এ ভালোবাসার গল্পটা অন্যরকম

কারাতে খেলতে এসে প্রেমের বাঁধনে বাঁধা পড়েছেন দুজন। এরপর বিয়েও করেছেন বাংলাদেশের দুই কারাতেকা হোসেন খান ও হুমায়রা আক্তার।ছবি: শামসুল হক

হাঁটু গেড়ে বসে লাল গোলাপ উঁচিয়ে ধরে ‘আই লাভ ইউ’ বলা। সাহসী ছেলেরা নাকি প্রেমের প্রস্তাব এভাবেই দেয়। পছন্দের মানুষকে মনের কথা জানানোর নানান উপায় আছে লাজুক প্রেমিকদেরও। কিন্তু মনে প্রেমের ডুগডুগি বাজা কাউকে কী কখনো হবু প্রেমিকাকে বলতে শুনেছেন, ‘তোমাকে সফল দেখতে চাই। থাকবে আমার সঙ্গে?’

২০১০ এসএ গেমসে সোনাজয়ী কারাতেকা মো. হোসেন খান এভাবেই তাঁর প্রিয় মানুষকে জানিয়েছিলেন ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ কথাটি। লজ্জায় মুখ লুকিয়ে পালানো ষোড়শী মেয়েটিও আরেক কারাতেকা। এসএ গেমসে সোনাজয়ী হুমায়রা আক্তার। দুজনের মনের আকাশেই রংধনুর মতো খেলা করে কারাতের কিক, পাঞ্চ। মনের ভাববিনিময়ে তাই সময় লাগেনি। ২০১৬ সালে শুরু সে প্রণয় বিয়েতে পূর্ণতা পায় গত মাসে। প্রণয়ের অনুঘটক হিসেবে পর্দার আড়ালে অনেক কিছুই থাকে। তাঁদের বেলায় ছিল কারাতের প্রতি নিবেদন ও স্বপ্ন।

সিনিয়র খেলোয়াড় হিসেবে ২০১৩ সালে হুমায়রাকে অনুশীলন করানোর দায়িত্ব পড়ে হোসেনের কাঁধে। হুমায়রার প্রতিভা ও খেলার প্রতি পাগলাটে আত্মনিবেদন তাঁকে মুগ্ধ করে। ভবিষ্যৎ জীবনসঙ্গী হিসেবে হোসেনও যেন এমন কাউকেই চান, যে কারাতেকে ভালোবাসে, পেতে চায় সাফল্য।

২০১৬ সালে হুমায়রাকে অভিনব এক প্রেমের প্রস্তাব দেন হোসেন। সেদিনের স্মৃতি মনে করে হোসেন বলছিলেন, ‘কারাতের প্রতি আমি খুব নিবেদিত। ওর মধ্যেও আমি সে জিনিস দেখতে পাই। ভাবলাম, তাকে যদি সারা জীবন আমার কাছে রাখতে পারি, তাকে বড় কারাতেকা হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। ওর নিজের স্বপ্ন পূরণ হওয়ার সঙ্গে আমার স্বপ্নও পূরণ হবে। আমাদের সম্পর্কটা এভাবেই শুরু।’

হােসেন খান ও হুমায়রা আক্তারের কারাতে অনুশীলন।
ছবি: প্রথম আলো

সূত্রাপুরের বাসায় বসে মাথা নেড়ে স্বামীর কথাকে সমর্থন করেন হুমায়রা। একটু আগেই অনুশীলনে স্বামীকে কিক ও পাঞ্চে ধরাশায়ী করা ২২ বছরের তরুণী তখন শুধুই এক নব পরিণীতা স্ত্রী। লড়াকু তরুণীর কথায় ভালোবাসার কোমলতা, ‘আমাকে অনুশীলন করানোর জন্য ও (হোসেন) কোনো টাকা নিত না। আমার প্রতি তার নিবেদন আমাকে মুগ্ধ করত। ওকে ভালোবাসার জন্য তাই বেশি কিছু ভাবতে হয়নি।’

২০১৬ সালের শেষ দিকে কারাতে কোচ হিসেবে বিকেএসপিতে চাকরি হওয়ায় সেখানেই আবাস গড়েন হোসেন। তাতে হুমায়রার সঙ্গে ভৌগলিক দূরত্ব তৈরি হলেও ভালোবাসার বন্ধন যেন আরও দৃঢ় হয়। হুমায়রাকে এসএ গেমসে সোনা জেতাতে হবে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সাভারের বিকেএসপি থেকে ঢাকায় এসে স্ত্রীকে অনুশীলন করাতে থাকেন হোসেন। ২০১৯ সালে নেপাল এসএ গেমসে ভালোবাসার মানুষের কষ্ট আর আস্থার প্রতিদান দেন হুমায়রা। ব্যক্তিগত কুমিতে সোনা জেতার পাশাপাশি ব্যক্তিগত কাতা ইভেন্টে জেতেন ব্রোঞ্জ এবং দলীয় কুমি ইভেন্টে রুপা।

কারাতেকা দম্পতির এক সঙ্গে অনুশীলন।
ছবি: প্রথম আলো

সিটি কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক পড়ছেন হুমায়রা। তাঁর সোনা জয়ের দিনে খেলোয়াড় হিসেবে নেপালে উপস্থিত ছিলেন হোসেনও। সেদিনের কথা মনে করে হুমায়রা রোমাঞ্চিত হন আজও, ‘ও আমার কাছে একটা জিনিসই চেয়েছিল, সেটা সোনার পদক। গেমসে সোনা জয়ের পর আমি তাকে প্রথম কাঁদতে দেখি। তার কান্না দেখে আমিও কেঁদে ফেলি।’

মেয়ে যতই খেলার প্রতি আগ্রহী থাকুক, বাংলাদেশের বাস্তবতায় মেয়েদের বিয়ে হওয়া মানেই বেশির ভাগ সময় খেলার পাট চুকে যাওয়া। যা কিছু ব্যতিক্রম আছে, তার মধ্যে আছেন হোসেন–হুমায়রাও। স্ত্রীকে নিয়ে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখেন হোসেন, ‘এসএ গেমসে ও সোনা জিতেছে। এখন আমার স্বপ্ন, হুমায়রা এশিয়ান কোনো আসরে পদক জিতুক।’ স্বামীর স্বপ্নের কথা পাশে বসে শুনছিলেন হুমায়রা। চেহারার অভিব্যক্তি যেন বলে দিচ্ছিল স্বপ্নটা তাঁরও।

‘মারামারির’ খেলা কারাতে কী ভালোবাসার মায়াতেই না বন্দী করেছে এই কপোত–কপোতীকে!