২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

ক্লাবের হাতেই জিম্মি খেলা

বাংলাদেশের ঘরোয়া হকি মানে শুধুই হতাশার গল্পছবি: শামসুল হক
হকিতে আন্তর্জাতিক সাফল্য আসছে, কিন্তু সেটি মূলত বিকেএসপির খেলোয়াড়দের হাত ধরে। বাংলাদেশের ঘরোয়া হকি মানে শুধুই হতাশার গল্প। কোথায় আটকে গেল হকি?

মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামে গত নভেম্বরে দেশের প্রথম ফ্র্যাঞ্চাইজি হকি লিগের স্মৃতি এখনো তরতাজা। হকির সংসার থেকে সব অভাব-অভিযোগ তখন কদিনের জন্য বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অনেকে আশা করেছিলেন, এবার ঘরোয়া হকিতে নতুন দিন ফিরবে। টাকার অভাব হবে না। ক্লাবগুলো আর কোনো গোঁ ধরবে না। অন্তত ঘরোয়া খেলাটা নিয়মিত হবে।

কিন্তু সেটা ছিল আসলে একটা বিভ্রম। ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ শেষে সব আবার আগের মতো। ঘরোয়া লিগ নিয়ে পুরোনো টালবাহানা এখনো চলছে। ২০১৮ সালে সর্বশেষ হওয়া প্রথম বিভাগ হকি চার বছর পর আয়োজনের উদ্যোগ নিয়ে গত ২১-২৪ নভেম্বর দলবদলও হয়ে গেছে। কিন্তু এরপর আড়াই মাস হতে চলেছে এখনো খেলা মাঠে গড়ানোর খবর নেই। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে এ রকম ঘটনা নজিরবিহীন।

ফেডারেশন টাকা দিলে খেলব, নইলে খেলব না, এটা হতে পারে না। বাংলাদেশের হকিতে অতীতে এমনটা কখনো দেখিনি। ক্লাব খেলব না বলে গোঁ ধরলে তাদের আর থেকে লাভ কী?’
মাহবুব হারুন, জাতীয় হকি দলের সাবেক খেলোয়াড় ও কোচ

প্রথম বিভাগ লিগের ১২ ক্লাবের দাবি, তাদের আর্থিক অনুদান দিতে হবে। ২০২১ সালে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এক কোটি টাকা নিয়ে প্রিমিয়ার লিগের ১২ ক্লাবকে অনুদান দিয়েছে হকি ফেডারেশন। এখন প্রথম বিভাগের ১২ ক্লাবও সে রকম কিছু চাইছে। খেলা মাঠে নামানোর স্বার্থে ফেডারেশনও কিছু অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হচ্ছে না বলেই খেলতে রাজি হচ্ছে না ক্লাবগুলো।

প্রথম বিভাগ হকি লিগের অন্যতম ক্লাব ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের হকি সম্পাদক সাবেক জাতীয় হকি খেলোয়াড় কামরুল ইসলাম (কিসমত) বলেছেন, ‘ফেডারেশন প্রথম বিভাগের ১২টি ক্লাবকে দলবদলের আগেই ২ লাখ টাকা করে দেবে বলেছিল। কিন্তু দলবদল শেষ হয়ে গেলেও এখনো সেটা দেয়নি। টাকা যখন দেবে, তখনই শুরু হয়ে যাবে খেলা।’

ফেডারেশনের স্থায়ী আমানত ক্লাবকে অনুদান দেওয়ার জন্য নয়। কিন্তু হকির অন্য কার্যক্রমও নেই বলে স্থায়ী আমানত ভেঙে ক্লাবগুলোকে মাঠে নামানোর প্রস্তাব আসছে।
আরও পড়ুন

এমনিতে ফেডারেশনের টাকায় ক্লাব চলবে, এটা কোনো সমাধান নয়। তবে ফেডারেশন যদি প্রতিশ্রুতি দিয়েই থাকে, সেটি পূরণের দায়িত্বও তাদের নিতে হবে। কামরুল ইমলাম যেহেতু হকি ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদকও, তাঁকেই করা হয়েছিল প্রশ্নটা—কেন প্রতিশ্রুতি পূরণ করছে না ফেডারেশন? কিন্তু উত্তর পাওয়া গেল না, ‘এটা আমি জানি না। ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, সহসভাপতিরা বলতে পারবেন।’ কামরুল ইসলামের দাবি, প্রয়োজনে ফেডারেশনের স্থায়ী আমানত ভেঙে হলেও ক্লাবকে টাকা দেওয়া উচিত, ‘অতীতে জরুরি প্রয়োজনে ফেডারেশনের স্থায়ী আমানত ভাঙা হয়েছে। সে রকম প্রয়োজনে এখন কেন তা ভাঙা হচ্ছে না, বোধগম্য নয়।’

