গতকাল সোমবার দিবাগত রাত দেড়টায় যখন কঙ্গোগামী উড়োজাহাজে উঠছিলেন, তাঁর মনটা তখন নিশ্চিতভাবেই পড়ে ছিল দেশে। আরও স্পষ্ট করে বললে বাংলাদেশ আর্চারি দলে, ২০১৭ সাল থেকেই যে দলের অবিচ্ছিন্ন অংশ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ছয় বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে বাংলাদেশকে জিতিয়েছেন ৪টি সোনাসহ ১৩টি পদক।
চারটি সোনার তিনটিই এসেছে গত বছর এশীয় পর্যায়ে একই টুর্নামেন্ট থেকে। এ কৃতিত্ব বাংলাদেশের আর্চারদের মধ্যে কেবল তাঁরই। এরই স্বীকৃতি হিসেবে গত ২৮ মে পেয়েছেন বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশনের ২০২২ সালের বর্ষসেরা আর্চারের পুরস্কার। সেই সুখস্মৃতির রেশকে আর্চারির সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটানোর বেদনায় চাপা দিয়ে দেশ ছেড়েছেন নাসরিন আক্তার।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ল্যান্স করপোরাল নাসরিন সুযোগ পেয়েছেন জাতিসংঘ মিশনে কঙ্গোতে। সেখানে তাঁর দায়িত্ব দাপ্তরিক কাজ সামলানোর। নতুন দেশ, নতুন পরিবেশে যাওয়ার রোমাঞ্চের আনন্দ তাঁর নেই। নাসরিনের মনটা বরং বিষণ্ন। খেলার প্রিয় অঙ্গনটিই যে ছেড়ে যাচ্ছেন। তাঁর কথায়ও সেই বিষণ্নতার ছোঁয়া, ‘কঙ্গোতে যাচ্ছি, কিন্তু খুবই খারাপ লাগছে। সবার সঙ্গে অনুশীলন করতে পারব না, বিদেশে খেলতে যেতে পারব না। সবকিছুই মিস করতে শুরু করেছি।’
আগস্টের শেষ দিকে মালিতে যাবেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের আরেক আর্চার রোকসানা আক্তার। সেনাবাহিনীর সৈনিক রোকসানার অর্জনের খাতায়ও আছে চারটি সোনাসহ ৮-৯টি আন্তর্জাতিক পদক।
নাসরিন-রোকসানা দুজনই মিরপুরের সরকারি বাঙলা কলেজ থেকে উঠে এসেছেন শারীরিক শিক্ষক ও আর্চারি সংগঠক ফারুক ঢালীর হাত ধরে। সেপ্টেম্বর–অক্টোবরে চীনের হাংজু শহরে অনুষ্ঠেয় আগামী এশিয়ান গেমসের বাংলাদেশ দলে এই দুজনেরই থাকার কথা ছিল। কিন্তু জাতীয় দলের ক্যাম্প থেকে দুজনই স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নিয়েছেন। নাসরিন জানুয়ারিতে, রোকসানা ফেব্রুয়ারিতে।
দুজনই এক বছর করে থাকবেন মিশনে। তাই অন্তত দেড় বছরের জন্য তাঁদের হারাচ্ছে বাংলাদেশের আর্চারি। ফিরে এসে জায়গা পাওয়া কঠিন। চাইলে তো না–ও যেতে পারতেন। নাসরিন বললেন চলে যাওয়ার কারণটা, ‘বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (বিওএ) খেলোয়াড়দের বৃত্তি দেয়। আমাদের কোচ মার্টিন ফ্রেডরিখের পরামর্শে আমিও আবেদন করেছিলাম। কিন্তু বৃত্তি পাইনি। ফ্রেডরিখ তখন বলেছিলেন, “তোমার আর্থিক ব্যবস্থা করতে পারিনি, এখন আটকাই কী করে?” বৃত্তি পেলে হয়তো মিশনে যেতাম না।’
