বাবা ছিলেন ক্রিকেটার, শুটিংয়ে এসে মেয়ের চমক
বাবা শামসুল আরেফিন চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগে খেলেছেন। মা শাহিন আক্তার কারাতেকা। মা–বাবার দেখানো পথে হেঁটে খেলাধুলার জগতে এসেছেন শায়েরা আরেফিন। তবে ক্রিকেট বা কারাতে কোনোটিই বেছে নেননি। হয়েছেন শুটার। গুলশান শুটিং কমপ্লেক্সে চলমান ৩০তম জাতীয় শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপে আজ মেয়েদের ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে সোনা জিতে সব আলো কেড়ে নিয়েছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন শুটিং ক্লাবের এই তরুণী।
এবারের জাতীয় শুটিংয়ে শায়েরার উত্থানটা চমকজাগানিয়া। মেয়েদের ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে অংশ নিয়েছেন কামরুন নাহার (কলি), নাফিসা তাবাসসুমদের মতো শুটাররা। গত বছর অক্টোবরে কামরুন নাহার মিসরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপে ১৩৪ জনের মধ্যে ৬২৯.২ পয়েন্ট স্কোর করে ১৪তম হয়েছিলেন।
সেবার মাত্র ০.৮ পয়েন্টের জন্য ফাইনালে উঠতে পারেননি তিনি। এরপর গত জানুয়ারিতে ইন্দোনেশিয়ায় শুটিং বিশ্বকাপে সবাইকে চমকে দিয়ে প্রথমবারের মতো এই ইভেন্টের সেরা আটে উঠে শেষ পর্যন্ত ষষ্ঠ হয়েছেন কামরুন নাহার। আর নাফিসা তাবাসসুম গত বছর ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত আইএসএসএফ (আন্তর্জাতিক শুটিং স্পোর্ট ফেডারেশন) গ্রাঁ প্রিতে জেতেন ব্রোঞ্জ।
আন্তর্জাতিক শুটিং স্পোর্ট ফেডারেশন আয়োজিত কোনো প্রতিযোগিতায় দেশের হয়ে তিনিই প্রথম পদক জেতেন। এসব শুটারকে টপকে এবারের জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতলেন অখ্যাত শায়েরা। রুপা জিতেছেন নাফিসা। ব্রোঞ্জ কামরুন নাহারের।
জাতীয় পর্যায়ে এই প্রথম অংশ নিয়েছেন শায়েরা। প্রথমবার জাতীয় শুটিংয়ে অংশ নিয়েই বাজিমাত। এর আগে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ গেমসে অংশ নিলেও খালি হাতে ফেরেন। অবশ্য ২০২১ সালে হামিদুর রহমান চতুর্থ জাতীয় যুব শুটিংয়ে জেতেন ব্রোঞ্জ। অভিজ্ঞ শুটারদের হারিয়ে এবার সোনা জয়ের ব্যাপারে কতটা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন? গুলশান শুটিং রেঞ্জে দাঁড়িয়ে শায়েরার চটপট জবাব, ‘আমি আসলে শুটিংটা বেশ উপভোগ করেছি। ফাইনালে উঠলেও কোনো চাপ নিইনি। শুধু নিজের কাজটাই করেছি।’
বাছাইপর্বে ৬৩০.১ পয়েন্ট স্কোর করে প্রথম হয়ে ফাইনালে ওঠেন কামরুন নাহার। ৬২৭ পয়েন্ট পেয়ে দ্বিতীয় হয়ে ফাইনালে ওঠেন শায়েরা। ২০-২৭ মার্চ ভারতে অনুষ্ঠিত হবে শুটিং বিশ্বকাপ। কামরুন নাহার ও নাফিসার সঙ্গে বিশ্বকাপের দলে জায়গা করে নিয়েছেন শায়েরাও। জাতীয় প্রতিযোগিতা শুরুর আগেই বিশ্বকাপের দল ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ শুটিং স্পোর্ট ফেডারেশন।
ইরানি কোচ মোহাম্মদ জায়ের রেজার আস্থার প্রতিদান দিতে পেরে খুশি শায়েরা, ‘কোচ আমাকে এবারের বিশ্বকাপের দলে সুযোগ দিয়েছেন, এতে খুশি আমি। ফাইনালে নিজেকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, এমন চাপের মধ্যে নিজের সেরাটা কীভাবে দিতে হয়, সেটা শিখতে পেরেছি। আশা করি এই অভিজ্ঞতা বিশ্বকাপে কাজে লাগবে।’
শুরুতে ক্রিকেটার হতে চেয়েছিলেন শায়েরা। কিন্তু পরিবারের চাপে ক্রিকেটে যেতে পারেননি। শুটিংয়ে আসার ইচ্ছাটা জন্মে প্রথম আলো পত্রিকা পড়ে। হাসতে হাসতে সেই গল্প বলছিলেন শায়েরা, ‘পরিবারের কেউ ক্রিকেটে দিতে রাজি হননি। তখন প্রথম আলোতে এক শুটার আপুর সাক্ষাৎকার পড়ে আম্মুকে বলেছিলাম। আম্মু খোঁজখবর নিয়ে আমাকে শুটিংয়ে ভর্তি করে দেন।’
চট্টগ্রাম শহরে জিইসি মোড়ে বাড়ি শায়েরার। সদ্যই উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। শায়েরার মতোই চট্টগ্রাম থেকে উঠে এসেছেন কমনওয়েলথ গেমসে সোনাজয়ী আতিকুর রহমান, এসএ গেমসে দলগত সোনাজয়ী সৈয়দা সাদিয়া সুলতানা। তাঁদের মতো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সোনা জয়ের স্বপ্ন দেখেন শায়েরাও, ‘সাদিয়া আপুর সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল। উনি আমাকে অনেক টিপস দিয়েছিলেন। ওনাদের মতোই দেশের পতাকা উঁচুতে তুলে ধরতে চাই।’
এবারের জাতীয় প্রতিযোগিতায় টেকনিক্যাল কর্মকর্তার দায়িত্বে আছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন শুটিং ক্লাবের সদস্য আতিকুর রহমান। শায়েরার পারফরম্যান্স দেখে মুগ্ধ তিনি, ‘ওকে আমি পেয়েছি অনেক আগেই। মাঝখানে পারফরম্যান্স ভালো হচ্ছিল না বলে শুটিং ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। ওর মাকে অনুরোধ করে ফিরিয়ে এনেছি। এত কম বয়সে ঘরোয়া আসরে ভালো করেছে, এতে খুব খুশি আমি। তবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পদক জিতলেই বোঝা যাবে, ও কতখানি ভালো করেছে।’