১০.১ সেকেন্ড! বাংলাদেশের স্প্রিন্টারদের জন্য স্বপ্নের টাইমিং। বিলাতের আলো–হাওয়ায় বেড়ে ওঠা ইমরানুর রহমান ১০০ মিটার দৌড়ালেন ১০.০১ সেকেন্ডে! তুরস্কের কোনিয়া শহরে চলমান পঞ্চম ইসলামিক সলিডারিটি গেমসে এই টাইমিং করেছেন এই স্প্রিন্টার। ১০০ মিটারের ফাইনালে উঠে শেষ পর্যন্ত হয়েছেন ষষ্ঠ। বাংলাদেশের বিবর্ণ অ্যাথলেটিকসে যা বড় এক অর্জনই।
ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ান ও এশিয়ান গেমসে পদক এনে দিতে চান ইমরান। কিন্তু ইমরানুরের পক্ষে একটি সার্বক্ষণিক ও একটি খণ্ডকালীন চাকরি সামলে সেই স্বপ্নপূরণ দিন দিন কঠিন হয়ে পড়েছে। ইংল্যান্ড থেকে কাল ফোনে দেওয়া এই সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে সেই যুদ্ধের কথা। সঙ্গে চোট সারিয়ে নিজেকে আগামীর জন্য তৈরির প্রত্যয়ও—
তুরস্ক থেকে ইংল্যান্ডে ফিরে এখন কী করছেন?
ইমরানুর রহমান: কিছুটা বিশ্রাম নিচ্ছি। ডান পায়ের চোট সারানোর প্রক্রিয়ায় আছি। তিন–চার সপ্তাহ পুনর্বাসনে থাকতে হবে। হাঁটতে কিছুটা সমস্যা হয়। এ সপ্তাহেই ডাক্তারের কাছে যাব। সময়টা আসলে ভালো যাচ্ছে না।
সময় ভালো যাচ্ছে না চোটের কারণে, নাকি অন্য কোনো সমস্যা?
ইমরানুর: সব মিলিয়েই। আপাতত পূর্ণাঙ্গ অনুশীলন হয়তো করছি না, কিন্তু সেরে উঠলেই তো চাকরি সামলে পুরোদমে অনুশীলন করতে হবে। বছরের বেশির ভাগ সময় আমি দুটি চাকরি করি।
সকাল সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে নয়টা অনুশীলন। শেফিল্ডে একটা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে হিসাবরক্ষক হিসেবে ১০–৫টা পর্যন্ত সপ্তাহে পাঁচ দিন আমার পূর্ণাঙ্গ অফিস। অফিস শেষে সাড়ে পাঁচটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত জিম করি। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা থেকে রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত একটা খণ্ডকালীন চাকরি করি সপ্তাহে পাঁচ–সাত দিন। বুঝতেই পারছেন সকাল সাড়ে সাতটা থেকে রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত আমার কী পরিমাণ ব্যস্ততা।ইমরানুর রহমান
বলেন কী! দুটি চাকরি! দুটি চাকরি করে অনুশীলন করা কতটা কঠিন?
ইমরানুর: অনেক কঠিন। দুটি সামলানো সহজ ব্যাপার নয়।
প্রশ্ন :
আপনার দৈনিক সূচি তাহলে কী?
ইমরানুর: সকাল সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে নয়টা অনুশীলন। শেফিল্ডে একটা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে হিসাবরক্ষক হিসেবে ১০–৫টা পর্যন্ত সপ্তাহে পাঁচ দিন আমার পূর্ণাঙ্গ অফিস। অফিস শেষে সাড়ে পাঁচটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত জিম করি। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা থেকে রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত একটা খণ্ডকালীন চাকরি করি সপ্তাহে পাঁচ–সাত দিন। বুঝতেই পারছেন সকাল সাড়ে সাতটা থেকে রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত আমার কী পরিমাণ ব্যস্ততা। চাকরি সামলে খেলাটা আমার জন্য ভীষণ কঠিন হয়ে পড়েছে।
প্রশ্ন :
চাকরি করতে না হলেই ভালো হতো মনে করছেন?
