বাংলাদেশের অ্যাথলেটরা খুব বেশি চান না

ঢাকার বাইরে প্রতিযোগিতা হলে ঘাসের মাঠেই দৌড়াতে হয় অ্যাথলেটদেরছবি: প্রথম আলো

আন্তর্জাতিক মানের সূচি মেনে অনুশীলনের স্বপ্ন দীর্ঘদিন ধরে দেখছেন মোহাম্মদ ইসমাইল। বিদেশি কোনো কোচের কাছ থেকে সেই অনুশীলন সূচি পাওয়ার সুযোগ ছিল না দেশের চারবারের দ্রুততম মানবের। অবশেষে তাঁকে একটা আন্তর্জাতিক অনুশীলন সূচি দিয়েছেন জাপানি অ্যাথলেট লিজুকা সোতা। বাংলাদেশ ও জাপানের ৫০ বছরের কূটনৈতিক সম্পর্কের পূর্তি উপলক্ষে গত নভেম্বরে ঢাকায় আসেন রিও অলিম্পিকে রুপাজয়ী জাপানি অ্যাথলেট। ইসমাইলের অনুরোধে একটি আন্তর্জাতিক অনুশীলন সূচি তৈরি করে দিয়েছেন সোতা।

শুধু ইসমাইল নন, বাংলাদেশের সব অ্যাথলেটেরই চাওয়া আন্তর্জাতিক মানের অনুশীলন–সুবিধা। কিন্তু অনেক অ্যাথলেটই অনুশীলনের পর্যাপ্ত সুবিধা পান না। বাংলাদেশের অ্যাথলেটদের বড় অংশ চাকরি করেন সার্ভিসেস সংস্থায়। কিন্তু সিনথেটিক ট্র্যাক নেই বেশির ভাগ সংস্থার। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাথলেটরা অনুশীলন করেন বনানী আর্মি স্টেডিয়ামে। শুধু এই স্টেডিয়ামেই আছে সিনথেটিক ট্র্যাক। কিন্তু নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), বাংলাদেশ জেল, বাংলাদেশ পুলিশ—সব দলেরই অনুশীলন চলে ঘাসের মাঠে।

বাংলাদেশ আনসার ৪ মাস আগে গাজীপুরের সফিপুর একাডেমিতে একটি সিনথেটিক ট্র্যাক বসিয়েছে। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে সেটির উদ্বোধন হয়নি। ভালো পারফরম্যান্সের জন্য সিনথেটিক ট্র্যাকের বিকল্প দেখেন না বাংলাদেশের দ্রুততম মানবী নৌবাহিনীর শিরিন আক্তার, ‘আমরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সিনথেটিক ট্র্যাকে দৌড়াচ্ছি। ঘাসের মাঠে সমস্যা হয় বলে আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে আগে বিকেএসপিতে অনুশীলন করতাম। কিন্তু সিনথেটিক ট্র্যাক লাগেই। এখানেই আমরা পিছিয়ে আছি।’

নৌবাহিনী কখনো শাহীনবাগের নেভি কলোনিতে, কখনো খিলক্ষেতে নিজস্ব ঘাসের মাঠে অনুশীলন করে। বিমানবাহিনীর অ্যাথলেটদের অনুশীলন ভেন্যু কুর্মিটোলা বঙ্গবন্ধু বেসের মাঠ। আর পুলিশ দলের অনুশীলন রাজারবাগ পুলিশ লাইনস মাঠে।

এখনও সিনথেটিক টার্ফে অনুশীলনের পর্যাপ্ত সুবিধা নেই অ্যাথলেটদের
ছবি: প্রথম আলো

বিজিবির অ্যাথলেটদের ঢাকায় অনুশীলনের ব্যবস্থা নেই। কখনো দিনাজপুর, কখনো বান্দরবানে অনুশীলন করতে হয় তাঁদের। শুধু প্রতিযোগিতা শুরুর আগে ঢাকায় বিজিবি সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয় অ্যাথলেটদের। কাশিমপুর কারাগারের ছোট মাঠে অনুশীলন করেন বাংলাদেশ জেল দলের অ্যাথলেটরা। মাঝেমধ্যে বিকেএসপিতে অনুশীলনের সৌভাগ্য হয় তাঁদের।

সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী ও বিজিবির অ্যাথলেটদের চাকরির শুরুতেই নিতে হয় বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ। সেনাবাহিনীর অ্যাথলেটরা চাকরিতে যোগ দেওয়ার প্রথম বছরে অস্ত্র পরিচালনাসহ সৈনিকের অন্যান্য আনুষঙ্গিক প্রশিক্ষণ নেন। নৌবাহিনীর অ্যাথলেটদের ছয় মাসের প্রশিক্ষণ কমিয়ে বর্তমানে এক মাস করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ শেষে নির্ধারিত ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের অধীনে অ্যাথলেটরা অনুশীলনে নামেন।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্প্রিন্টার সুসমিতা ঘোষ বলছিলেন, ‘সেনাবাহিনীর পেশাদার প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর ফিটনেস থাকলেও অ্যাথলেটিকসে অংশ নিতে শরীর সাড়া দেয় না। ট্র্যাকে ফিরতে এ জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয় আমাদের।’

