এবার কি কেউ ইমরানুরের পাশে দাঁড়াবে?
ইমরানুর রহমান শুধুই অ্যাথলেটিকস নিয়ে থাকতে চান। কিন্তু তার উপায় কী? গত বছর তুরস্কে ইসলামিক সলিডারিটি গেমসে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে ফাইনালে উঠেও বাংলাদেশের কোনো স্পনসর প্রতিষ্ঠানের মন গলাতে পারেননি। তাঁর পাশে দাঁড়ায়নি কেউ।
সে সময় ইমরানুর প্রথম আলোকে এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, ইংল্যান্ডে দুটি চাকরি সামলে তাঁর পক্ষে ঠিকঠাক অ্যাথলেটিক চর্চা অব্যাহত রাখা কঠিন। একে তো সেভাবে সময় মেলে না, তার ওপর অনুশীলন করতে টাকা দরকার। একজন কোচ রাখলে তাঁকে সপ্তাহে কড়কড়ে পাউন্ড দিতে হয়। তাঁর ওই সাক্ষাৎকার পড়ে দেশের শীর্ষ একটি ক্রীড়া ফেডারেশন খোঁজ নিয়েছিল, ইমরানুরের মাসে কত টাকা দরকার। যে টাকা হলে তিনি চাকরি না করে শুধু খেলা নিয়েই থাকতে পারবেন। ইমরানুর তখন হিসাব করে জানান, মাসে তাঁর ৫ লাখ টাকা হলেই চলবে।
কিন্তু এরপর ওই প্রতিষ্ঠানটি আর এগোয়নি। বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনও পারেনি ইমরানুরের স্পনসরশিপের ব্যাপারে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিতে। এ ক্ষেত্রে ফেডারেশনের ব্যর্থতা রয়েছে। সেই ব্যর্থতা মুছে এবার কী অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন জোরেশোরে চেষ্টা করবে? তার চেয়ে অবশ্য বড় প্রশ্ন, কোনো স্পনসর প্রতিষ্ঠান কি এগিয়ে আসবে?
এই প্রশ্নগুলো আরও জোরালো হয়ে উঠেছে ইমরানুরের সর্বশেষ সাফল্যে। গতকাল কাজাখস্তানে এশিয়ান পর্যায়ে অ্যাথলেটিকসে বাংলাদেশকে প্রথম পদক এনে দিয়েছেন, সেটাও রীতিমতো সোনা। এশিয়ান ইনডোর অ্যাথলেটিকসে ৬০ মিটার স্প্রিন্টে তিনি এই সোনা জেতেন। আজ সকালে কাজাখস্তানে টেলিফোনে যখন ইমরানুরের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হচ্ছিল, তখনো তিনি জানালেন, চাকরি করে খেলাটা তাঁর জন্য বড় এক চাপ। সেটা কেমন?
সব ছাপিয়ে গতকাল ইমরানুর নিজেকে নিয়ে গেছেন নতুন উচ্চতায়। বাংলাদেশের মৃতপ্রায় অ্যাথলেটিকসে নতুন আশার আলো দেখিয়েছেন। এখন দায়িত্ব অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের। সেই দায়িত্ব পালনে কতটা প্রস্তুত ফেডারেশন?