ইমরানুর: অবশ্যই। শুধুই খেলা নিয়ে থাকলে আমার জন্য ভালো হতো। শারীরিক ও মানসিক বিশ্রাম নিয়ে পরদিন অনুশীলন করতে পারতাম। অনুশীলনের মান এবং পারফরম্যান্সও তাতে ভালো হতো। কিন্তু সেটা এখন হচ্ছে না।
প্রশ্ন :
চাকরি ছেড়ে শুধুই খেলা নিয়ে থাকার কোনো পথ কি নেই?
ইমরানুর: আপাতত নেই। খেলার জন্য অন্য কোনো উৎস থেকে আর্থিক সহায়তা না পাওয়া পর্যন্ত চাকরি ছাড়তে পারব না। আসলে শীর্ষ অ্যাথলেটদের আর্থিক সমর্থন থাকে। দেখুন, শ্রীলঙ্কার অ্যাথলেট পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বৃত্তি নিয়ে ইতালিতে আছে, দেশ থেকে সে সব রকম সহায়তা পায়। চাকরি করে না, শুধু খেলা নিয়েই ভাবে। পাকিস্তানের অ্যাথলেটও দেখলাম চাকরি করে না। এটা ওদের জন্য বিরাট সুবিধা।
প্রশ্ন :
তাহলে এখন কীভাবে অ্যাথলেট হিসেবে সামনে এগোবেন?
ইমরানুর: কিছু করার নেই। আমার পরিস্থিতি পুরো ভিন্ন। আমাকে একটি পূর্ণাঙ্গ ও একটি খণ্ডকালীন চাকরি করতে হচ্ছে। আপনি যখন বেশির ভাগ সময় চাকরিতেই থাকেন, তখন ক্লান্তির কারণে আপনার চোটের শঙ্কা থাকে। তাতে ফলও ভালো হয় না।
প্রশ্ন :
বারবার খেলার জন্য যে অফিস থেকে ছুটি নেন, সমস্যা হয় না?
ইমরানুর: আগে হতো না। এখন হচ্ছে। আমার বারবার ছুটি নেওয়ার ব্যাপারটা ওরা ভালোভাবে নিচ্ছে না। এটা নিয়ে ওরা আমার সঙ্গে এরই মধ্যে কথা বলেছে। ওরা কিছুটা রাগান্বিতও। আমি টাকা পাই সেখান থেকে, ঠিকমতো কাজ করতে না পারলে আমাকে অন্য কিছু দেখতে হবে। এই ইঙ্গিত তারা আমাকে দিয়ে দিয়েছে। এখন পরিস্থিতি যা, সামনে খুব একটা ছুটি নিতে পারব বলে মনে হয় না।
প্রশ্ন :
তাহলে তো আপনি বিরাট সমস্যায় আছেন...
ইমরানুর: বিরাট সমস্যা। এটা আসলে বলে বোঝানো যাবে না। আমার লড়াই, সংগ্রাম কেউ দেখে না। সবাই শুধু ফল চায়। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভালো করা কঠিন।
প্রশ্ন :
বাংলাদেশের অ্যাথলেটিকসে আপনি নতুন আশা দেখিয়েছেন। বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন বা অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন থেকে আর্থিক সহায়তা পান না?
ইমরানুর: আমাকে তারা ভালো করতে উৎসাহ দেয়। আর্থিক সহায়তা করবে বলেও জানিয়েছে। বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা এখন ইসলামিক গেমসে আছেন বিভিন্ন দায়িত্ব নিয়ে। গেমসটা শেষ হোক। এ নিয়ে এখন তাই কিছু বলব না। তবে আমার পক্ষ থেকে তাঁদের এটা দেখাতে হবে যে আমি ভালো করতে পারি।
প্রশ্ন :
সহায়তা করবে, সেটা তো ভবিষ্যতের কথা। এখন আপনার অনুশীলন খরচ কে চালায়?
