বক্সিংয়ের ঝলমলে রাতে সুরকৃষ্ণের চমক, সহজে জিতলেন রুকসানা
এ যেন বাংলাদেশের বক্সিংয়ের নতুন দিনের গান। এটি ছিল বক্সিংয়ের অন্য রকম ঝলমলে এক রাত! রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের বলরুমে ঢোকার মুখে বিশাল আকারের একাধিক কাটআউট। কোনোটা বাংলাদেশের অন্যতম সেরা বক্সার সুরকৃষ্ণ চাকমার, কোনোটা আল আমিনের। কোন বক্সার কার মুখোমুখি হবেন, সেই ব্যানারও টাঙানো ছিল একাধিক জায়গায়। কিন্তু বাংলাদেশের বক্সারদের লড়াই নয়, আজ রাতে বেক্সিমকো এক্সবিসি ফাইট নাইটে দর্শকেরা মুখিয়ে ছিলেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রিটিশ বক্সার রুকসানার লড়াই দেখতে।
রুকসানার সেই লড়াই ছিল বাংলাদেশের মোসাম্মত তানজিলার বিপক্ষে। সেখানে তানজিলা জিতে গেলে সেটা খুবই বিস্ময়কর হতো। ১০ রাউন্ডের লড়াই শেষে জিতলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইংলিশ রুকসানাই, তবে ৯৬-৯৪ পয়েন্টের ব্যবধানে। আন্তর্জাতিক অভিষেকে তানজিলা মোটেও সহজে হার মানেননি।
তবে তানজিলা-রুকসানা লড়াইয়ের পর রিংয়ে নেমে চমক দেখিয়েছেন বাংলাদেশের সুরকৃষ্ণ চাকমা। তিনি খেলেছেন লাইটওয়েট ক্যাটাগরিতে। ছয় রাউন্ডের ম্যাচে তিনি দ্বিতীয় রাউন্ডেই নকআউট করে দেন থাইল্যান্ডের চ্যাম্পিয়ন বক্সার পোনলাওয়াত নানচিন্দাকে।
প্রথম রাউন্ডে প্রতিপক্ষের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে ছিলেন বাংলাদেশের বক্সার সুরকৃষ্ণ। তবে দ্বিতীয় রাউন্ডে শুরু থেকে সুরকৃষ্ণ চড়াও হতে থাকেন পোনলাওয়াতের ওপর। এরপর একটু নিচু হয়ে তলপেটে পাঞ্চ করেন। তাতেই ছিটকে যান থাইল্যান্ডের বক্সার। এতটা জোরে ঘুষি মেরেছিলেন সুরকৃষ্ণ যে রিংয়ে বসে পড়েন থাই বক্সার। একটু পর তো বক্সিং রিংয়ে উঠে আসেন টুর্নামেন্টের চিকিৎসকেরা! পোনলাওয়াতকে ধরে রিংয়ের নিচে নামিয়ে নেন।
এর আগে গত বছর বাংলাদেশে হওয়া দক্ষিণ এশিয়ান প্রফেশনাল বক্সিং ফাইটেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন সুরকৃষ্ণ। আবারও জিততে পেরে খুশি সুরকৃষ্ণ, ‘আমি এই লড়াইয়ের জন্য গত তিন মাস কঠোর অনুশীলন করেছি। যে বক্সারের সঙ্গে খেলেছি সে মোটেও সহজ প্রতিপক্ষ ছিল না আমার জন্য। সে থাইল্যান্ডের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। অলিম্পিক দলে খেলেছে। ওকে হারিয়ে আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়েছি। এবার আমি আট রাউন্ডের বেল্টের জন্য লড়তে পারব।’
