‘গুদাম ঘরে’ হয়ে গেল ভারোত্তোলনের জাতীয় প্রতিযোগিতা
ভারোত্তোলকেরা ঠিকানাবিহীন অনেক দিন ধরে। এবার জাতীয় ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপের ভেন্যু, মঞ্চ—কিছুই ছিল না মানসম্মত।
কাল শেষ হওয়া চার দিনব্যাপী জাতীয় ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপটা নিশ্চয়ই অনেক দিন মনে রাখবেন মাবিয়া আক্তার। একে তো একটা রেকর্ড গড়েছেন, তার ওপর এবার যে পরিবেশে প্রতিযোগিতায় অংশ নিলেন ভারোত্তোলকেরা, সেটা ভুলে যাওয়ার কারণ নেই তাঁদের কারোরই।
পল্টন আইভি রহমান সুইমিংপুলের পাশের ছোট গুদামঘরের মতো জিমনেসিয়ামেই এবার হয়েছে জাতীয় ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপ। প্রতিযোগিতার ভেন্যু, মঞ্চ কোনো কিছুই ছিল না মানসম্মত। ভারোত্তোলকেরা তাই ভার তুলেছেন ভয় আর সংশয় নিয়ে।
এর মধ্যেই ছেলেদের বিভাগে সেরা হয়েছেন সেনাবাহিনীর আশিকুর রহমান ও মেয়েদের বিভাগে মাবিয়া আক্তার। ৫টি সোনা, ৩টি রুপা ও ১টি ব্রোঞ্জ জিতে ছেলেদের দলগত চ্যাম্পিয়ন আনসার। ৬টি সোনা, ৩টি রুপা জিতে মেয়েদের দলগত চ্যাম্পিয়ন সেনাবাহিনী।
আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী ভার তোলার মঞ্চ হতে হয় দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে ৮ ফুট। বাংলাদেশ ভারোত্তোলন ফেডারেশন বরাবরই নিয়মটা মেনে এসেছে। কিন্তু এবার ভার তুলতে এর অর্ধেক জায়গাও পাননি ভারোত্তোলকেরা। এত ছোট জায়গায় ভার তুলতে গিয়ে যেকোনো মুহূর্তে ঘটে যেতে পারত বড় দুর্ঘটনা। প্রতিযোগিতা চলাকালে এই অল্প জায়গার মধ্যেই হয়েছে ভারোত্তোলকদের অনুশীলন।
দেশের অনেক ফেডারেশনের নিজস্ব আধুনিক স্থাপনা থাকলেও ভারোত্তোলনের সে রকম কিছু নেই। এসএ গেমস ভারোত্তোলনে টানা তিনবার সোনা জিতেছে বাংলাদেশ। ২০১৯ সালের সর্বশেষ গেমসে আসে ২টি সোনা, ৪টি রুপা ও ৫টি ব্রোঞ্জ। এরপর আন্তর্জাতিক আসরে আরও বেশি পদক পেতে বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের (বিওএ) ট্রেনিং ও ডেভেলপমেন্ট কমিটিকে ১২ দফার একটি সুপারিশ দেয় ফেডারেশন। তার প্রথমটিই ছিল ন্যূনতম আন্তর্জাতিক মানের জিমনেসিয়াম নিশ্চিত করা। মাবিয়া আক্তার, জিয়ারুল ইসলামরা কাঠমান্ডু এসএ গেমসে সোনা জয়ের পর সরকারের পক্ষ থেকেও সে রকম আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নতুন জিমনেসিয়াম দূরে থাক, প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্যই যাযাবরের মতো এদিক–সেদিক ঘুরতে হচ্ছে ফেডারেশনকে!
ঢাকায় জিমনেসিয়ামের অভাবে গত বছর বাংলাদেশ গেমসের ভারোত্তোলন হয় ময়মনসিংহে। কমনওয়েলথ গেমস ও ইসলামিক সলিডারিটি গেমসের প্রস্তুতির জন্য ফেডারেশন তিন জায়গায় আলাদাভাবে অনুশীলন করায় ভারোত্তোলকদের। এক দল বাগেরহাটে, অন্য দুই দল বনানী আর্মি স্টেডিয়াম ও পল্টনের ছোট জিমনেসিয়ামে।
এবার সেই পল্টন জিমনেসিয়ামেই হয়েছে জাতীয় ভারোত্তোলন। ছোট একটি গুদামের মতো জায়গা। সেখানেই কর্মকর্তা, ভারোত্তোলক, বিচারক ও দর্শকদের ভিড়। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র থাকলেও গরমে বারবার ফ্যান চালানোর অনুরোধ করছিলেন ভারোত্তোলকেরা। ছিল না কোনো বিশ্রামের জায়গা।
ফেডারেশনের সহসভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ আক্ষেপ করে বললেন, ‘গত বছর জাতীয় প্রতিযোগিতার জন্য জায়গা দেয়নি ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি)। বাধ্য হয়ে এবার এখানেই খেলার আয়োজন করেছি। ছোট জিমনেসিয়াম, অসুবিধা তো হবেই।’
অল্প জায়গায় ভার তুলতে গিয়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কায় ছিলেন মাবিয়া, ‘আমাদের একেবারে সামনেই বসেন বিচারকেরা। বার্বেল থেকে প্লেট খুলে পড়ে গেলে বা হাত ফসকে গড়িয়ে পড়লে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। দর্শকের ওপর গিয়েও পড়তে পারে এটা। এমন অস্বাস্থ্যকর ও ঘিঞ্জি পরিবেশে কোনো জাতীয় প্রতিযোগিতা চলতে পারে না।’
এসএ গেমসে সোনা জিতেও যেন কারও সুদৃষ্টি কাড়তে পারেননি মাবিয়ারা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাফল্য নেই, এমন খেলার প্রসঙ্গ টেনে এসএ গেমসে সোনাজয়ী ভারোত্তোলক বললেন, ‘যেসব ডিসিপ্লিনে সফলতা নেই, সেসবের জন্যও বড় বড় ইনডোর হয়েছে। অথচ ওরা হিটেই বাদ হয়ে যায়। ওরা যদি ইনডোর পায়, আমরা কেন পাব না?’
ভারোত্তোলনের সমস্যার কথা অজানা নয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ সচিব পরিমল সিংহের। তবে তাঁর আশ্বাসে থাকল শুধু ভবিষ্যতের কথা, ‘শুধু ভারোত্তোলন নয়, বাস্কেটবলও ভেন্যু–সংকটে ভুগছে। এসব ফেডারেশনের জন্য আমরা পূর্বাচলে স্থায়ী কমপ্লেক্স তৈরি করার কথা ভাবছি। সেটা হলে এই খেলাগুলোর অনুশীলন ও প্রতিযোগিতার স্থায়ী সমাধান হবে বলে আশা করছি।’