মাইকেল ফেলপসের মতো? যাহ, সে আবার হয় নাকি! একজন মানুষ, হ্যাঁ মানুষই। পাঁচটি অলিম্পিকে অংশ নিয়ে ২৮টি পদক জিতেছেন, যার ২৩টিই সোনা। অলিম্পিক ইতিহাসে পদক জয়ে কিংবা সোনা জয়ে ফেলপসই শেষ কথা। কেউ কেউ বলেন, মাইকেল ফেলপস একজনই।
কিন্তু লিঁও মারশাঁকে তবু মাইকেল ফেলপসের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। বিশেষ করে কাল রাতে ২০০ মিটার ব্যক্তিগত মেডলিতে মারশাঁ সোনা জয়ের পর তুলনাটা আরও বেশি করে ডালপালা মেলেছে। কী দারুণ একটি সপ্তাহ-ই না গেল মারশাঁর! ছেলেদের ৪০০ মিটার ব্যক্তিগত মেডলি, ২০০ মিটার বাটারফ্লাই, ২০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোক ও ২০০ মিটার ব্যক্তিগত মেডলিতে জিতেছেন সোনা। চারে চার! মারশাঁর ভাষায় যা ‘পারফেক্ট সপ্তাহ’। আরেকটু শুনতে পারেন তাঁর মুখেই, ‘মনে হয় না এ সপ্তাহে কোনো ভুল করেছি। একদম নিখুঁত।’
মারশাঁ কী করেছেন, তবু যেন ঠিক বোঝানো গেল না। চারটি ইভেন্টের সব কটিতেই গড়েছেন নতুন অলিম্পিক রেকর্ড। এর মধ্যে অলিম্পিকের বাটারফ্লাই ও ব্রেস্টস্ট্রোক—দুই ইভেন্টেই মারশাঁর আগে কেউ পদক জেতেনি। বলা হচ্ছে, এ দুটি ইভেন্ট জিতে মারশাঁ নিজের জাত চিনিয়ে দিয়েছেন। পরশু যা করলেন, তাতে ফিরে এলেন ফেলপসও। ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে ফেলপসের পর প্রথম পুরুষ সাঁতারু হিসেবে এক গেমসেই চারটি ব্যক্তিগত সোনা জিতলেন মারশাঁ।
২০০ মিটার ব্যক্তিগত মেডলিতে তাঁর টাইমিং দেখুন—১ মিনিট ৫৪.০৬ সেকেন্ড। ইতিহাসে দ্বিতীয় সেরা দ্রুততম টাইমিং। শুধু কী তা–ই, এ ইভেন্টে নতুন যে অলিম্পিক রেকর্ড গড়লেন, সেটাও ফেলপসকে পেছনে ফেলে। ১৬ বছর আগের সেই বেইজিং গেমসে ফেলপসের ১ মিনিট ৫৪.২৩ সেকেন্ডের রেকর্ড ভেঙেছেন মারশাঁ। এবার বলুন তো, যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম যে তাঁকে ‘ফ্রেঞ্চ ফেলপস’ নাম দিয়েছে, সেটা কি খুব বেশি বাড়াবাড়ি? আর ফেলপসের সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র তো শুধু এসব সংখ্যা আর ইতিহাস নয়, আরও আছে। সেই গল্পই শুনুন এবার—
মারশাