‘কিং জেমস’ই এখন বাস্কেটবলের রাজা
ক্রিপ্টো ডটকম অ্যারেনার গ্যালারিতে ছিলেন করিম আবদুল-জব্বার। ১৪ ফুট দূর থেকে লেব্রন জেমস তাঁর চিরাচরিত ‘ফেডওয়ে জাম্প’ (ডিফেন্ডারের সামনে জায়গা ফাঁকা করে বল বাস্কেটে মারা) বল বাস্কেট করতেই উঠে দাঁড়ালেন করিম। করতালিতে ফেটে পড়া গ্যালারির সঙ্গে মিলল কিংবদন্তির দুটি হাতও। ধারাভাষ্যকারের কণ্ঠও স্বাভাবিক ছিল না। আবেগমিশ্রিত চিৎকারে বললেন, ‘লেব্রন স্ট্যান্ডস অ্যালোন! এনবিএস অলটাইম স্কোরিং রেকর্ড নাও বিলংস টু লেব্রন জেমস!’
ধারাভাষ্যকার বলে না দিলেও জানতেন প্রায় সবাই। কিংবদন্তি করিমও জানতেন, ৩৪ বছর আগে তাঁর গড়া রেকর্ডটি হাতছাড়া হওয়ার অপেক্ষায়। তাই হয়তো গ্যালারিতে ছুটে এসেছিলেন ‘কীর্তিমানব’, তাঁর চেয়ে ভালো আরেক ‘কীর্তিমান’কে করতালিতে সিক্ত করতে। মিলাউকি বাকস ও লস অ্যাঞ্জেলেস লেকার্সের হয়ে খেলা করিম আবদুল–জব্বার ১৯৮৪ সালে এনবিএর ইতিহাসে সর্বোচ্চ পয়েন্টের রেকর্ড গড়ার ৮ মাস পর জন্ম লেব্রন জেমসের। ৩৮,৩৮৭ পয়েন্ট! তখন কেউ ভাবেননি করিমের এই রেকর্ড কেউ ভাঙতে পারবেন। কিন্তু ওই যে কথায় আছে না, ‘তোমাকে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।’
জেমসও যেন করিমের সেই রেকর্ড ভাঙার জন্যই জন্মেছেন। হাইস্কুল বাস্কেটবল খেলার সময়ই তাঁকে ‘চুজেন ওয়ান’ বলা হতো। অর্থাৎ এমন কেউ, যাঁর কাঁধে একটি গুরুদায়িত্ব চাপিয়ে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। সে দায়িত্বটাই জেমস পালন করলেন মঙ্গলবার রাতে। ওকলাহোমা সিটি থান্ডারের বিপক্ষে ১৩৩-১৩০ পয়েন্টে হারের ম্যাচে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল বাস্কেটবল অ্যাসোসিয়েশনের (এনবিএ) ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট অর্জনের রেকর্ড গড়লেন লেব্রন রেমন্ড জেমস সিনিয়র ওরফে লেব্রন জেমস, ভক্তদের আদুরে ‘কিং জেমস’।
নিজের ক্যারিয়ারে ৩৮,৩৫২ পয়েন্ট নিয়ে এই ম্যাচে নেমেছিলেন জেমস। বাস্কেটবলে প্যাট রাইলি, জুলিয়াস আরভিংদের চোখে শেষ কথা করিমের রেকর্ড ভাঙতে ৩৬ পয়েন্ট দরকার ছিল তাঁর। ৩৮ পয়েন্ট নিয়ে অমরত্বের তালিকায় নিজেকে সবার ওপরে নিয়ে যান জেমস (৩৮,৩৯০ পয়েন্ট)। ম্যাচ শেষ হওয়ার ১০.