মৃত্যুর ৫৮ বছর পর গ্র্যান্ডমাস্টার হলেন দাবার ‘সুলতান’
দৃশ্য ১
অস্ট্রিয়ান ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার অব চেজ টুর্নামেন্ট। অস্ট্রীয় আন্তর্জাতিক মাস্টার হ্যান্স কেমোখ তো রেগে কাঁই। আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলছেন, প্রতিপক্ষকে হার স্বীকার করতে তিনবার সেধেওছেন। কিন্তু কী আশ্চর্য! জবাবে শুধু হাসছেন প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়। এমন হলে কার মেজাজ ঠিক থাকে? কেমোখও ধৈর্য হারালেন। কিছুটা চিৎকারসুলভ কণ্ঠেই পাশে একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার চ্যাম্পিয়ন কোন ভাষা জানে?’
কেমোখ যাঁকে প্রশ্নটি করেছিলেন, তিনি ব্রিটিশ দাবা চ্যাম্পিয়ন উইলিয়াম উইন্টার (১৮৯৭-১৯৫৫)। উইন্টারকে আরেকটু ভালোভাবে চেনাতে অন্য একটি পরিচয়ও দেওয়া যায়। তিনি বিখ্যাত ‘পিটার প্যান’ বইয়ের লেখক জে এম ব্যারির ভাগনে। যাহোক, উইন্টার সম্ভবত কেমোখের ধৈর্য হারানো উপভোগ করছিলেন। ছোট করে জবাবটা দিলেন, ‘দাবার ভাষা।’
কয়েক চাল পরই ড্র মেনে নিতে হয় কেমোখকে।
পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ‘ডন’–এর প্রতিবেদনে ঘটনাটা প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৫ সালের ৮ আগস্ট। কেমোখের সেই প্রতিপক্ষের নাম জেনে নিন পরের দৃশ্যে।
দৃশ্য ২
রবেন ফাইন (১৯১৪-১৯৯৩) যুক্তরাষ্ট্রের গ্র্যান্ডমাস্টার। ১৯৫০ সালে ফিদে এই খেতাব চালুর পর প্রথমবারেই অর্জন করেছিলেন। দাবা ও মনোবিদ্যা নিয়ে বেশ কিছু বইও লিখেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক। দাবা খেলা নিয়ে একটি ঘটনা তিনি উল্লেখ করেছেন নিজের বইয়ে। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ডন তার বইয়ের সেই ঘটনা উল্লেখ করেছিল ২০১৫ সালের ৮ আগস্ট প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে। ঘটনাটা জেনে নেওয়া যাক—
‘মহারাজার (মালিক উমর হায়াত খান) ঘরে ঢোকার পর তিনি অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, “আপনারা খুব ভাগ্যবান যে আমার দেখা পেয়েছেন। এই সময়ে আমি সাধারণত গ্রেহাউন্ডদের (শিকারি কুকুর) সঙ্গে কাটাতে পছন্দ করি।” এরপর তিনি নিজের জীবন ও কর্ম নিয়ে একটি পুস্তিকা ধরিয়ে দেন আমাদের হাতে। আমরাও ততক্ষণে বুঝে ফেলেছি, জন্মসূত্রে মহারাজা হওয়াটাই তাঁর বলার মতো একমাত্র পরিচয়। এরপর আমরা মির সুলতান খানকে দেখি, মহারাজা যার সঙ্গে দাসের মতো ব্যবহার করছিলেন। পরিস্থিতিটা আমাদের জন্য বিব্রতকর। কারণ, দাবার এক গ্র্যান্ডমাস্টার আমাদের সামনে বেয়ারা হিসেবে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আসলে তাঁর (সুলতান) নিমন্ত্রণেই আমরা মহারাজার বাড়িতে গিয়েছিলাম।’
দৃশ্য ৩
