২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

নিয়াজ-দিব্যেন্দু: প্রথম দুই বাঙালি গ্র্যান্ডমাস্টারের ৪৫ বছরের বন্ধুত্বের গল্প

এক ফ্রেমে দাবার প্রথম দুই বাঙালি গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ ও দিব্যেন্দু বড়ুয়া। দুজনে খুব ভালো বন্ধুওছবি : তানভীর আহাম্মেদ

‘ওই রিকশা, দাঁড়াও।’ এই বলে রিকশায় উঠে পড়লেন নিয়াজ মোরশেদ। পাশে গিয়ে যিনি বসলেন, তাঁর নাম দিব্যেন্দু বড়ুয়া। মেরুল-বাড্ডার ব্যস্ত সড়কে উপমহাদেশের প্রথম দুই বাঙালি গ্র্যান্ডমাস্টার এক রিকশায়। যেকোনো ফটোসাংবাদিকের জন্যই কাঙ্ক্ষিত এক দৃশ্য। কিন্তু রাত প্রায় ৯টা বাজতে চলেছে তখন। আর ফটোগ্রাফারকেও তো জানতে হবে ওই সময় ওখানে দেখা যাবে অভাবিত এই দৃশ্য!

কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে গত বৃহস্পতিবারের ওই সময়টায় এই প্রতিবেদক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। নিয়াজের উদ্যোগে ১৩ বছর পর ঢাকায় আয়োজিত গ্র্যান্ডমাস্টার দাবার চতুর্থ রাউন্ডের খেলা শেষ হয়েছে সবে। নিয়াজের আমন্ত্রণেই দিব্যেন্দুর তাতে খেলতে আসা। মেরুল-বাড্ডার কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের হল ঘরে দিনের খেলা শেষ করে দিব্যেন্দুকে নিয়ে রিকশায় গুলশানে হোটেলে যান নিয়াজ। একই রুমে আপাতত তাঁদের বাস। দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা ‘তুই’ সম্বোধনের।

১৯৮৭ সালে উপমহাদেশে প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার হন নিয়াজ। ওদিকে প্রথম ভারতীয় হিসেবে বিশ্বনাথন আনন্দ গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব পান ১৯৮৮ সালে। ১৯৯১ সালে গ্র্যান্ডমাস্টার হলেন দিব্যেন্দু বড়ুয়া। নিয়াজের পর দিব্যেন্দু দ্বিতীয় বাঙালি গ্র্যান্ডমাস্টার।

ছোটবেলার বন্ধু বলেই সেটা সম্ভব। দুজনেরই বয়স এখন ৫৭ বছর, বন্ধুত্ব ৪৫ বছরের। সেই বন্ধুত্বের গল্প শুনতেই দুজনকে সেদিন হলঘরে এক টেবিলে বসানো। দুজনের প্রথম দেখা কবে? টেবিলের একপাশ থেকে নিয়াজই উত্তরটা দিলেন, ‘আমি প্রথম জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হলাম ১৯৭৯ সালে। সে বছরই কলকাতায় আলেখাইন চেস টুর্নামেন্টে খেলতে যাই। আমার প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট। ওখানেই দিব্যেন্দুর সঙ্গে প্রথম পরিচয়।’

আরও পড়ুন
দাবার বোর্ডে নিয়াজ মোরশেদ
প্রথম আলো

নিয়াজ দিব্যেন্দুকে বলেন, ‘ওই টুর্নামেন্টটা বোধহয় তোরও প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট, নাকি?’ ‘কোনটা? আলেখাইন? হ্যাঁ, হাঁ ঠিক বলেছিস’— বন্ধুর প্রশ্নে দিব্যেন্দুর উত্তর। সঙ্গে যোগ করেন, ‘এর আগের বছরই ১৯৭৮ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে ভারতের জাতীয় চ্যাম্পিনয়নশিপে কোয়ালিফাই করি আমি।’

মাত্র ১৩ বছর বয়সে নিয়াজ জেতেন বাংলাদেশের জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ। এরপর দ্রুতই এগিয়ে চলেন। ১৯৮৭ সালে উপমহাদেশে প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার হন নিয়াজ। ওদিকে প্রথম ভারতীয় হিসেবে বিশ্বনাথন আনন্দ গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব পান ১৯৮৮ সালে। ১৯৯১ সালে গ্র্যান্ডমাস্টার হলেন দিব্যেন্দু বড়ুয়া। নিয়াজের পর দিব্যেন্দু দ্বিতীয় বাঙালি গ্র্যান্ডমাস্টার, দক্ষিণ এশিয়ার তৃতীয়। ১৯৮৩ সালে সর্বকনিষ্ঠ দাবাড়ু হিসেবে ভারতের জাতীয় চ্যাম্পিয়শিপ জিতে আলোড়ন তোলেন তখনকার তরুণ দিব্যেন্দু।