৯ সেকেন্ড আগে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকা প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারকে ছাড়িয়ে বল থ্রো করতে একটু পিছিয়ে (ফেডওয়ে জাম্প) ঝুড়িবন্দী করেন জেমস। গ্যালারিতে তাঁর ছেলে হাইস্কুল বাস্কেটবল খেলোয়াড় ব্রনি জেমস মুহূর্তটি মুঠোফোনের ভিডিওতে ধারণ করে পরে বাবাকে দেখিয়েছেন। ছেলের ফোনে সেই মুহূর্তের ভিডিও দেখে লেব্রন যেন নিজেই নিজের প্রশংসা করলেন, ‘ওহ! এটা কঠিন ছিল। তুমি এটা সেভ করেছ তো? আমাকে পাঠাও।’
জেমসের ভক্তরা আবেগে বলতে পারেন, বল বাস্কেট করার আগে তাঁর ওই লাফ দৈর্ঘ্য-প্রস্থে ক্ষুদ্র হতে পারে কিন্তু বাস্কেটবলের ইতিহাসে তাৎপর্য বিচারে ওর চেয়ে বড় লাফ আর নেই, হয়তো আর কখনো হবেও না! ২০০৩ সালের ২৯ অক্টোবর ক্যারিয়ারের প্রথম দুই পয়েন্ট অর্জনের পর এই ২০ বছরে জেমস ‘স্কাইহুক’ কিংবা ‘পাওয়ার ডাঙ্ক’-এর মতো ‘সিগনেচার শট’-এ প্রচুর বাস্কেট করেছেন। এর বাইরে আরও অনেক রকম হাতযশ তাঁর আছে। করিমের মতো তিনিও লস অ্যাঞ্জেলেস লেকার্স কিংবদন্তি। একবার ভেবে দেখুন, করিম আবদুল-জব্বার তাঁর চোখের সামনেই জেমসকে বেড়ে উঠতে দেখেছেন, তাঁরই গড়া রেকর্ডের এভারেস্টে চড়তে দেখেছেন জেমসকে, এত দিন পর ওকলাহোমার বিপক্ষে ম্যাচে জেমস যখন সেই ডিফেন্ডারকে গা থেকে ছাড়াতে কৌশলটি ব্যবহার করলেন, তখন কেউ কেউ সেই ডিফেন্ডারকে রূপক অর্থে করিম বলেও ভাবতে পারেন! রেকর্ডটি নিয়ে করিমের সঙ্গেই তো তাঁর লড়াই হয়েছে এত দিন। শেষ পর্যন্ত ছাড়াতে পারলেন!
এবার একটি প্রশ্ন, ৩৮ বছর বয়সী জেমস অবসর নেওয়ার আগে এই রেকর্ডকে কোন উচ্চতায় তুলতে পারেন? ঠিক করে তো বলা যায় না, তবে একটি রূপক উদাহরণ দেওয়া যায়। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের কাছাকাছি প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে মাউনা কিয়া নামে একটি পর্বত আছে। পানির তলদেশে একদম গোড়া থেকে এর উচ্চতা ১০ হাজার ২০০ মিটার। আর পৃথিবীর পৃষ্ঠে দাঁড়িয়ে থাকা এভারেস্টের উচ্চতা ৮ হাজার ৮৪৮ মিটার। করিম আবদুল-জব্বারের ৩৮ বছর আগের রেকর্ডকে যদি ‘মাউন্ট এভারেস্ট’ ধরা হয়, জেমস তাহলে যখন অবসর নেবেন, তখন সেটাই হয়ে যাবে ‘মাউন্ট কিয়া’—নাকি তার চেয়ে বেশি উচ্চতার কোনো কিছু, যা কোনো দিন ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না শুধু তাকিয়ে দেখা ছাড়া! রক্তমাংসের মানুষ হয়েও জেমস যেহেতু ‘চুজেন ওয়ান’, তাই পয়েন্টের রেকর্ডটি অপার্থিব কোনো উচ্চতায় গিয়েই ঠেকবে হয়তো!