২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪। ইসলামাবাদ। বিশ্ব দাবা সংস্থার (ফিদে) সভাপতি আরকাদে দভরকোভিচ মরণোত্তর গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব তুলে দেন পাকিস্তানের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী আনোয়ারুল হক কাকারের হাতে। না, খেতাবটা কাকারের নয়, সেটি মির সুলতান খানের। ফিদের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘পাঞ্জাবের দাবাড়ু এবং পাকিস্তানের নাগরিক। তাঁর সময়ে তাঁকে এশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী দাবাড়ু বিবেচনা করা হতো। পাঁচ বছরেরও কম সময়ের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে তিনি তিনবার ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন। দাবার তত্ত্বজ্ঞান এবং এই খেলার বইপত্র প্রায় না পড়েই বিশ্বের সেরা কয়েকজন খেলোয়াড়কে হারিয়েছিলেন মির সুলতান খান। তিনি পাকিস্তানের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার।’
সুলতান ১৯৬৬ সালে মারা যান। ৫৮ বছর পর তাঁকে মরণোত্তর গ্র্যান্ডমাস্টারের খেতাব দিল ফিদে। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানও পেয়ে গেল তাদের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার। সেটি অবশ্য ভৌগোলিক কারণে। সুলতান যখন দাবার ৬৪ ঘরে সালতানাত কায়েম করেছিলেন, সমগ্র উপমহাদেশ তখন ব্রিটিশ শাসনের অধীন। সেই সালতানাতেরই শাহেনশাহ হিসেবে সুলতান কখনো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে না পারা ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বকালের অন্যতম সেরা হিসেবে স্বীকৃত পোলিশ কিংবদন্তি আকিবা রুবিনস্টেইনকে হারিয়েছিলেন। সেই রুবিনস্টেইন গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব পেয়ে যান জীবদ্দশাতেই—১৯৫০ সালে, ফিদে যে বছর থেকে এ খেতাব চালু করেছিল সেবারই। কিন্তু সুলতানকে অপেক্ষা করতে হয়েছে মৃত্যুর পরও। পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতার লাইনের মতো, ‘প্রতীক্ষাতে প্রতীক্ষাতে/ সূর্য ডোবে রক্তপাতে।’
সুলতান যদি হন দাবার ‘সূর্য’, তাহলে ৫৮ বছরের প্রতীক্ষায় বুকের ভেতর রক্তপাত না হওয়াই তো অস্বাভাবিক। তবে সুলতান যে খেতাবটা পাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন, সে কথাও জোর দিয়ে বলা যায় না। সে সময় অনেক বাঙালির মতোই ইউরোপে কনকনে ঠান্ডা আবহাওয়া তাঁর সহ্য হয়নি। মোহাম্মদ সেলিমকে নিশ্চয়ই মনে আছে? সেই যে কলকাতার মেটিয়াবুরুজ থেকে উঠে আসা খালি পায়ের ফুটবলার, উপমহাদেশের প্রথম ফুটবলার হিসেবে যিনি খেলেছিলেন ইউরোপীয় ক্লাবে (সেল্টিক)—স্কটল্যান্ডের আবহাওয়া সহ্য না হওয়ায় এবং দেশের টানে সেলিমও ফিরে এসেছিলেন। সুলতানও তা–ই। ইংল্যান্ড থেকে ফিরে যেন ‘মুক্তি পেয়েছিলেন’।
কিন্তু সুলতানের এই গল্প মুক্তির নয়। এ গল্প আসলে সাময়িক সাফল্য পাওয়ার পর লোকচক্ষুর অন্তরালে মিলিয়ে যাওয়ার!
