প্যারিস অলিম্পিকে ব্যবহার করা সরঞ্জামগুলোর কী হবে
গ্যালারিগুলো নীরব। অলিম্পিক ভিলেজও খালি হয়ে যাচ্ছে। অ্যাথলেটরা ভিলেজ ছেড়ে যাচ্ছেন। প্যারিস অলিম্পিক শেষ হয়েছে গতকাল। এবারের অলিম্পিক আয়োজনে যেসব সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলোর কী হবে? উত্তর হলো, আয়োজকদের এসব নিয়েও পরিকল্পনা আছে।
দশকের পর দশক ধরে অলিম্পিক নিয়ে বিশাল অঙ্কের অপচয়ের দুর্নাম আছে। কখনো কখনো এমনও দেখা গেছে, দুই সপ্তাহের এই ক্রীড়াযজ্ঞ শেষে স্টেডিয়ামগুলো পতিত পড়ে থেকে নষ্ট হয়। কিন্তু প্যারিস এবার ভিন্ন কিছু করতে চায়। নির্মাণের ঝামেলা এড়াতে তারা অস্থায়ী ভেন্যু ব্যবহার করেছে। তবে অলিম্পিক আয়োজনে বিভিন্ন সরঞ্জাম সরবরাহকারীদের আয়োজকেরা বলেছেন, এসব সরঞ্জামকে ‘দ্বিতীয় জীবন’ দেওয়ার ব্যাপারে ভাবার জন্য। বিচ ভলিবলের বালু থেকে শুরু করে ব্যবহৃত টেনিস বলকেও পুনরায় কাজে লাগাতে চান আয়োজকেরা।
গত সপ্তাহে বার্তা সংস্থা এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্যারিস ২০২৪ সাসটেইনবিলিটির পরিচালক জর্জিনা গ্রেনন বলেছেন, ‘আমরা কোনো কিছু অর্ডার দেওয়ার আগে ভেবেছি, পরবর্তী সময়ে (অলিম্পিক শেষে) এটার কী হবে।’
বৈশ্বিক কোনো ক্রীড়া আসর বিচারে এমন প্রচেষ্টা নতুন। জর্জিনার দল ফিফার ফুটবল টুর্নামেন্ট ও অতীতের অলিম্পিক আসর থেকে এ বিষয়ে ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করেছে, যেগুলো প্যারিস অলিম্পিকে কাজে লাগানো যাবে। এরপর তারা বুঝতে পেরেছে পথটা নিজেদেরই খুঁজে বের করতে হবে।
জর্জিনা ব্যাখ্যা করেন, ‘আমরা পরামর্শকও ভাড়া করেছিলাম এবং কেউ আমাদের বলতে পারবে না এগুলো অতীতে করা হয়েছে।’ তাঁর দলে ‘সার্কুলার ইকোনমি’তে (একটি প্রক্রিয়া যেখানে কোনো বস্তু বর্জ্য হয়ে ওঠে না এবং প্রকৃতিরও ক্ষতি হয় না)।
প্রথম ধাপটি ছিল ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’খ্যাত অলিম্পিক আয়োজনে যা যা প্রয়োজন, তার একটি তালিকা প্রস্তুত করা।
জর্জিনার ভাষায়, ‘ব্যাপারটা অনেকটাই বিয়ের আয়োজনের মতো। ধরুন ১০০ অতিথি আসবেন, তাহলে আপনার প্রয়োজন ১০টি টেবিল এবং ১০০টি চেয়ার।’ প্যারিস অলিম্পিকে ৩২টি আলাদা ডিসিপ্লিনে খেলা হয়েছে এবং দর্শকসংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি। জর্জিনা বলেন, ‘প্রায় ৬০ লাখ সরঞ্জামের তালিকা হয়েছে, ৬০ লাখ বস্তু।’
সেসব সরঞ্জাম সংগ্রহের জন্য দেওয়া প্রতিটি দরপত্রেই একটি শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছিল—সরবরাহকারীরা যেসব সরঞ্জাম সরবরাহ করবেন, সেগুলো পরবর্তী সময়ে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সে বিষয়ে পরিকল্পনা দিতে হবে। জর্জিনা এ বিষয়ে বলেছেন, ‘আমরা এটা করেছি, কারণ তারা যেন বুঝতে পারে আমরা শুধু কোনো বস্তু কিনতে চাচ্ছি না। পরবর্তী সময়ে এর সেরা ব্যবহারটা কী হবে, সেটা তাদেরকেই বের করতে হবে।’