আগের কথাটাই বললেন আরেকবার, ‘আমি একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে হিসাবরক্ষকের চাকরি করছি। এটি পূর্ণকালীন চাকরি। ৮ ঘণ্টা কাজ। এরপর একটি খণ্ডকালীন কাজও করি। এসব সামলেই আমাকে অনুশীলন করতে হয়। কষ্ট হয়ে যায় অনেক। তারপরও যতটা পারছি, নিজের কাজটা করে চলেছি।’
স্ত্রী আর শিশুকন্যা নিয়ে তাঁর সংবার। সংসারের নানা কাজ সামলাতে হয়। সকালে চাকরিতে যাওয়ার আগে ২-৩ ঘণ্টা অনুশীলন করেন। কাজ শেষে সময় পেলে সন্ধ্যায় আবার অনুশীলনে নামেন। যত কষ্টই হোক, সব হাসিমুখে মেনে নিয়ে ইমরানুর এগিয়ে চলেছেন আপন লক্ষ্যে।
ইমরানুরের গল্পটা হয়তো অনেকেই জানেন। ২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন হঠাৎ ইমরানুরকে ঢাকায় এনে পরিচয় করিয়ে দেয় সবার সামনে। তাঁকে আনার পেছনে বড় কারণ ছিল দেশের অ্যাথলেটিসে সাফল্য-খরা দূর করা। ২০০৬ সালে কলম্বো এসএ গেমসে ১১০ মিটার হার্ডলসে মাহফুজুর রহমান সোনা জেতার পর আর কোনো সোনা আসেনি এই গেমসে। সোনা দূরে থাক, অ্যাথলেটিকসে ‘দক্ষিণ এশিয়ার অলিম্পিকে’ পদক জেতাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের জন্য।
ইমরানুর আসার পর বিকেএসপিতে প্রথম তাঁর ট্রায়াল নিয়েছিল ফেডারেশন। হ্যান্ড টাইমিংয়ে ইমরান তখন ১০০ মিটার স্প্রিন্টে ১০.৪০ সেকেন্ড সময় নেন। ৬০ মিটারে ৬. ৫০ সেকেন্ড। হ্যান্ড টাইমিংয়ে আসল চিত্রটা না এলেও আশাবাদী হলেন ফেডারেশন কর্তারা। এরপর ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় জাতীয় অ্যাথলেটিকসে প্রথম অংশ নিয়ে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে সোনা জেতেন ইমরানুর। সময় নেন ১০.৫০ সেকেন্ড। ভেঙে ফেলেন ২২ বছরের পুরোনো জাতীয় রেকর্ড।
আমাদের দায়িত্ব বেড়ে গেছে এখন। অবশ্যই সেই দায়িত্ব পালনে চেষ্টা করব। আমরা সরকারের শীর্ষ মহলসহ স্পনসরদের কাছে যাব, যাতে ইমরানুর আর্থিক সমর্থনটা পায়। আমরা ওকে এখন দেশে নিয়ে আসছি, সংবর্ধনা দেব। তারপর দেখছি, কী করা যায়।
সেই থেকে ইমরানুরকে আর পেছন তাকাতে হয়নি। তিনি ছুটছেন সামনে। বিশ্ব অ্যাথলেটিকসে মোটামুটি ভালো করেন, তারপর ইসলামিক সলিডারিটি গেমসে। যেখানে ১০০ মিটারে তাঁর টাইমিং হয়েছিল ১০.০১ সেকেন্ড। পরে অবশ্য সলিডারিটি গেমসে স্প্রিন্টের সব টাইমিং বাতিল করে কর্তৃপক্ষ। কারণ, টাইমিংয়ে নাকি যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল।
সব ছাপিয়ে গতকাল ইমরানুর নিজেকে নিয়ে গেছেন নতুন উচ্চতায়। বাংলাদেশের মৃতপ্রায় অ্যাথলেটিকসে নতুন আশার আলো দেখিয়েছেন। এখন দায়িত্ব অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের। সেই দায়িত্ব পালনে কতটা প্রস্তুত ফেডারেশন? ইমরানুরের সঙ্গে কাজাখস্তান সফরে থাকা বাংলাদেশ অ্যাথলেটিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রকিব আজ ফোনে প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘আমাদের দায়িত্ব বেড়ে গেছে এখন। অবশ্যই সেই দায়িত্ব পালনে চেষ্টা করব। আমরা সরকারের শীর্ষ মহলসহ স্পনসরদের কাছে যাব, যাতে ইমরানুর আর্থিক সমর্থনটা পায়। আমরা ওকে এখন দেশে নিয়ে আসছি, সংবর্ধনা দেব। তারপর দেখছি, কী করা যায়।’
গতকাল থেকে অনেক অভিনন্দন পেয়েছেন ২৯ বছর বয়সী অ্যাথলেট। কিন্তু এখন পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা নিয়ে তাঁর পাশে থাকার কার্যকর কোনো আশ্বাস কেউই দেয়নি। তাই সংবর্ধনা, অভিনন্দনের চেয়ে এখন বেশি জরুরি ইমরানুরকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া। তাঁর মধ্যে যে আগুন আছে, গতকালের পর তো এ নিয়ে কোনো সংশয় নেই।