********
২০২০ সালের ১৭ মে ‘ডন’–এ সুলতানকে নিয়ে একটি লেখা প্রকাশ হয়েছিল—‘চেস: র্যাথ অব সুলতান’। লিখেছিলেন সুলতানেরই বড় ছেলে পাকিস্তান পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত আইজি আতহার সুলতান ও নাতনি আতিয়াব সুলতান। আতিয়াব কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করে পাকিস্তান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে কর্মরত। তাঁদের দাবি অনুযায়ী, সুলতানের জন্ম ১৯০৩ সালে। যদিও নিউইয়র্ক টাইমস অন্য সূত্র মারফত গত বছর ২৭ মে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানিয়েছে, তাঁর জন্মসালটা ১৯০৫-ও হতে পারে। তবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, সুলতানের জন্ম বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাবে সারাগোদা বিভাগের খুশাব শহরের মিঠা তিওয়ানা অঞ্চলে। তাঁর পূর্বপুরুষেরা পীর ও জমিদারদের মুসলিম আওয়ান গোত্রের (যাঁরা বিশ্বাস করে তাঁরা আরব বংশোদ্ভূত)। বাবা মিয়া নিজাম দিনের কাছে দাবার চাল শিখেছিলেন সুলতান। কৈশোরেই বোঝা গিয়েছিল তাঁর প্রতিভা। প্রায় প্রতিদিনই সারাগোদা শহরে যেতেন জমিদার ও দাবাপ্রেমীদের সঙ্গে খেলার জন্য। তাঁর বয়স যখন ২১ বছর, পাঞ্জাবে তাঁর চেয়ে ভালো দাবাড়ু আর কেউ ছিলেন না।
আতহার সুলতান ও আতিয়াব সুলতানের যৌথ সে কলামেই উঠে এসেছে সুলতানের এসব গল্প। সুলতান দ্রুতই নজরে পড়েন সারাগোদার পাশের অঞ্চল কালরার জমিদার ও মেজর জেনারেল স্যার উমর হায়াত খান তিওয়ানার। এই স্যার উমর তিওয়ানাই রবেন ফাইনের সেই মহারাজা। ব্রিটিশ আনুগত্য মেনে গোটা পাঞ্জাবের অন্যতম বড় ও প্রভাবশালী জমিদার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন তিনি। শিল্প ও খেলাধুলার পৃষ্ঠপোষক হতে উন্মুখ উমর হায়াত সুলতানকে দেখে যেন হাতে চাঁদ পেলেন! আতহার সুলতান ও আতিয়াব সুলতানের লেখা সেই কলামের ভাষায়, ‘সুলতানকে তিনি (উমর হায়াত) একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন: বৃত্তি ও থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়ার বিনিময়ে সুলতান তাঁকে তাঁর জমিরদারিতে একটি দাবার দল গঠন করে দেবেন।’
এখানে এসে একটু খটকা লাগে। রবেন ফাইনের দাবি অনুযায়ী সুলতান স্যার উমর হায়াতের চাকর ছিলেন। সত্যিটা কী, সেটি জানার সুযোগ আর নেই হয়তো। তবে এটুকু বোঝা যায়, সুলতানের আন্তর্জাতিক দাবা ক্যারিয়ার সম্পূর্ণভাবে উমর হায়াতের দয়াদাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল।
উমর হায়াতের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে সুলতান কালরায় চলে যান। ১৯২৮ সালে অল ইন্ডিয়া চেস চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন। ৯ গেমে মাত্র আধা পয়েন্ট খুইয়ে চ্যাম্পিয়ন! পরের বছর বসন্তে সুলতানকে নিয়ে ইংল্যান্ড যাত্রা করেন উমর হায়াত এবং সেখানে কুলীন ইমপেরিয়াল চেস ক্লাবের সদস্য হন সুলতান। সে সময় দাবা খুব ব্যয়বহুল এবং অভিজাতদের খেলা ছিল। দাবা ক্লাবের সদস্য হতে এবং টুর্নামেন্টে অংশ নিতে ফি দিতে হতো প্রচুর। ১৯২৯ সালে ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপে সুলতানের অংশ নেওয়ার টাকাটা কে দিয়েছিলেন, সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু জানা যায়নি।
