অলিম্পিকে পদকের অপেক্ষা ঘুচবে কবে
উদ্যোগ নেই, আছে দোষারোপের খেলা
১৯৮৪ লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে ২০২০ টোকিও—১০টি অলিম্পিকে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ জেতেনি একটি পদকও। কেন এ ব্যর্থতা, অলিম্পিকে কাঙ্ক্ষিত পদক পেতে কী করতে হবে, নাকি বাংলাদেশের অলিম্পিক বাস্তবতা হয়ে থাকবে ‘অংশগ্রহণই বড় কথা’!
সুধীমণ্ডলী, এখন আসছে বাংলাদেশ—অলিম্পিকে পদক জিততে না পারা দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনবহুল দেশ।
যেকোনো অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মার্চপাস্টে বাংলাদেশ দলকে আসতে দেখলে ঘোষকেরা সাধারণত প্রথমে এ কথাই বলেন। বাংলাদেশের পরিচয় যেন ওটাই—অলিম্পিকে পদক না জেতা জনবহুল দেশ!
অথচ অনেক ক্ষুদ্র দেশও অলিম্পিকে পদক জিতেছে। তাহলে বাংলাদেশ কেন পারে না? ৮ আগস্ট টোকিও অলিম্পিক শেষে ঘুরেফিরে আসছে এই প্রশ্নই—কবে শেষ হবে অলিম্পিকে বাংলাদেশের পদক জয়ের অপেক্ষা?
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন থেকে ভালো সংগঠকেরা হারিয়ে যাচ্ছেন। দেশে আজ পর্যন্ত এমন একজন ক্রীড়ামন্ত্রী এলেন না, যাঁর হাত ধরে স্বপ্ন দেখা যায়। এ দেশের ক্রীড়া অবকাঠামো আধুনিক নয়। খেলোয়াড়দের চিন্তার গণ্ডিও দক্ষিণ এশিয়ান গেমস বা সাফ গেমস পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। এসএ গেমসেই এখনো বাংলাদেশ পেছনের বেঞ্চের ছাত্র। কমনওয়েলথ গেমস, এশিয়ান গেমস তো অনেক অনেক কঠিন। আর অলিম্পিক? সেখানে পদক জয় এখনো কল্পনাতেও আনতে পারেন না এ দেশের অ্যাথলেটরা।
পদক জয়ের জন্য পরিকল্পনা দরকার। সেই পরিকল্পনা আর চেষ্টাই যে নেই বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে! ১৯৮৪ সাল থেকে শুরু করে প্রতিবারই শেষ সময়ের অগোছালো প্রস্তুতি নিয়ে অলিম্পিকে যায় বাংলাদেশ। ওয়াইল্ড কার্ড বা বিশেষ সুবিধায় পাঠানো হয় কয়েকজন অ্যাথলেটকে। তবে এবার আর্চার রোমান সানা সরাসরি অলিম্পিকে খেলে দীর্ঘদিনের সেই বৃত্ত ভেঙেছেন। রোমান–দিয়া সিদ্দিকী অলিম্পিকে প্রথমবারের মতো কোনো খেলায় বাংলাদেশকে দ্বিতীয় রাউন্ডে তুলেছেন। কিন্তু এটুকুতেই কি তৃপ্ত থাকবে বাংলাদেশ?
বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (বিওএ) অলিম্পিকে পদক জয়ের লক্ষ্যে বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা নিতে পারে। কিন্তু গেমসে দল পাঠিয়েই যেন দায়িত্ব শেষ তাদের! ভালো কিছু করার চিন্তাভাবনা, উদ্যোগ নেই। গেমস থেকে ফিরে নেই কোনো পর্যালোচনাও। হয়তো দেখা যাবে, ২০২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিক শুরুর মাস দুয়েক আগে আবার নড়েচড়ে উঠবে তারা। অথচ প্যারিস অলিম্পিকের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাদের ক্রীড়া দলের জন্য এখনই গতবারের চেয়ে ৪৪ ভাগ অর্থ বরাদ্দ বাড়িয়ে প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। অঙ্কটা ২৩ কোটি ২০ লাখ পাউন্ড বা ২ হাজার ৭১০ কোটি টাকা।
অলিম্পিকের জন্য বাংলাদেশ সরকার কখনো আলাদাভাবে অর্থ বরাদ্দ করেনি। অপ্রতুল ক্রীড়া–বাজেট হয়তো একটা কারণ। তার ওপর দেশের ক্রীড়া–বাজেট এবার আরও কমছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয় মিলিয়ে মোট ১ হাজার ১২১ কোটি ৬০ লাখ টাকার বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে। উন্নয়ন খাতে ২৭৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকা এবং পরিচালন খাতে ৮৪১ কোটি ৭১ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। বাকিটা খেলার জন্য।
