আতিকুর রহমান: স্বপ্ন দেখার সাহস তাঁর হাত ধরেই
আবদুস সাত্তার নিনি এখন সুইজারল্যান্ডে। তিনি নিশ্চয়ই পেয়ে গেছেন দুঃসংবাদটা। ৩৪ বছর আগে অকল্যান্ডের শুটিং রেঞ্জে যাঁর সঙ্গে দাঁড়িয়ে দেশকে সোনার পদক উপহার দিয়েছিলেন, সেই আতিকুর রহমান যাত্রা করেছেন অনন্তের পথে। দুজন মিলেই ১৯৯০ সালে কমনওয়েলথ গেমসে ১০ মিটার এয়ার পিস্তল ইভেন্টে দেশকে গর্বিত করেছিলেন। প্রথমবারের মতো বড় কোনো আন্তর্জাতিক সাফল্যে আনন্দে ভাসিয়েছিলেন দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে। মৃত্যুর অমোঘ ছায়া আজ কেড়ে নিয়েছে তাঁর সঙ্গীকে।
১৯৮৬ সালে সিউল এশিয়ান গেমসের বক্সিংয়ে ব্যক্তিগত ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন মোশাররফ হোসেন। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা সাফ গেমসকে (এখন এসএ গেমস) একপাশে সরিয়ে রাখলে সেটিই ছিল এশীয় পর্যায়ে কোনো বাংলাদেশি ক্রীড়াবিদের প্রথম কীর্তি। কিন্তু তার ঠিক চার বছর পর ১৯৯০ সালের জানুয়ারিতে দেশের মানুষকে বিস্ময় উপহার দিয়ে অকল্যান্ড কমনওয়েলথ গেমসে শুটিংয়ে সর্বোচ্চ পদক সোনা এনে দেন আতিকুর রহমান ও আবদুস সাত্তার নিনি। সেই গেমসে এই দুজন আরেকটি ইভেন্টে দলগত ব্রোঞ্জও জিতেছিলেন। এশিয়ান গেমসের বাইরে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সেটিই ছিল প্রথম কোনো সাফল্য।
আজকের দিনে ছাদখোলা বাসের কথা অনেক শোনা যায়। আতিক-নিনি যেদিন অকল্যান্ড থেকে দেশে ফিরেছিলেন, সেদিন তাঁদের দুজনকে খোলা ট্রাকে তুলে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। তখন ঢাকা শহরের মানুষ ‘যানজট’ শব্দটার সঙ্গে সেভাবে পরিচিত ছিল না। কিন্তু জানুয়ারির সেই শীতের সকালে আতিক-নিনির সংবর্ধনা, বিমানবন্দর থেকে তাঁদের নিয়ে ট্রাক মিছিল ঢাকা শহরে যানজট তৈরি করেছিল। শত শত মানুষ সেদিন তাঁদের জানিয়েছিলেন শুভেচ্ছা।
বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসের অন্যতম সেরা ক্রীড়াবিদের প্রয়াণ হলো আজ। আতিকুর রহমান কমনওয়েলথ গেমসের সেই সাফল্যেই থেমে থাকেননি, এরপর দেশকে আরও গৌরব উপহার দিয়েছেন। ১৯৯৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ সাফ গেমস ও এর দুই বছর পর ১৯৯৫ সালে মাদ্রাজ (বর্তমানে চেন্নাই) সাফ গেমস মিলে ব্যক্তিগত ও দলগতভাবে জিতেছিলেন ৫টি সোনা। এর বাইরেও অন্যান্য আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় তিনি সাফল্য পেয়েছেন।
জাতীয় পর্যায়ে ১০ মিটার এয়ার পিস্তলে তিনি দীর্ঘদিন ছিলেন প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেয়েছেন। পেয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পদক। দেশের ইতিহাসে খুব কম ক্রীড়াবিদই এই সম্মাননা পেয়েছেন। খেলা ছেড়ে দেওয়ার পরও নানা ভূমিকায় ছিলেন তিনি শুটিংয়ের সঙ্গে, ছিলেন শুটিং স্পোর্ট ফেডারেশনের কোচও। প্রশাসনিক দায়িত্বেও ছিলেন। চট্টগ্রাম থেকে উঠে আসা আতিকুর রহমান চিটাগং শুটিং ক্লাবের কোচ হিসেবে নতুন প্রজন্মের শুটার তৈরিতেও রেখেছেন ভূমিকা। গোটা নব্বইয়ের দশকে ফুটবল ও ক্রিকেট তারকাদের বাইরে আতিকুর রহমানকে সবচেয়ে বড় সেলিব্রিটি ক্রীড়াবিদ বললে খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যায় না।
এমন একজন ক্রীড়াবিদের প্রয়াণটা হলো অনেকটা নীরবে-নিভৃতেই। চট্টগ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করছিলেন। মাঝেমধ্যে ছেলের কাছে ঢাকায় এসে থাকতেন। স্ত্রী ও দুই ছেলে–মেয়ে নিয়ে ছিল তাঁর সংসার। ছেলে–মেয়ে দুজনই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। ২০১৪ সালে তাঁর কণ্ঠনালির ক্যানসার ধরা পড়ে। এরপর থেকে অনেকটাই নিভৃতবাস তাঁর। ক্যানসারের ব্যয়বহুল চিকিৎসা তাঁকে আর্থিক দিক দিয়েও বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিল। মাসখানেক আগে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আতিকুর রহমানের কথা হয়েছিল। বলেছিলেন, ‘শরীরটা একেবারেই ভালো যাচ্ছে না, আমার জন্য দোয়া করবেন।’
দেশের ক্রীড়াঙ্গন নিয়েও আগ্রহ হারিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘যেভাবে এ দেশের ক্রীড়াঙ্গন চলে আসছে, সেভাবে কিছুই হবে না।’ আক্ষেপ করে বলেছিলে, ‘বড় প্রতিযোগিতায় আমরা যে জিততে পারি, সেটা তো নিনি ভাই (আবদুস সাত্তার) আর আমি ১৯৯০ সালেই দেখিয়েছিলাম। এরপর কত বছর কেটে গেল। আমরা সেই সাফল্যকে ভিন্ন স্তরে নিতে পারলাম না। এশিয়ান গেমস কিংবা অলিম্পিক—এই দুটি বড় আসরেও আমরা সাফল্য পেতাম, যদি আমাদের নীতিনির্ধারকেরা যত্নশীল হতেন।’
অনেক আক্ষেপ নিয়েই চলে গেলেন আতিকুর রহমান। তবে ক্রীড়াবিদ আতিকের জীবনটা উদ্যাপন করার মতোই। ৩৪ বছর আগে আবদুস সাত্তার নিনির সঙ্গে যে গৌরব দেশকে উপহার দিয়েছিলেন তিনি, সেটি যে চিরদিনই এ দেশের ক্রীড়াঙ্গনের প্রেরণা।