা লং শেফার্ডের আদর্শ। জেসিকার মতো শেফার্ডেরও দুটি পা নেই। কৃত্রিম পা লাগিয়ে পুলে নামা শেফার্ড প্যারালিম্পিকে অংশ নেওয়া প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি শুধু সবাইকে দেখাতে চাই, শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষেরাও অন্যদের মতোই। প্যারালিম্পিক শারীরিক সমস্যা নিয়ে উঠে আসা খুব ভালো অ্যাথলেটদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার জায়গা।’
শেফার্ড শুধু সাঁতারু নন, তিনি মডেলও। কাজ করেছেন টমি হিলফিগারের মতো নামী ব্র্যান্ডের সঙ্গে। ছবি আঁকা তাঁর শখ। এত গুণের মেয়েটি পৃথিবীতে শরীর নিয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিতে চান। মডেল হিসেবে কাজ করার সময়ই শরীর নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়, ‘তখন বুঝতে পেরেছি, নিখুঁত শরীর বলে আসলে কিছু নেই। আশপাশে তাকালে বুঝতে পারবেন, সবারই কিছু না কিছু খুঁত আছে।’