আমরা ক্লাবগুলোকে বলেছি, ফেডারেশনের আর্থিক সংকট আছে। কিন্তু ক্লাব টাকা ছাড়া খেলবে না। কিন্তু খেলা তো শুরু করতে হবে। তাই সহসভাপতিরা ক্লাবগুলোকে বলেছিলেন, সভাপতির সঙ্গে আলোচনা করে অনুদানের ব্যবস্থা করবেন। এখন সভাপতি মহোদয়ই সিদ্ধান্ত দেবেন।
মোহাম্মদ ইউসুফ, হকি ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক

ফেডারেশনের স্থায়ী আমানত ক্লাবকে অনুদান দেওয়ার জন্য নয়। কিন্তু হকির অন্য কার্যক্রমও নেই বলে স্থায়ী আমানত ভেঙে ক্লাবগুলোকে মাঠে নামানোর প্রস্তাব আসছে। ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইউসুফের কণ্ঠে অসহায়ত্ব, ‘আমরা ক্লাবগুলোকে বলেছি, ফেডারেশনের আর্থিক সংকট আছে। কিন্তু ক্লাব টাকা ছাড়া খেলবে না। কিন্তু খেলা তো শুরু করতে হবে। তাই সহসভাপতিরা ক্লাবগুলোকে বলেছিলেন, সভাপতির (বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল শেখ আবদুল হান্নান) সঙ্গে আলোচনা করে অনুদানের ব্যবস্থা করবেন। এখন সভাপতি মহোদয়ই সিদ্ধান্ত দেবেন।’

ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইউসুফকে পুরান ঢাকার হকি সংগঠকেরা মানতে পারেননি। ইউসুফ চট্টগ্রামের সংগঠক হয়েও ঢাকায় এসে হকি চালাচ্ছেন, এটা অনেকের গাত্রদাহের কারণ। হকি ফেডারেশনে তাই গড়ে ওঠেনি কোনো ‘টিমওয়ার্ক’।
বাংলাদেশের হকি বরাবরই ক্লাবের হাতে জিম্মি
ফাইল ছবি

জানা গেছে, অনুদানের জন্য দু-একটি স্পনসরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও সাড়া মেলেনি। তাই ক্লাবগুলোকে ফেডারেশন থেকেই অনুদান দেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। আগামী এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত টাকা দিয়ে ক্লাবগুলোকে মাঠে নামালে সেটি বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলেই মনে করেন সাবেক জাতীয় খেলোয়াড় ও কোচ মাহবুব হারুন, ‘ফেডারেশন টাকা দিলে খেলব, নইলে খেলব না, এটা হতে পারে না। বাংলাদেশের হকিতে অতীতে এমনটা কখনো দেখিনি। ক্লাব খেলব না বলে গোঁ ধরলে তাদের আর থেকে লাভ কী?’

বাংলাদেশের হকি অবশ্য বরাবরই ক্লাবের হাতে জিম্মি। ক্লাব কর্মকর্তারাই বসেন ফেডারেশনের চেয়ারে, তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছে অনেকবারই। সর্বশেষ তা এসেছে ক্যাসিনো-কাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুমিনুল হক সাইদ আত্মগোপনে চলে যাওযার পর।

আরও পড়ুন

ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইউসুফকে পুরান ঢাকার হকি সংগঠকেরা মানতে পারেননি। ইউসুফ চট্টগ্রামের সংগঠক হয়েও ঢাকায় এসে হকি চালাচ্ছেন, এটা অনেকের গাত্রদাহের কারণ। হকি ফেডারেশনে তাই গড়ে ওঠেনি কোনো ‘টিমওয়ার্ক’। এর প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে গত কয়েক বছরে অনেক কিছু্ বদলালেও বদলায়নি শুধু হকি।

হতাশা ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ নিয়েও

স্থবির ঘরোয়া হকিতে আশার আলো ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ। কিন্তু সেই লিগ নিয়েও এখন হতাশা। লিগ শেষে আড়াই মাস পেরিয়ে গেলেও স্থানীয় খেলোয়াড়েরা এখন পর্যন্ত পেয়েছেন শুধু অর্ধেক পারিশ্রমিক। কয়েকবার সময় দেওয়া হলেও এখনো বাকি টাকা দিতে পারেনি ফ্র্যাঞ্চাইজিরা।

এ নিয়ে খেলোয়াড়দের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। সময়মতো খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক শোধ করতে না পেরে হতাশ দেশের প্রথম ফ্র্যাঞ্চাইজি হকির স্বত্ব কেনা প্রতিষ্ঠান এইসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইশতিয়াক সাদেক, ‘আমরা স্পনসরের কাছ থেকে এখনো সব টাকা পাইনি। স্থানীয় খেলোয়াড়দের তাই বাকি টাকা দেওয়া যাচ্ছে না।’