বিকেএসপি ছাড়া হকির ভবিষ্যৎ কী
ধরা যাক, বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি) বলে কিছু এই দেশে নেই। এমনটা হলে দেশে হকি বলে কি কিছু থাকত! প্রশ্নটা সাম্প্রতিক কালে উঠছে। বিশেষ করে ২৭ মাস পর গত ফেব্রুয়ারিতে ঘরোয়া হকি মাঠে গড়ানোর পর দেখা যাচ্ছে, দেশের একমাত্র ক্রীড়াশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খেলোয়াড় না থাকলে ক্লাবগুলো দল গড়তে সমস্যায় পড়ে। বিশেষ করে ছোট দলগুলো।
এবার প্রিমিয়ার হকি লিগে যে ১১টি ক্লাব খেলেছে, তাতে খেলোয়াড়ের সংখ্যা ছিল ২০২। তাঁদের মধ্যে বিকেএসপির সাবেক ও বর্তমান ছাত্রই ১১৯ জন। বর্তমান ছিল ২৪ জন। ৮৩ জন বিকেএসপির বাইরের ও বিদেশি খেলোয়াড়। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের হকিতে বিকেএসপির সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে খেলোয়াড়ের সংখ্যা প্রায় ৫৯ শতাংশ। এবারের প্রিমিয়ার লিগে অংশ নেওয়া দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবেরই শুধু বিকেএসপির কোনো খেলোয়াড় ছিল না। জাতীয় দলেও ২০১৭ সালের পর বিকেএসপির বাইরে কোনো খেলোয়াড় নেই। বিকেএসপির বাইরে থেকে উঠে আসা খেলোয়াড়দের মান নিয়েও এবারের লিগে প্রশ্ন উঠেছে।
পরিসংখ্যানই বলছে, বিকেএসপির খেলোয়াড় ছাড়া দেশের হকি মোটামুটি অচল। একটা সময় পুরান ঢাকা ছিল হকির কেন্দ্র। হকির একটা ঐতিহ্যই ছিল ঢাকার পুরোনো অংশে। পুরান ঢাকার আরমানিটোলা স্কুল থেকেই দেশ পেয়েছে অনেক হকি তারকা। অতীতে দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের হকিতে ছিল পুরান ঢাকার খেলোয়াড়দের আধিক্য। দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকেও নিয়মিত হকি খেলোয়াড় উঠে আসত। ফরিদপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর, যশোর ছিল পুরান ঢাকার বাইরে হকি খেলোয়াড় জোগানের জায়গা। কিন্তু এখন সেই জোগান প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে। কারণ, হকির চর্চা কমে যাওয়া, নিয়মিত লিগ না হওয়া, অবকাঠামোর অভাব। দেশে হকির প্রতিভা অন্বেষণের কার্যক্রম নেই বললেই চলে; ক্লাব বা ফেডারেশন—কেউই প্রতিভা অন্বেষণে আগ্রহী নয়।
বিকেএসপিই একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যারা সারা দেশ থেকে বিভিন্ন খেলার মতো প্রতিভাবান হকি খেলোয়াড় বাছাই করে প্রশিক্ষণের কাজ করে যাচ্ছে। বিকেএসপির খেলোয়াড় না থাকলে যে দেশের হকির ভবিষ্যৎ অন্ধকার, কথাটা সে কারণেই উঠছে।
জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও কোচ মাহবুব হারুন ফরিদপুর থেকে উঠে এসেছিলেন। তিনি নিজ জেলা ফরিদপুরে হকির কার্যক্রম নিয়ে বেশ হতাশ, ‘আগের মতো ফরিদপুরে হকির চর্চাটা হয় না। বাচ্চারাই তো আগ্রহী নয় হকি নিয়ে। আর যারা আগ্রহী হয়, খেলতে আসে, তাদের তো বিকেএসপি নিয়ে যাচ্ছে। এখন বিকেএসপিতে ফরিদপুর, রাজশাহী, যশোর—সব জায়গারই খেলোয়াড় আছে। কিন্তু সংখ্যাটা খুব বেশি নয়।’