তবে প্রতিযোগিতায় কেমন খেলেছিলেন, সেটি জানিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস তাদের ‘ওভারলুকড’ সিরিজ প্রতিবেদনে। যে কীর্তিমানদের মৃত্যুতে সময়মতো শ্রদ্ধা জানাতে পারেনি সংবাদমাধ্যমটি, তাঁদের জন্য দেরিতে হলেও সিরিজটি চালু করা হয়েছিল এবং সেখানে সুলতানের প্রথম ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা নিয়ে বলা হয়েছে, ‘জুলাই ১৯২৯। চ্যাথাম হাউস স্কুলে উপস্থিত ১২ দাবাড়ু। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন মাস্টার দাবাড়ুও ছিলেন...কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হলেন এমন একজন, যাকে অন্যরা সেভাবে চিনতেন না। হুমকি বলেও মনে করেননি। আর সে সময় ইউরোপ ছিল দাবা–বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু। চ্যাম্পিয়ন হওয়া সেই খেলোয়াড় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রত্ন ভারতের মির সুলতান খান।’
ইউরোপ ও উপমহাদেশের দাবা খেলার নিয়মে তখন পার্থক্য ছিল। ভারতীয় নিয়মে প্রথম চালে বড়ে দুই ঘর এগোতে পারবে না। ক্যাসলিংয়ের নিয়মও আলাদা ছিল। আর রাজা অন্তত একটি চালে মন্ত্রীর মতো এগোতে পারবে। উমর হায়াতের সঙ্গে ইউরোপে যাওয়ার আগপর্যন্ত সুলতান সেখানকার দাবা খেলার নিয়ম সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। বাবার কাছে শেখা ভারতীয় খেলার ধরনই ছিল তাঁর পুঁজি।
অর্থাৎ ইউরোপীয়দের মুখোমুখি হওয়ার আগে সুলতানকে তাঁদের নিয়মের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয়েছিল। ব্যাপারটা কত কঠিন ছিল, তা আন্দাজ করে নেওয়া যায়। এর সঙ্গে যোগ করুন, দাবা নিয়ে সুলতানের পুঁথিগত বিদ্যায় অজ্ঞতা। খেলা কীভাবে শুরু করতে হবে, সেসব তত্ত্বজ্ঞান সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানতেন না, যেটায় দক্ষ ছিলেন তাঁর ইউরোপীয় প্রতিদ্বন্দ্বীরা। কিন্তু প্রতিভা ঠিকরে বের হওয়ার সুযোগ পেলে তা কি কখনো চাপা থাকে? থাকে না। সুলতান অর্ধেকের বেশিসংখ্যক ম্যাচ জিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। হেরেছিলেন মাত্র এক ম্যাচ!
সুলতান ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন আরও দুবার (১৯৩২ ও ১৯৩৩)। সে সময় পৃথিবীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি বিচারে ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপের মর্যাদা বৈশ্বিক চ্যাম্পিয়নশিপের মতো ছিল বলে দাবি করেছেন আতহার সুলতান ও আতিয়াব সুলতান। প্রথমবার এই চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে বাঘা বাঘা দাবাড়ুর নজরে পড়ে গিয়েছিলেন সুলতান। পরের চার বছরের একটু বেশি সময় ইউরোপে তোলপাড় চলেছে তাঁকে নিয়ে দাবার বোর্ডে। ৬৪ ঘরের সেই বোর্ডের সামনে সুলতান ভীষণ সাদাসিধে ছিলেন। ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত ডেভিড হুপার ও কেনেথ হুইল্ডের লেখা ‘দ্য অক্সফোর্ড কম্পানিয়ন টু চেস’ বইয়ে সুলতানের ভাবনার কথা উল্লেখ আছে। সুলতান মনে করতেন, ‘যে খেলোয়াড়ের মনোযোগ যত গভীর হবে, সে-ই জিতবে।’ কতটা সাদাসিধে চিন্তা, ভাবা যায়!
নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, প্রথমবার ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে ১৯৩০ সালের মে মাসে সুলতান অল্প কিছুদিনের জন্য জন্মভূমিতে ফিরে এসেছিলেন। ইউরোপে ফেরার পর দাবার বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলার প্রস্তাব পেতে থাকেন। ১৯৩০ সালের জুলাইয়ে ইংল্যান্ডের স্কারবরোয় টুর্নামেন্টে চতুর্থ হন, সেখানে ইউরোপের তৎকালীন শীর্ষ পাঁচ দাবাড়ুও ছিলেন। এরপর হামবুর্গে তৃতীয় দাবা অলিম্পিয়াডে ইংল্যান্ড তাঁকে নিজেদের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে খেলায়। ৪ হার ও ৪ ড্রয়ের বিপরীতে ৯ জয় পেয়েছিলেন সুলতান। হামবুর্গের পর বেলজিয়ামের লিয়েজে ইনভাইটেশন টুর্নামেন্টে বিশ্বখ্যাত দাবাড়ু সাভিয়েল্লি টারটাকোয়ারের পর দ্বিতীয় হন। কয়েক মাস সেই টারটাকোয়ারকেই হারিয়ে দেন ১২ ম্যাচের গেমে।
তবে সুলতানের ক্যারিয়ারে মাহেন্দ্রক্ষণটা ধরা দিয়েছে ১৯৩০ সালের শেষ থেকে ১৯৩১ সালের শুরুর দিকে হাস্টিংসে আয়োজিত একটি এলিট টুর্নামেন্টে। দাবার দুই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ম্যাক্স ইউয়ি ও হোসে রাউল কাপাব্লাঙ্কার পর তৃতীয় হয়েছিলেন সুলতান। কাপাব্লাঙ্কা দাবার সর্বকালীন সেরাদের একজন। সেই টুর্নামেন্টে কাপাব্লাঙ্কাকে হারিয়ে সুলতান দাবা–বিশ্বকে যতটা নাড়া দিয়েছিলেন, তার চেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছিল সম্ভবত সে ম্যাচে তাঁর খেলা স্টাইল। বলা হয়, কাপাব্লাঙ্কাকে বুঝতে না দিয়ে ধীরে ধীরে তাঁকে ম্যাচ থেকে ছিটকে ফেলেছিলেন! সুলতানের সেই খেলার স্টাইল দাবার খেলার ধরনেও এখন অন্যতম রেফারেন্স পয়েন্ট।
১৯৩১ সালে প্রাগে আয়োজিত চেস অলিম্পিয়াডেও ইংল্যান্ডের নেতৃত্ব দিয়ে অসাধারণ সাফল্য পেয়েছিলেন সুলতান। ৮ জয়, ৭ ড্র ও ২ হার। হেরেছিলেন সে সময় বিশ্বের সেরা ১০ দাবাড়ুদের ২ জন—সলোমন ফ্লোর ও আকিবা রুবেনস্টেইন। ড্র করেছিলেন তৎকালীন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আলেক্সান্দার আলেখিনের সঙ্গে। ১৯৩২ সালে খেলেছেন কেমব্রিজ প্রিমিয়ার লিগেও। সেখানে ইংল্যান্ডের সেরা সব দাবাড়ুকে তিনি হারিয়েছেন, যাঁদের মধ্যে ছিলেন কোনেল হিউ ও’ডনেল আলেক্সান্দার—আইরিশ ক্রিপ্টোলজিস্ট, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যিনি জার্মান এনিগমা মেশিনের গোপন বার্তা উদ্ধার করতে অ্যালান টার্নিংয়ের সঙ্গে কাজ করেছেন। ১৯৩৩ ছিল সুলতানের দাবার বোর্ডে শেষ প্রতিযোগিতামূলক বছর। সেবারও ইংল্যান্ডের শীর্ষ খেলোয়াড় হিসেবে দাবা অলিম্পিয়াডে অংশ নেন, জেতেন ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপ।
সে বছর ডিসেম্বরে ইংল্যান্ডে রাউন্ডটেবিল কনফারেন্স শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে উমর হায়াতের ইংল্যান্ড সফরও শেষ হয়। সুলতানকেও ইউরোপ ছেড়ে দেশে ফিরতে হয় উমর হায়াতের সঙ্গে। এরপর আর কখনোই তিনি ইউরোপে যেতে পারেননি, মুখোমুখি হতে পারেননি বিশ্বসেরা সব দাবাড়ুর। সুলতানের কিন্তু তাতে মনে কোনো কষ্ট ছিল না। ইংল্যান্ড ছাড়তে পেরে তিনি খুশিই হয়েছিলেন। সেখানে ঠান্ডা ও বৃষ্টিবাদল আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারেননি। ম্যালেরিয়াও হয়েছিল। উমর হায়াতের বাসায় কাজ করা গুলাম ফাতিমা এ ব্যাপারে সাক্ষ্য দিয়েছেন সত্তর দশকে ব্রিটিশ টেলিভিশনে প্রচারিত এক তথ্যচিত্রে, যা ২০১৪ সালে ইউটিউবেও প্রকাশিত হয়। এই তথ্যচিত্রের বরাত দিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমসও।
গুলাম ফাতিমাও কিন্তু দাবাড়ু। তথ্যচিত্রে তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাঁর কাছে দাবা খেলা শিখতে চেয়েছিলেন এবং ১৯৩৩ সালে ফাতিমা ব্রিটিশ উইমেন্স চেস চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন। ডেভিড হুপার ও কেনেথ হুইল্ডের বইয়ে ফাতিমা বলেছেন, ইংল্যান্ড ছেড়ে সুলতানের মনে হয়েছিল, তিনি জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