বাংলাদেশের দুই বক্সারের লড়াই দিয়ে শুরু হয় প্রথম বাউট। সেখানে অংশ নেন উৎসব আহমেদ ও আমিনুল ইসলাম। ৬ রাউন্ডের লড়াইয়ে উৎসব হারিয়ে দেন আমিনুলকে। দ্বিতীয় বাউটেও বাংলাদেশের দুজন লড়েন। লাইট হেভিওয়েট ওজন ক্যাটাগরিতে জাহিদুল ইসলাম মুখোমুখি হন শাহরিয়ার শান্তর। এই বাউটে চার রাউন্ডের খেলা হলেও টেকনিক্যাল নকআউটের কারণে তিন রাউন্ডের খেলা হয়, যেখানে শান্তকে হারান জাহিদুল ইসলাম।
তৃতীয় বাউটে মুখোমুখি হন ভারতের আশিষ কুমার ও আবু তালহা হৃদয়। এটিও হয়েছে ছয় রাউন্ডে। এই বাউটে জয়ী হন বাংলাদেশের আবু তালহা। চতুর্থ বাউটে বাংলাদেশের মোহাম্মদ কাওসারকে হারিয়েছেন ফ্রান্সের এলিয়ট মিশেল। ক্রুইসার ওজন ক্যাটাগরিতে চার রাউন্ডের লড়াইয়ে জেতেন ফ্রান্সের এলিয়ট মিশেল।
এরপর পঞ্চম বাউটে ইংল্যান্ডের রুকসানার মুখোমুখি হন বাংলাদেশের তানজিলা। এদের পরই লড়েছেন সুরকৃষ্ণ। রাতের সপ্তম ও শেষ বাউটে মুখোমুখি হন বাংলাদেশের আল-আমিন ও ভারতের দুশান্ত শ্রীবাস্তব। শেষ বাউটের ছয় রাউন্ডের লড়াইয়ে জয় পেয়েছেন দুশান্ত শ্রীবাস্তব।
মূলত পল্টনের নোংরা, অস্বাস্থ্যকর স্টেডিয়ামপাড়ায় মোহাম্মদ আলী বক্সিং স্টেডিয়ামের রিংয়ে যে অ্যামেচার লড়াইটা হয়, এর সঙ্গে আসলে মেলানো যাবে না ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের আন্তর্জাতিক পেশাদার বক্সিং ফাইট নাইট। এক্সেল স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড প্রমোশনসের আয়োজনে এই বক্সিং প্রতিযোগিতা মূলত বাংলাদেশে পেশাদারি যুগের বাঁকবদলের শুরু বলা যায়।
পল্টনের বক্সিং স্টেডিয়ামে প্রচণ্ড গরমে ভাঙাচোরা রিংয়ের পাশে নোংরা তোয়ালে নিয়ে অপেক্ষায় থাকেন কোনো কোচ। আর এই লড়াইটা হলো পাঁচ তারকা হোটেলের রঙিন ঝাড়বাতির নিচে। অ্যামেচার বক্সিংয়ে সাধারণত হেডগিয়ার পরে রিংয়ে নামেন বক্সাররা। কিন্তু পেশাদার বক্সিংয়ে শুধু গ্লাভস পরেন বক্সাররা, আর মুখের মধ্যে রাখতে হয় অ্যামেচারের মতোই টিথগার্ড।
বিশ্ব বক্সিং ইউনিয়ন অনুমোদিত এই প্রতিযোগিতার অনেক নতুনের সঙ্গেই পরিচয় হয়েছে বাংলাদেশের দর্শকদের। এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো পেশাদার আন্তর্জাতিক নারী বক্সিং যুগেও ঢুকল বাংলাদেশ। লড়াই শুরু হওয়ার আগে রঙিন আলো–আঁধারিতে চলে পরিচিতি পর্ব।
লড়াইয়ের বিরতিতে চলে রক গানের সঙ্গে পশ্চিমা নাচ। ছিল উঁচু ভলিউমের ডিজে গান। যেগুলো আসলে এত দিন এ দেশের দর্শকেরা দেখে এসেছেন টেলিভিশনের পর্দায়, বিখ্যাত বক্সারদের লড়াইয়ের সময়। পেশাদার এই বক্সিং লড়াই দেখতে এসেছিলেন অনেক আমন্ত্রিত অতিথি। রিংয়ের চারপাশে চেয়ারে বসে ছিলেন বক্সিংপ্রেমী কিছু দর্শকও।