আমি জানি, আমি কী করতে পারি, তাই সব সময় মনে হয়, এই খেলায় আমিই সর্বকালের সেরা।
এনবিএতে ৩৮ হাজার পয়েন্টের মাইলফলক ছোঁয়া খেলোয়াড়ই মাত্র দুজন। তাঁদের নাম এতক্ষণে সবারই জানা। এই দুই কিংবদন্তির পেছনে যে পাঁচজন আছেন, তাঁরা সবাই অবসরে। ‘দ্য মেইলম্যান’ নামে খ্যাতি পাওয়া এনবিএর ইতিহাসে অন্যতম সেরা পাওয়ার ফরোয়ার্ড কার্ল ম্যালোনের পয়েন্টসংখ্যা ৩৬ হাজার ৯২৮। ‘ব্ল্যাক মাম্বা’খ্যাত কিংবদন্তি কোবি ব্রায়ান্টের পয়েন্টসংখ্যা ৩৩ হাজার ৬৪৩ থেকে আর বাড়বে না। কিংবদন্তি যে মারা গেছেন তিন বছর আগেই। বাস্কেটবলে পৃথিবীজুড়ে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি পাওয়া মাইকেল জর্ডানের পয়েন্ট ৩২ হাজার ২৯২। অনেকের মতেই, বাস্কেটবলে সর্বকালের সেরা ইউরোপিয়ান জার্মানির ডির্ক নাওটিৎজকি পেয়েছেন ৩১ হাজার ৫৬০ পয়েন্ট এবং সর্বকালের অন্যতম সেরা হিসেবে স্বীকৃত উইল্ট চেম্বারলিনের পয়েন্ট ৩১ হাজার ৪১৯। বর্তমান খেলোয়াড়দের কেউ জেমসের ধারেকাছেও নেই, আর নিজের ২০তম মৌসুমে এসেও ধার সেই আগের মতোই। ম্যাচে গড়ে ৩০টি করে পয়েন্ট তুলছেন এবং অল-স্টার গেমে নাম লিখিয়েছেন ১৯তমবারের মতো।
লেব্রন জেমস কত দিন খেলবেন, তা আন্দাজ করাও কঠিন। কারণ, নিজের ফিটনেসের যত্ন নিতে শেফ, ট্রেইনার, ম্যাসাজ থেরাপিস্ট মিলিয়ে তাঁর খরচ বছরে ১০ লাখ ডলারের বেশি। জেমস কাল এই রেকর্ড গড়ার পর প্রশ্ন উঠেছে, বাস্কেটবলের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা কে? মাইকেল জর্ডান না লেব্রন জেমস? দুজনের ক্যারিয়ার-বৃত্তান্তে কিন্তু বেশ মিল। জর্ডান ৬ বার এনবিএ শিরোপা জিতেছেন, আর জেমস এখন পর্যন্ত জিতেছেন চারবার, জর্ডান পাঁচবার এনবিএর মোস্ট ভ্যালুয়েবল প্লেয়ার হয়েছেন, জেমস জিতেছেন চারবার। অলিম্পিকে দুবার করে স্বর্ণপদক জিতেছেন দুজনই। তবে জেমস কিন্তু অন্য ধাতে গড়া মানুষ। এখনই নিজেকে সর্বকালের সেরা বলে মনে করেন। রেকর্ড গড়ার পর তিনি বলেছেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমি এই খেলায় যে কাউকে চ্যালেঞ্জ জানাতে প্রস্তুত। আমি জানি, আমি কী করতে পারি, তাই সব সময় মনে হয়, এই খেলায় আমিই সর্বকালের সেরা।’
২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেন্ট ভিনসেন্ট-সেন্ট মেরি হাইস্কুলে থাকতে মাত্র ১৭ বছর বয়সেই বিখ্যাত ক্রীড়া সাময়িকী স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেডের প্রচ্ছদ হয়েছিলেন জেমস। লাল রঙের বড় বড় অক্ষরে শিরোনামে লেখা ছিল ‘চুজেন ওয়ান’। কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দা না মাড়ানো জেমস বর্ণবাদ ও কালোদের অধিকার নিয়ে সব সময়ই সোচ্চার। বাস্কেটবল কোর্টে জাদু দেখানোর পাশাপাশি লোকে তাঁকে কোর্টের বাইরের কাজকর্মের জন্যও মনে রাখবে। সেটি অবশ্য অবসর নেওয়ার পর।
জেমস সেই অবসর কবে নেবেন, তা নিয়ে স্পষ্ট করে কিছুই বলেননি। শুধু ‘দ্য অ্যাথলেটিক’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে একটু ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন, ‘ক্যারিয়ারের শেষ বছরটা আমি নিজের সন্তানের সঙ্গে খেলতে চাই। ব্রনি যেখানেই থাকুক, আমি সেখানেই থাকব।’
ব্রনি, বাসাবাড়ির অনুশীলনেও আপনি নিশ্চয়ই জানেন লেব্রন জেমসের সঙ্গে খেলার চাপ কেমন! লোকে যে তাঁকে রক্তমাংসের মানুষ নয়, ‘চুজেন ওয়ান’ ভেবে এসেছে আর সেই ভাবনাই কাল অনেকটাই বাস্তবে রূপ দিলেন জেমস। প্রতিপক্ষকে যেভাবে ডিঙিয়ে পয়েন্ট নিয়ে আসেন, চাইলে তাঁর সঙ্গে ‘বন্ড’ নামটাও জুড়ে দিতে পারেন—বাস্কেটবলের জেমস বন্ড!