তা ছাড়া সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর অ্যাথলেটদের অনেকে ক্যারিয়ারের মাঝপথে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে চলে যান বিভিন্ন দেশে। এতেও অ্যাথলেট সত্ত্বা হারিয়ে যেতে বসে সম্ভাবনাময় অনেকের। জাতীয় প্রতিযোগিতায় নৌবাহিনীর হয়ে সোনা জেতা হাই জাম্পার সজীব হোসেন বর্তমানে জাতিসংঘ মিশনে কুয়েতে আছেন।

আমরা ঘাসের মাঠে অনুশীলন করি। প্রতিযোগিতার আগে আর্মি স্টেডিয়ামে চিঠি দিয়ে অনুশীলনের আবেদন করি। কিন্তু সব সময় অনুমতি মেলে না।
আশরাফুল ইসলাম, বিমানবাহিনীর কোচ

গত ডিসেম্বরে ছুটিতে দেশে ফিরে আর্মি স্টেডিয়ামে জাতীয় অ্যাথলেটিকস দেখতে এসে বলেছিলেন, ‘অনেক চেষ্টা করেছি জাতীয় দলের ক্যাম্পে ফিরতে। কিন্তু ঠিকমতো অনুশীলন করতে পারিনি। এখন মিশনে যাওয়ায় আমার আর্থিক অনিশ্চয়তা কেটে গেছে। খেলায় ফেরার সম্ভাবনা তাই কম।’

আরও পড়ুন

বিমানবাহিনীর অ্যাথলেটরা নিয়মিত অনুশীলনের চেয়ে সংস্থার প্রশিক্ষণে গুরুত্ব দেন বেশি। যে কারণে জাতীয় অ্যাথলেটিকসে বিমানবাহিনীর আধিপত্যও কম। বিমানবাহিনী থেকে সর্বশেষ দেশের দ্রুততম মানব হয়েছিলেন হাফিজুর রহমান, ২০১১ সালে। বিমানবাহিনীর কোচ আশরাফুল ইসলাম বলছিলেন, ‘আমরা ঘাসের মাঠে অনুশীলন করি। প্রতিযোগিতার আগে আর্মি স্টেডিয়ামে চিঠি দিয়ে অনুশীলনের আবেদন করি। কিন্তু সব সময় অনুমতি মেলে না। তা ছাড়া আমাদের অ্যাথলেটদের ৩ বছরের বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ নিতে হয়। কোনো অ্যাথলেট ওই প্রশিক্ষণে গেলে অ্যাথলেটিকসের নিয়মিত অনুশীলনটাই ভুলতে বসে। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের রিকভারি করা কঠিন হয়ে পড়ে। এর প্রভাব পড়ে খেলায়।’

অ্যাথলেটরা অভিন্ন সুরে বলছেন, অনুশীলন–সুবিধা পেলে তাঁরা ভালো করবেন।
ছবি: প্রথম আলো

শটপুটের অনুশীলনের জন্য ভালো জায়গা পান না জেল দলের অ্যাথলেট ইমতিয়াজ হোসেন। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রের পাশের পুরোনো বাণিজ্য মেলার মাঠে অনুশীলন করেন ইমতিয়াজ। একটা ভালো মানের মাঠের চাওয়া তাঁর। ইমতিয়াজ বলছিলেন, ‘বড় একটা মাঠে অনুশীলন করতে পারলে আমার পারফরম্যান্স আরও ভালো হতো। আমি অনেক সময় রাতে পুরোনো বাণিজ্য মেলার মাঠে গিয়ে একা অনুশীলন করি। মাঠের পাশাপাশি আমার একটা স্পনসর দরকার।’

আরও পড়ুন
বাংলাদেশের অ্যাথলেটদের এগিয়ে চলার পথে পর্যাপ্ত অনুশীলন–সুবিধা না পাওয়া অন্যতম বড় বাধা। তাই সব অ্যাথলেটই অভিন্ন সুরে বলছেন, অনুশীলন–সুবিধা পেলে তাঁরা ভালো করবেন

বাংলাদেশ পুলিশের অ্যাথলেট মোহাম্মদ ফয়সাল প্রতিযোগিতা শুরুর মাস তিনেক আগে দুই বেলা অনুশীলন করেন। কিন্তু পেশাগত কাজও করতে হয় তাঁকে। ফয়সাল বলেন, ‘পেশাগত দায়িত্বের কারণে সেভাবে টানা অনুশীলন করতে পারি না। এর ফলে সেটার প্রভাব খেলায় পড়ে। আমি চাই, অনুশীলন যেন ভালোভাবে করতে পারি। আর সেটা করতে পারলে আন্তর্জাতিক পদক জেতা খুব কঠিন নয়।’

বাংলাদেশের অ্যাথলেটদের এগিয়ে চলার পথে পর্যাপ্ত অনুশীলন–সুবিধা না পাওয়া অন্যতম বড় বাধা। তাই সব অ্যাথলেটই অভিন্ন সুরে বলছেন, অনুশীলন–সুবিধা পেলে তাঁরা ভালো করবেন।