দুজনের জন্মই ১৯৬৮ সালে। মে মাসে নিয়াজের, দিব্যেন্দুর অক্টোবরে। দুজনই দাবাড়ু, বাঙালি। এর বাইরে মিল কী? নিয়াজের জন্ম ঢাকায় হলেও চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে তাঁর পৈতৃক বাড়ি। দিব্যেন্দুর জন্ম চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায়।

কত দিন পর বাংলাদেশে এলেন? উত্তর দিতে গিয়ে নিয়াজের কাছে নিশ্চিত হতে চাইলেন দিব্যেন্দু, ‘২০১৮–তে এসেছি সর্বশেষ তাই না?’ নিয়াজ বলেন, ‘ঠিক তাই। চট্টগ্রামে ফাহাদ যেটিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।’ দিব্যেন্দু বলতে থাকেন, ‘১৯৮০ সাল থেকে প্রায়ই আসতাম বাংলাদেশে। এখানকার লিগে, টুর্নামেন্টে অনেকবার খেলেছি। অন্তত কুড়ি-বাইশবার তো হবেই।’

আরও পড়ুন
ভারতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার দিব্যেন্দু বড়ুয়া
ইনস্টাগ্রাম

দুজনের জন্মই ১৯৬৮ সালে। মে মাসে নিয়াজের, দিব্যেন্দুর অক্টেবরে। দুজনই দাবাড়ু, বাঙালি। এর বাইরে মিল কী? নিয়াজ হেসে বলেন, ‘পুরাই অমিল।’ দিব্যেন্দু অবশ্য একটা মিল খোঁজেন, ‘দুজনই আমরা চট্টগ্রামের মানুষ বলতে পারেন।’

নিয়াজের জন্ম ঢাকায় হলেও চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে তাঁর পৈতৃক বাড়ি। দিব্যেন্দুর জন্ম চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায়। কীভাবে কলকাতায় স্থায়ী হওয়া? দিব্যেন্দু পেছনে ফেরেন, ‘সাতকানিয়ায় ১৯৬৬ সালে জন্মের পর মাত্র ছয় মাস বয়সে বাবা বিনয় ভূষণ বড়ুয়া আমাকে কলকাতায় নিয়ে যান চিকিৎসার জন্য। আমার তখন রিকেট সমস্যা (হাড়ের সমস্যা) ছিল। সেই থেকে আমার বেড়ে ওঠাসহ সবই কলকাতায়।’ পাশ থেকে দিব্যেন্দুকে নিয়াজের প্রশ্ন, ‘দিলীপ বড়ুয়া (সাম্যবাদী দলের নেতা ও সাবেক মন্ত্রী) কী হয় তোর?’ দিব্যেন্দুর উত্তর, ‘আমাদের কাজিন।’

আমরা দুজন একসঙ্গে প্রচুর সময় কাটিয়েছি। গল্প, আড্ডায় মেতেছি। ও কলকাতায় গেলে দেখা হয়, আমিও ঢাকায় আসি। ওর আতিথেয়তা ভোলার নয়। ১৯৮৮ সালে আমরা লন্ডনে গেলাম। সেখানে আমি প্রথম জিএম নর্ম পেলাম। পূর্ব লন্ডনে একসাথে ছিলাম। অনেক স্মৃতি।
দিব্যেন্দু বড়ুয়া

দাবাড়ুদের মধ্য দিব্যেন্দুর সঙ্গেই সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়াজের। দুজনের মধ্যে ৬৪ ঘরে লড়াই কম হয়নি। নিয়াজ সংখ্যটা অনুমান করেন, ‘প্রায় ৩০টি ম্যাচ আমি আর ও মুখোমুখি হয়েছি।’ জয়ের হার কার বেশি? নিয়াজের উত্তর, ‘প্রায় সমান সমানই হবে।’ এটা কি তাঁর ক্যারিয়ারে কোনো নির্দিষ্ট খেলোয়াড়ের সঙ্গে সর্বোচ্চ ম্যাচ? ‘ও আর জিয়া হবে’, ছোট্ট করে বলেন নিয়াজ।

দুজনের একটি মজার স্মৃতিও তুলে আনেন নিয়াজ, ‘আমরা একবার দল বেঁধে কলকাতার এক বাসায় লুচি খেয়েছি। আমি, দিব্যেন্দু, জিয়া আর তোঁজো (বাংলাদেশের প্রয়াত দাবা সংগঠক)। আমরা ৮৮টা লুচি খেয়েছি। আয়োজকেরা বললেন, বাংলাদেশের ছেলেগুলা লুচি খেতে পারে, হা হা হা। তোঁজো খেয়েছিল ৪৪টা, আমি ২২টা। ও (দিব্যেন্দু) আর জিয়া ২২টা। ১৯৮৮-৮৯ সালের কথা হবে।’

