বাংলাদেশি ও আর্জেন্টাইনরা ‘ভাই-ভাই’
ঘুমঘুম চোখেও হাসি লেগে রয়েছে মুখে। ছোটখাটো গড়ন আর মুখভর্তি সাদা দাড়ি। দূর থেকে দেখলে কিছুটা ডিয়েগো ম্যারাডোনার মতো মনে হয়। তবে ম্যারাডোনা এই ধরাধামে তো আর নেই। কিংবদন্তি মারা গেছেন ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর।
অনন্তলোকের বাসিন্দা ম্যারাডোনার কথা মনে করিয়ে দেন এই ভদ্রলোক। প্রথমত, মানুষটি ম্যারাডোনার দেশ আর্জেন্টিনারই। গড়পড়তা আর্জেন্টাইনরা যে উচ্চারণে ইংরেজিতে কথা বলেন, রিকার্দো আকুনিয়া ঠিক তেমনই। একজন খাঁটি আর্জেন্টাইন।
গতকাল বিকেলে আকুনিয়াকে আবিষ্কার করা গেল ঢাকায় পল্টনের একটি হোটেলে। ঢাকায় ১৩ মার্চ শুরু হতে যাওয়া তৃতীয় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কাবাডি টুর্নামেন্টে অংশ নিতে প্রথমবার আর্জেন্টিনা কাবাডি দল নিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে। দলটির কোচ তিনি। শুধু কোচ বললে যেন কিছুই বলা হয় না; আর্জেন্টিনা কাবাডি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিও এই মানুষটি। বলা যায়, আকুনিয়া আর্জেন্টাইন কাবাডির মুখ।
পেশা অবশ্য ভিন্ন। স্কুলে শারীরিক শিক্ষার শিক্ষকতা করেন। একসময় কাবাডি খেলার সূত্রে আজ আর্জেন্টিনার কাবাডির প্রাণপুরুষ হয়ে উঠেছেন। তবে খেলেছেন রাগবি, ব্যাডমিন্টন ও পেশাদার ফুটবলও। এরপর নিজেই দিলেন অবাক করা এক তথ্য, ‘আমি ৪০টি দেশে ব্যাডমিন্টন খেলেছি।’ সঙ্গে যোগ করলেন, ‘জাতীয় স্তরে আমি ব্যাডমিন্টন কোচও। আমি কানাডায় কাবাডি খেলেছি। আর্জেন্টিনায় অনেক মানুষই চার থেকে পাঁচটি খেলা খেলে। একটা নিয়ে পড়ে থাকে না কেউ। আমিও তা-ই করেছি।’
গতকাল সকালে ঢাকা আসার পর বিকেলে হোটেলের লবিতে কথা হয় আকুনিয়ার সঙ্গে। ৫৫ বছর বয়সী আকুনিয়া ২০০২ সালে আর্জেন্টিনায় কাবাডি অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন। তখন দেশটিতে হাতে গোনা দু-চারজন কাবাডি খেলতেন। এখন সংখ্যাটা মেরেকেটে শ-খানেক হবে। এই শ-খানেক খেলোয়াড় রাজধানী বুয়েনস এইরেস এবং তার আশপাশের।
দেশটিতে কাবাডি দল আছে মাত্র ছয়টি। হয় না কোনো কাবাডি লিগ, বছরে হয় মাত্র দুটি টুর্নামেন্ট। আকুনিয়ার ভাষায়, ‘কাবাডির কোনো প্রচার নেই আমাদের ওখানে। পত্রিকায় আমাদের খবর দেয় না। কাবাডি খেলে কোনো টাকাও নেই। খেলোয়াড়েরা নিজের পয়সা খরচ করে কাবাডি খেলে। আমরা যে বাংলাদেশে এলাম, সব খরচ কিন্তু বাংলাদেশের ফেডারেশনের। আমাদের ওখানে টাকা হলো ফুটবল আর রাগবিতে। বাস্কেটবল, হকিতেও কিছু আছে। আসলে আর্জেন্টিনায় কাবাডি অতি ক্ষুদ্র একটা খেলা। কেউ খেলতে চায় না এটি।’