প্যারিস অলিম্পিকে ব্যবহার করা অনেক সরঞ্জাম ও স্থাপনা প্যারালিম্পিকসে ব্যবহার করা হবে। প্যারিসে ২৮ আগস্ট থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হবে প্যারালিম্পিকস। কিন্তু এরপর সেগুলোর নতুন ঠিকানা হবে।
আইফেল টাওয়ারের সামনে বিচ ভলিবলের ভেন্যু করা হয়েছিল। সেখানকার মিহি বালু প্যারিসের একটি ক্লাবে দেওয়া হবে। বিজয় মঞ্চ থেকে প্যারিস অলিম্পিকের লোগো সরিয়ে ফেলা হবে, যেন সেটা অন্য কোথাও কাজে লাগানো যায়। ফরাসি প্রতিষ্ঠান ‘লাইরেকো’র কাছ থেকে লিজ নেওয়া ৬ লাখ আসবাব ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং ওই প্রতিষ্ঠান এসব আসবাব দিয়ে ‘সেকেন্ড হ্যান্ড’ আসবাবের ব্যবসা শুরু করবে।
এবারের অলিম্পিক ভিলেজের জন্য প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার করে ১৪ হাজারের বেশি ম্যাট্রেস বানানো হয়েছিল। সেগুলো ফরাসি সামরিক বাহিনীকে দেওয়া হবে। টেনিস ইভেন্টে যেসব টেনিস বল ব্যবহার করা হয়েছে, সেসব বল দান করা হবে ফ্রান্সের খেলাধুলার ক্লাবগুলোয়। অন্যান্য খেলা যেমন জ্যাভেলিন থ্রোর বর্শা কিংবা শট পুটের সরঞ্জামও দান করা হবে।
জর্জিনা জানিয়েছেন, ব্যবহার করা ৬০ লাখ সরঞ্জামের মধ্যে ৯০ শতাংশের পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করেছেন আয়োজকেরা। স্যুভেনির হিসেবে এসব সরঞ্জাম কিনে রাখার সুযোগও পাচ্ছেন ভক্তরা। যেমন ধরুন পদক নেওয়ার সময় যে পতাকা ব্যবহার করা হয়েছে কিংবা গেমস শুরুর আগে রিলের জন্য যে মশাল বানানো হয়েছে, এসব স্যুভেনির হিসেবে কিনে সংগ্রহে রাখতে পারবেন ভক্তরা। দুটি সুইমিংপুল, ক্লাইম্বিং ওয়াল এবং স্কেটবোর্ডিং পার্কও স্থানান্তর করা হবে। এগুলো পুনরায় স্থাপন করা হবে প্যারিসের সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চলে।
তবে এসবের মধ্যেও সমালোচনা শুনতে হচ্ছে প্যারিস অলিম্পিকের আয়োজকদের। সেটি পরিবেশ সংরক্ষণগত অবস্থানের কারণে। এবার অলিম্পিকের করপোরেট স্পনসর ইস্পাত প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান আর্ককেলর ও গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান টয়োটা। তারা এবারের অলিম্পিককে ‘গ্রিনওয়াশিং’ বলায়ও সমালোচনা হচ্ছে।
অলিম্পিকের স্পনসর কোকাকোলা এবার লাখ লাখ প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করেছে, যদিও আয়োজকেরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকের তুলনায় প্যারিসে একবার ব্যবহার করা যায়, এমন প্লাস্টিক বোতলের ব্যবহার ৫০ শতাংশ কমানো হবে।
পরিবেশবাদীরা বিশ্বাস করেন, অলিম্পিক চরিত্রগতভাবে পরিবেশের জন্য টেকসই নয়। কারণ, বিশাল নির্মাণযজ্ঞ এবং অ্যাথলেট ও দর্শকদের কারণে বিমান ফ্লাইটে প্রচুর পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয়। কিন্তু জর্জিনা বিশ্বাস করেন, প্যারিস অলিম্পিক এমন ধারণা পাল্টে দেবে, ‘আমরা সব সময়ই বলে এসেছি আমরা এই গেমসকে পরীক্ষাগারে রূপান্তরিত করতে চেয়েছি এবং এখান থেকে আমরা এগিয়ে যেতে চেয়েছি।’