২০২৪ প্যারিস অলিম্পিকের স্কলারশিপ প্রোগ্রামের অধীনে বিওএ দুজন শুটার আর তিনজন আর্চারকে বৃত্তি দিচ্ছে। আর্চারিতে পাচ্ছেন দিয়া সিদ্দিকী, হাকিম আহমেদ ও আবদুর রহমান; শুটিংয়ে রাব্বি হাসান ও নাফিসা তাবাসসুম। দিয়ার জন্য বরাদ্দ মাসে ১ হাজার ২৫০ ডলার। বাকিদের ১ হাজার ৫৬২ ডলার করে। এই অর্থের বড় অংশই যায় খেলোয়াড়ের প্রশিক্ষণ খাতে। বিওএ অর্থ পাঠায় ফেডারেশনের কাছে। সেখান থেকে একটা অংশ পান খেলোয়াড়েরা।
অর্থই আসলে মূল বিবেচ্য। আর্থিকভাবে লাভবান হন বলেই খেলোয়াড়েরা মিশনে যান। কিন্তু এ সময়ের সেরা দুই আর্চারকে হারানো বাংলাদেশের জন্যই বড় ক্ষতি। কম্পাউন্ডে (৫০ মিটার দূরের লক্ষ্যে তির ছোড়া) মেয়েদের মধ্যে দেশসেরাদের একজন রোকসানা। নাসরিন রিকার্ভের (৭০ মিটার দূরের লক্ষ্যে তির ছোড়া) গত অলিম্পিক গেমসে খেলা দিয়া সিদ্দিকীর প্রবল প্রতিপক্ষ।
বাংলাদেশের ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় ২০২২ সালে দিয়া চ্যাম্পিয়ন হলেও ২০২১ বাংলাদেশ গেমসে সেরা ছিলেন নাসরিন। নাসরিন জানান, কোচ ফ্রেডরিখও কদিন আগে তাঁকে বলেছেন, ‘তোমার মতো কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না। তোমার মতো কাউকে বানাতেও পারিনি। তুমি ফিরে এসো।’ এ কথা বলে যোগ করেন, ‘আমিও আসলে আর্চারিতে ফিরতে চাই।’
তবে নাসরিনের আবার ফিরে আসা সহজ নয়। এই দেড় বছরে ফিটনেস কমে যাবে অনেকটাই। দেশে ফিরে নিজ দল সেনাবাহিনীতে ট্রায়াল দেবেন নাসরিন। জাতীয় দলে সুযোগের লড়াইয়েও নামতে চান। অনিশ্চয়তা তবু থেকেই যাচ্ছে। ২০১৭ সালে তিনি জাতীয় দলের ক্যাম্পে এসেছিলেন প্রথম। ২০১৮ থেকে তাঁর আন্তর্জাতিক পদক পাওয়া শুরু। তা–ও রোমান সানার সঙ্গে মিশ্র দলগতে সোনা জিতে। এত দিন রোমান-দিয়ার আলোর ঝলকে ঢাকা ছিলেন বলে নাসরিনের একটু আক্ষেপ আছে।
২০২২ সালটা তাঁকে চিনিয়েছে। মার্চে থাইল্যান্ডের ফুকেটে এশিয়া কাপ আর্চারি স্টেজ ওয়ানে জেতেন তিনটি সোনা! রিকার্ভ ব্যক্তিগতের ফাইনালে হারান দিয়াকে। মিশ্র দলগত বিভাগে রোমানের সঙ্গে সোনা। ফাহমিদা সুলতানাকে সঙ্গী করে দলীয় সোনা। ১১ মে ইরাকের সুলাইমানিয়াহ শহরে এশিয়া কাপ স্টেজ টুতে রিকার্ভ নারী দলগত বিভাগে দিয়া ও বিউটি রায়ের সঙ্গে রুপা।
অথচ পরিবার রাজিই ছিল না মেয়েকে খেলায় দিতে। সব বাধা পেরিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার পর এখন আর্চারিকে আপাতত বিদায় জানাতে হচ্ছে নাসরিনকে। বাস্তবতা বুঝতে পেরে গুরু ফারুক ঢালী শুভকামনা জানিয়ে তাঁকে বলছেন, ‘ফিরে এসো, নাসরিন।’