যে কারণে অন্য অনেক খেলার সঙ্গে যুক্ত খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া হয়েছে আর্জেন্টিনার কাবাডি দল। ঢাকায় আসা দলটির ১২ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে ৩ জন কুস্তিগির, ১ জন হর্স রাইডার, ভালো মানের ৩ জন ফুটবলার আছেন দ্বিতীয় বিভাগে খেলা। দলে আছেন তায়কোয়ান্দো খেলোয়াড়ও। অর্থাৎ বিভিন্ন খেলার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের নিয়ে পাঁচমিশালি একটা কাবাডি টিম তৈরি করেছেন। বিশ্ব কাবাডি র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ যেখানে পঞ্চম, আর্জেন্টিনা ২৬তম।
কথোপকথনের এ পর্যায়ে অনিবার্যভাবে চলে আসে ফুটবল প্রসঙ্গ। আর্জেন্টিনা মানেই ফুটবলের দেশ। আকুনিয়ার ভাষায়, ‘আর্জেন্টিনায় শুধু ফুটবল, ফুটবল, ফুটবল...। ফুটবলের পর রাগবি জনপ্রিয়।’ গত ডিসেম্বরে কাতার বিশ্বকাপ ফুটবল জিতেছে মেসিদের দেশ।
১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের সময় আকুনিয়ার বয়স ছিল ১০। ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জয়টা মনে বেশি দাগ কেটে আছে। আড়াই মাস আগে তৃতীয়বার বিশ্বকাপ জেতার সময় আকুনিয়া দিল্লি ছিলেন কাবাডির এক অনুষ্ঠানে। বিশ্ব কাবাডি ফেডারেশনের সহসভাপতি যে তিনি। সেখানেই নাকি পাগলের মতো মেসিদের বিশ্বকাপ জয় উদ্যাপন করেন। অনুষ্ঠান মঞ্চেই চিৎকার করে বলেন, ‘উই আর চ্যাম্পিয়ন, চ্যাম্পিয়ন!’
ডিয়েগো ম্যারাডোনার সঙ্গে আকুনিয়ার দুবার দেখা হয়েছে। স্মৃতিচারণা করলেন আকুনিয়া, ‘প্রথমবার ১৯৯৪ বিশ্বকাপে ডিয়েগো মাদক নেওয়ার অভিযোগে শাস্তি পাওয়ার পর। ম্যারাডোনা তখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বুয়েনস এইরেসে এলেন। তখন একদিন তিনি ব্যাডমিন্টন খেলছিলেন। কাছে গিয়ে তাঁকে বললাম, হাই ডিয়েগো। তিনি জবাবও দেন। সেই স্মৃতিটা কখনো ভুলব না।’
ম্যারাডোনার মৃত্যুর পর বাংলাদেশের মানুষ কেঁদেছে—কথাটা জানানোর পর আকুনিয়া বললেন, ‘আমাদের ওখানেও তা-ই। সবাই তাঁকে ভীষণ ভালোবাসে। বাংলাদেশের মানুষ আর্জেন্টিনাকে ভালোবাসে, আর্জেন্টাইনরাও বাংলাদেশকে ভালোবাসে। আমরা ভাই-ভাই। যদি বলেন শত্রুতার কথা, ইংল্যান্ডের সঙ্গে আমাদের শত্রুতা। সেই শত্রুর বিরুদ্ধে ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ডিয়েগো কী করেছিলেন, মনে আছে না? তাঁর সেই অবিস্মরণীয় গোল দুটি সময়-সময় চোখে ভাসে।’
কে সেরা? ম্যারাডোনা না মেসি? আকুনিয়া দ্বিধাহীন এই প্রশ্নে, ‘আমাদের কাছে ডিয়েগো ঈশ্বর-সমতুল্য।’ তাহলে মেসি? উত্তর, ‘মেসি নতুন ঈশ্বর। তবে আমার চোখে আর্জেন্টিনার সর্বকালের সেরা ফুটবলার ডিয়েগোই। তিনিই আমাদের ঈশ্বর। তরুণ প্রজন্মের কাছে অবশ্য মেসি ঈশ্বর, বলতে পারেন, তরুণ ঈশ্বর। মেসি আরও দু-তিন বছর খেলবে। সে আরও কিছু করার সুযোগ পাবে।’