ক্রীড়াবিদদের প্রশিক্ষণের জন্য বরাদ্দ থাকে সামান্যই। বিওএ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে অলিম্পিক লক্ষ্য দাঁড় করানোর উদ্যোগ নিলে পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টাতে পারত। যদিও বিওএ মহাসচিব সৈয়দ শাহেদ রেজা প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘বিওএ স্বতন্ত্র সংস্থা, সরকার এবং ফেডারেশনের মধ্যে একটা সেতু বা মিডলম্যান। আমরা হয়তো ফেডারেশনকে কোচ জোগাড় করে দিতে পারি। বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দিতে পারি। কিন্তু অলিম্পিক নিয়ে লক্ষ্য স্থির করার দায়িত্ব সরকার ও ফেডারেশনগুলোর।’
টোকিও অলিম্পিকে ভারতের সাফল্যে দেশটির অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের বড় ভূমিকা আছে। ভারত পারলে বিওএ কেন নয়? এ প্রশ্নে শাহেদ রেজার পাল্টা দাবি, ‘ভারতের সাফল্যে ভারতীয় অলিম্পিক কমিটির কোনো ভূমিকা নেই। এটি মূলত সরকার ও ফেডারেশনের কাজ।’
এটা ঠিক যে বিওএ কিছু খেলোয়াড়ের জন্য উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। এর আগে খেলোয়াড়দের আর্থিক সহায়তা এবং মাসিক বৃত্তিও দিয়েছে। কিন্তু অলিম্পিক নিয়ে সরকারের সঙ্গে তাদের যৌথ উদ্যোগ না থাকায় গতানুগতিকভাবেই চলে গেমসের প্রস্তুতি–ব্যবস্থাপনা। এ ক্ষেত্রে অলিম্পিকের ভূমিকা কী হতে পারে, সে ব্যাপারে একটা ধারণা দিলেন ১৯৯২-৯৬ পর্যন্ত বিওএর মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করা বশীর আহমেদ, ‘অলিম্পিকভুক্ত খেলার ফেডারেশনের কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত হয় বিওএর কমিটি। কাজেই বিওএ আলাদা কিছু নয়। তারা ফেডারেশনকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করতে পারে। কিন্তু গেমসের লক্ষ্য স্থির করার মূল দায়িত্ব সরকার ও ফেডারেশনের।’
যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান অবশ্য বল ঠেললেন ফেডারেশনগুলোর দিকে। বর্তমানে টোকিও সফররত মন্ত্রী গত পরশু মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার নয়, অলিম্পিক সামনে রেখে লক্ষ্য স্থির করতে হবে ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোকেই। তারপর আমরা আর্থিক সহায়তা করব।’
ক্রীড়া ফেডারেশনগুলোর জন্য সরকারের বার্ষিক অনুদান বর্তমানে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা। এ টাকায় কার্যকর প্রশিক্ষণ হয় না। তার ওপর ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে দেশে এখন ক্রীড়া ফেডারেশনের সংখ্যা ৫০টির বেশি। এ পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ১০–১৫টি ফেডারেশন বাছাই করে তাদের বরাদ্দ বাড়ানো হবে বলে জানিয়েছেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী।
অলিম্পিকে পদকের দেখা পেতে প্রয়োজন আসলে সরকার, ফেডারেশন এবং বিওএর যৌথ উদ্যোগ। ফেডারেশনগুলোকে যেহেতু বিভিন্ন সময় সাহায্য–সহযোগিতা করে, তাদের কাছ থেকে কাজ আদায় করতে পারে বিওএ। কিন্তু বেশির ভাগ ফেডারেশনই চলছে উদ্দেশ্যহীনভাবে। সেখানে রাজনৈতিক পরিচয়ে চলে সংগঠকদের দৌরাত্ম্য। খেলা নিয়ে তাদের কোনো স্বপ্ন নেই, চেষ্টা নেই।
নদীমাতৃক দেশেও তাই এখন আর নতুন সাঁতারু তৈরি হচ্ছে না। নিয়মিত টুর্নামেন্টগুলোও হয়ে পড়েছে অনিয়মিত। নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে পথ হারিয়েছে অলিম্পিকে পদক জেতার সম্ভাবনাময় ইভেন্ট শুটিং। উল্টো চিত্র যে একেবারেই নেই, তা নয়। সিটি গ্রুপের পৃষ্ঠপোষণায় বাংলাদেশ আর্চারি ফেডারেশনের ‘তীর: গো ফর গোল্ড’ কর্মসূচির অধীনে রোমান সানাদের উঠে আসাটা তো সম্ভাবনার কথাই বলে! অনেক সংকটের মধ্যেও তাই আর্চারি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী রাজীব উদ্দীন আহমেদের আশা, চেষ্টা করলে অলিম্পিকে পদক জেতা সম্ভব, ‘এবার হয়নি, আশা করি ভবিষ্যতে আর্চারি অলিম্পিকে পদক পাবে।’
সে লক্ষ্যেও প্রয়োজন সরকার, ফেডারেশন এবং বিওএর সম্মিলিত উদ্যোগ। তাহলেই যদি একদিন অলিম্পিকে ধরা দেয় কাঙ্ক্ষিত পদক!