দেশে ফেরার পর ১৯৩৫ সালে একবারই প্রতিযোগিতামূলক দাবায় অংশ নিয়েছিলেন সুলতান। ভি কে খাদিলকারের বিপক্ষে সেই মুখোমুখিতে ৯ জয় ও ১ ড্রয়ে তখনো বোঝা গিয়েছিল, সুলতানের অন্তত উপমহাদেশে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। এরপর সুলতান আর কোনো প্রতিযোগিতামূলক দাবায় অংশ নেননি।
ব্রিটিশ টেলিভিশনে প্রচারিত সেই তথ্যচিত্রে সুলতানের ছেলে আতহার সুলতান একটি ঘটনা জানিয়েছেন। আতহার তাঁর বাবার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তিনি কেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ খেতাবের জন্য লড়াই করেননি? সুলতান বলেছিলেন, সে সময় বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ খেতাবের জন্য লড়াইয়ে অংশ নিতে অন্তত ২০০০ পাউন্ড ফি দিতে হতো (২০২৩ সালের হিসাবে ২ লাখ ৩০ হাজার ডলার), যেটা জোগাড় করা তাঁর পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। সেই তথ্যচিত্রে ঐতিহাসিক রিচার্ড এলস সুলতানকে নিয়ে বলেছেন সবচেয়ে নির্মম সত্য কথাটি, ‘সুলতানের পরিস্থিতিটাই ছিল অস্বাভাবিক। তাঁর একজন সাহায্যকারী ছিলেন। তিনি তাঁর খরচ নির্বাহ করতেন, বিভিন্ন টুর্নামেন্টে পাঠাতেন। এটা যেন শাঁখের করাত। কারণ, একজন ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর তাঁর দাবা ক্যারিয়ারটা নির্ভর করেছে। স্যার উমর হায়াত খান চাইলে তিনি দাবাড়ু, নইলে না। এ জন্যই তিনি ইউরোপে আর খেলতে পারেননি।’
ব্রিটিশ গ্র্যান্ডমাস্টার ও গণিতবিদ জোনাথন মেস্টেল সুলতানের ভেতরকার ব্যক্তিকে খোঁজার চেষ্টা করেছেন। সেই তথ্যচিত্রে বলেছেন, ‘ভেবে অবাক হই, সুলতানের প্রাত্যহিক জীবন ছিল কাউকে সেবা করার। দাবার প্রতি আকর্ষণটা সে বাড়তে দেয়নি। শুধু দাবা খেলার সময়ই তাকে কেউ কোনো কাজ করার নির্দেশ দেয়নি। শুধু দাবার বোর্ডেই সে নিজেকে প্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছে।’
সেটাও খুব অল্প সময়ের জন্য।
ইউরোপ থেকে ফেরার পর নিজ বাসভূমে চাষবাসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন সুলতান। তাঁর ছেলে ও নাতিপুতিরাও দাবা খেলেন। কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্ট থেকে বিরত থাকেন। আতহার সুলতান জানিয়েছেন, তাঁর বাবা তাঁদের বলে গিয়েছেন, ‘নিজের জীবনকে এর (দাবা) চেয়ে ভালো কোনো কিছুতে কাজে লাগাতে।’
সুলতান যখন দাবা খেলেছেন, তখন কোনো অফিশিয়াল র্যাঙ্কিং ছিল না। তবে দাবার বিশ্বস্ত ওয়েবসাইট চেস মেট্রিকস, যারা গত ২০০ বছরের দাবাড়ুদের র্যাঙ্কিং নির্ধারণ করেছে, সে অনুযায়ী নিজের দাবা ক্যারিয়ারের শেষ দুই বছরে সুলতান বিশ্বের সেরা ষষ্ঠ অথবা সপ্তম খেলোয়াড় ছিলেন। আর একটি কথা না জানালেই নয়। ওই যে ইউরোপীয়দের মতো খেলা কীভাবে শুরু করতে হবে, সুলতান তা সেভাবে না জানলেও রুবিনস্টেইনের মতে, তিনি ‘মাঝে এবং শেষের খেলার মাস্টার।’
তবে সুলতান তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে সেরা স্বীকৃতিটা পেয়েছেন সম্ভবত কাপাব্লাঙ্কার কাছ থেকে। দাবায় সর্বকালের সেরা সহজাত প্রতিভাদের একজন হিসেবে স্বীকৃত কাপাব্লাঙ্কা নিজের এক লেখায় সুলতানকে একটি শব্দে বেঁধেছিলেন—
‘জিনিয়াস’।