বিকেএসপির আসনসংখ্যা সীমিত। প্রতিভা অন্বেষণ করলেও একটা জেলা থেকে খুব বেশি খেলোয়াড় নেওয়ার সুযোগ তাদের নেই। বিকেএসপি সূত্র জানাচ্ছে, প্রতিবছর প্রতিষ্ঠানটি কমবেশি ৩০ জন ছেলেমেয়েকে হকিতে ভর্তি করছে। তারা সবাই যে শেষ পর্যন্ত টিকতে পারে, ব্যাপারটা তা-ও নয়। এ মুহূর্তে সাভার ও দিনাজপুর—বিকেএসপির এই দুই শাখায় ছেলেমেয়ে মিলিয়ে হকি প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা ১৩৫। ঢাকায় ছেলের সংখ্যা ৬৬, মেয়ে ৩৪। দিনাজপুরে ছাত্রছাত্রী মিলিয়ে ৩৫। হকির মতো একটি খেলায় এ সংখ্যা খুব বেশি নয়।
পুরান ঢাকার আরমানিটোলো স্কুল থেকে উঠে আসা দেশের হকির অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার রফিকুল ইসলাম কামাল দেশের হকিতে বিকেএসপির প্রভাবকে নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চান না। তবে তাঁর শঙ্কা, বিকেএসপি ছাড়া হকি খেলোয়াড়ের জোগান দ্রুত কমছে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হকি ফেডারেশন ও ক্লাবগুলোর ভূমিকাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন তিনি, ‘বিকেএসপি তো ভালো কাজ করছে। তারা অন্তত হকি খেলাটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বিকেএসপির বাইরে থেকে খেলোয়াড়ের জোগান ঠিক রাখতে কয়েকটি ফেডারেশনকে প্রতিভা অন্বেষণ করতে হবে। ক্রিকেট, ফুটবলের মতো একাডেমি করতে হবে। হকির ক্লাবগুলো হাত–পা গুটিয়ে বসে থাকে। তারা তো প্রতিভা অন্বেষণ করতে পারে, নিজেদের বয়সভিত্তিক দল তৈরি করতে পারে।’
আরমানিটোলা স্কুলের হকি প্রশিক্ষক ফজলুর রহমানের হাত ধরে বেরিয়েছে বহু হকি খেলোয়াড়। এখনো তিনি খেলোয়াড় তৈরির কাজটা চালিয়ে যাচ্ছেন। ফজলুর রহমান স্বীকার করেছেন, আগের চেয়ে হকির প্রতি আগ্রহ ছেলেমেয়েদের কম। তারা হয়তো সময় কাটাতে হকির প্রশিক্ষণে ভর্তি হচ্ছে কিন্তু খেলাটা নিয়ে তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নেই বললেই চলে, ‘হকি লিগ নিয়মিত হয় না। সেটি হলে অনেক খেলোয়াড়কে ক্লাব টেনে নেয়। গত তিন বছর লিগ হয়নি। তবে আরমানিটোলা স্কুল বা পুরান ঢাকায় হকির চর্চা কম হলেও আছে। কেউ কেউ বিকেএসপিতে যায়। ফেডারেশন বা ক্লাবগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে খেলোয়াড় তৈরি করার জন্য।’
জাতীয় দলের সাবেক খেলোয়াড় আশিকুজ্জামানও একই কথা বললেন। যশোর থেকে উঠে এসে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই খেলোয়াড় বলেন, ‘ক্লাবগুলোর কাজ শুধু টাকা খরচ করে দল করা, তারা খেলোয়াড় তৈরি করছে না। হকি ফেডারেশেনর কোনো উদ্যোগ দেখি না। লিগ হয় তিন বছর পরপর। এমন হলে কেউই আগ্রহী হবে না হকিতে। বিকেএসপি তো অন্তত খেলাটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু এভাবে বেশি দিন চলবে না। হকি কার্যক্রম ঠিক না হলে জোর করেও একটা সময় কাউকে হকিতে আগ্রহী করা যাবে না।’