আরও পড়ুন

আরেকবার নিয়াজ–দিব্যেন্দু কলকাতা থেকে চেন্নাই যাবেন। নিয়াজ দিব্যেন্দুকে বলেন, উড়ানের টিকিট কাটতে। তারপর? ‘ওকে আগেই বলেছি, তুই দিনের বেলায় ফ্লাইটের টিকিট কাটবি। কিন্তু সে একটু জটিল রুটে টিকিট কাটল। দেখে আমার একটু মেজাজ খারাপ হলো। আমি বললাম, তুই এটা কী কাটলি হা হা হা?’ দিব্যেন্দু্ সেই ঘটনা মনে করে হাসেন। এই ফাঁকে একটু পেছনেও ফেরেন, ‘আমরা দুজন একসঙ্গে প্রচুর সময় কাটিয়েছি। গল্প, আড্ডায় মেতেছি। ও কলকাতায় গেলে দেখা হয়, আমিও ঢাকায় আসি। ওর আতিথেয়তা ভোলার নয়। ১৯৮৮ সালে আমরা লন্ডনে গেলাম। সেখানে আমি প্রথম জিএম নর্ম পেলাম। পূর্ব লন্ডনে একসাথে ছিলাম। অনেক স্মৃতি।’

দিব্যেন্দু থাকেন কলকাতার সল্টলেকে। ২০০৫ সালে সেখানে দাবা একাডেমি খুলেছেন, ৪০০ দাবাড়ু আছে একাডেমিতে। কলকাতার গ্র্যান্ডমাস্টার কৌস্তভ চ্যাটার্জি ও মিত্রাভ গুহ তাঁর একাডেমির ছাত্র। এসব শুনে নিয়াজ জানান, তিনি কেন একাডেমি খোলার পথে গেলেন না।

দিব্যেন্দুর সঙ্গে নিজের তুলনাও টানেন নিয়াজ। তাঁর চোখে দুজন একই মানের খেলোয়াড় ছিলেন। ‘…কিন্তু ও একটু মিস করত। মানে ধরুন, হাফ পয়েন্টের জন্য চ্যাম্পিয়নশিপ মিস। তবে রেটিং আমার চেয়ে ওর বেশি ছিল।’ ওদিকে দিব্যেন্দুর চোখে খেলোয়াড় হিসেবে নিয়াজ ‘অরিজিনাল’, বাংলাদেশের দাবার গর্ব। বর্তমান সময়ের সঙ্গে নিজেদের সময়ের তুলনা করতে গিয়ে বললেন, ‘আমাদের সময়ে এত বইটই তো ছিল না। আমাদের তাই পুঁথিগত শিক্ষাটা নেই। এখন বয়সের কারণে বেশি পরিশ্রমও করা হয় না। সে জন্য তরুণদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে একটু সমস্যা হয়ে যায়।’ দাবায় ভালো করতে সুযোগ– সুবিধাও খুব দরকার মনে করেন তিনি, ‘আনন্দ বিদেশে টানা খেলেছে। নিজেকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে গেছে। নিয়াজ বা আমি ওই সময়টা বিদেশে গিয়ে টানা খেলতে পারলে আমরাও অন্য পর্যায়ে যেতে পারতাম।’

বন্ধু যখন শত্রু! নিজের আয়োজন করা টুর্নামেন্টে বন্ধু দিব্যেন্দুর মুখোমুখি নিয়াজ। এই ম্যাচে অবশ্য হারেননি কেউ
সৌজন্য ছবি

দিব্যেন্দু থাকেন কলকাতার সল্টলেকে। ২০০৫ সালে সেখানে দাবা একাডেমি খুলেছেন, ৪০০ দাবাড়ু আছে একাডেমিতে। কলকাতার গ্র্যান্ডমাস্টার কৌস্তভ চ্যাটার্জি ও মিত্রাভ গুহ তাঁর একাডেমির ছাত্র। এসব শুনে নিয়াজ জানান, তিনি কেন একাডেমি খোলার পথে গেলেন না, ‘আমাদের এখানে তো কেউ বিনিয়োগ করতে চায় না। কীভাবে করব! দিব্যেন্দু করতে পেরেছে কারণ, ওখানে দাবার কদর আছে।’

রাত হয়েছে, গল্প থামে। দুই বাঙালি কিংবদন্তি দাবাড়ু হল থেকে বেরিয়ে রিকশায় চাপেন গল্প করতে করতে।

আরও পড়ুন