আর্জেন্টিনার মানুষ এখনো প্রতিদিন ম্যারাডোনাকে স্মরণ করে। কিছুটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকুনিয়া বলে যান, ‘ডিয়েগোর ছবি ঝোলে এখনো আর্জেন্টিনার অনেক ভবনে। অনেক মানুষ নিজের শরীরে উলকি আঁকে ডিয়েগোর। এটা তাঁর প্রতি মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা। ডিয়েগো বেঁচে থাকবেন মানুষের মধ্যে।’
মেসির পর এখন আর্জেন্টিনায় কে বেশি জনপ্রিয়? আনহেল দি মারিয়ার নামটা বলেন আকুনিয়া, ‘সে দলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। বড় ম্যাচে গোল করে। গত কোপা আমেরিকার ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে একমাত্র গোলটি করেছে। বিশ্বকাপ ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে গোল করেছে। সে সব সময় বড় ম্যাচে গোল করে। দি মারিয়া আমারও খুব প্রিয়।’
বাংলাদেশের মানুষের কাছে আর্জেন্টিনা ফুটবল দল খুব প্রিয়, যার প্রমাণ এবারের বিশ্বকাপে পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে বেশ কয়জন আর্জেন্টাইন ফুটবলার খেলে গেছেন। কোচ হিসেবে কয়েকবার কাজ করে গেছেন আর্জেন্টাইন ডিয়েগো ক্রুসিয়ানি। ক্রুসিয়ানিকে চেনেন কি না জানতে চাইলে বলেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি তাঁর কথা জানি। আসলে আর্জেন্টিনায় ভালো ভালো কোচ আছেন। লাতিন আমেরিকায় কলম্বিয়া, চিলি, ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর প্রভৃতি দেশে আর্জেন্টিনার কোচরা কাজ করেন।’
কয় দিন আগে ঢাকায় দূতাবাস খুলেছে আর্জেন্টিনা। অনেক আর্জেন্টাইন এখন বাংলাদেশে আসতে চান জানিয়ে আকুনিয়া বলেন, বাংলাদেশ-আর্জেন্টিনা বন্ধুত্ব আরও দৃঢ় হবে বলে তাঁর আশা, ‘আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসেছেন ঢাকায়। এখানে নতুন দূতাবাসের প্রধান যিনি, সেই ভদ্রমহিলা এসেছেন। আর্জেন্টিনা কাবাডি টিম ঢাকায় আর্জেন্টিনা দূতাবাস দেখতে যাবে। তখন তাঁর সঙ্গে দেখা হবে।’
বুয়েনস এইরেস থেকে ২ হাজার ৩০০ কিলোমিটার দূরে পাতাগোনিয়ায় আকুনিয়ার বাড়ি। সেখান থেকে বাসে বুয়েনস এইরেসে আসেন দুই দিনে। তারপর বাংলাদেশে আসতে লাগল দুই দিন। এই চার দিনের মধ্যে দুই রাত তাঁর কেটেছে নির্ঘুম। তাই সাক্ষাৎকার পর্ব শেষ করার তাড়া দিয়ে বললেন, ‘বাংলাদেশে আসতে ৪২ ঘণ্টা আমাদের রাস্তায় কেটেছে। বুয়েনস এইরেস থকে ব্রাজিল, দুবাই হয়ে ঢাকা এসেছি। খেলোয়াড়েরা সবাই ঘুমাচ্ছে। আমি যাই, ঘুমাতে হবে। বুঝতেই পারছেন আমি ভীষণ ক্লান্ত।’
ম্যারাডোনা-মেসিদের দেশের কাবাডির এই ‘ফেরিওয়ালা’র স্বপ্ন একটাই—কাবাডিকে আরও তুলে ধরা। অদম্য চেষ্টার জোরে ফুটবলের দেশটিতে তিনি কাবাডি-ফুল ফুটিয়ে চলেছেন।