ইমরানুর: আমি নিজেই। কোচ আছে, তাঁকে সম্মানীও আমাকেই দিতে হয়।
প্রশ্ন :
তুরস্কে ১০.০১ সেকেন্ড সময় নিয়ে আপনি একটু চমকেই দিয়েছেন। আরেকটু হলেই ১০ সেকেন্ডের নিচে যেতে পারেন। সেটা কি সম্ভব বলে মনে করেন?
ইমরানুর: এখনই এতটা ভাবছি না। তবে ১০ সেকেন্ডের নিচে দৌড়ানোর সামর্থ্য আমার আছে। এ জন্য আরও কঠিন পরিশ্রম করতে হবে। তবে কাজটা সহজ নয়। নিখুঁত দৌড়, নির্দিষ্ট দিনে নিজেকে মেলে ধরা আর শারীরিক অবস্থা ঠিক থাকার ওপর তা নির্ভর করে।
প্রশ্ন :
১০.০১ সেকেন্ড টাইমিংটা কি আপনার নিজের কাছেও অপ্রত্যাশিত ছিল?
ইমরানুর: অপ্রত্যাশিতই ছিল। এতটা ভাবিনি।
প্রশ্ন :
ফাইনালে তো ১০.১৭ হয়েছে...
ইমরানুর: তখন আমি ক্লান্ত ছিলাম। একটু পেটের পীড়াও ছিল। আসলে সব সময় আপনি ভালো টাইমিং ধরে রাখতে পারবেন না। মানসিক অবস্থা ভালো থাকলে এবং শরীর সতেজ থাকলে ধারাবাহিকভাবে ভালো টাইমিং আসবে।
প্রশ্ন :
পরবর্তী দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে সোনা জয়ের কথা বলেছিলেন। এখন কি আত্মবিশ্বাস বেড়েছে?
ইমরানুর: দেখুন, আমি আমার সেরাটা দিচ্ছি এবং দেব। তাতে পদক এলে সেটা হবে দারুণ ব্যাপার। আমি সব সময় অন্য স্প্রিন্টারদেরও সম্মান করি। দক্ষিণ এশিয়ান গেমসের এখনো দেড়–দুই বছর বাকি। এই সময়ের মধ্যে আমার দরকার কঠিন প্রশিক্ষণ। ইনশা আল্লাহ আশা করি ভালো কিছুই হবে।
প্রশ্ন :
সেই ভালো কিছুটা কি শুধু দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে পদক জেতাতেই সীমাবদ্ধ?
ইমরানুর: না। শুধু দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে নয়, এশিয়ান গেমসেও পদক জিততে চাই। বাংলাদেশের হয়ে খেলা সব সময় আমার জন্য আনন্দের আর গর্বের। সামনে এশিয়ান ও বিশ্ব ইনডোর চ্যাম্পিয়নশিপে খেলব আশা করি।
প্রশ্ন :
এশিয়ান গেমস পদক জয়ের কথা বললেন, কিন্তু ওই গেমসে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে জেতা অনেক কঠিন।
ইমরানুর: জানি। তবে চেষ্টা করে যাব।
প্রশ্ন :
অবসর কি পান? পেলে কী করেন?
ইমরানুর: অবসর পাই না দুটি চাকরি, পরিবার, খেলা...হাতে আর সময় কই।
প্রশ্ন :
ইংল্যান্ড মানেই ফুটবল উন্মাদনা। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের খেলা দেখেন? আপনার প্রিয় দল কোনটি?
ইমরানুর: ফুটবল দেখি। প্রিয় দল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।
প্রশ্ন :
আপনার ক্রীড়া আদর্শ কে?
ইমরানুর: মোহাম্মদ আলী।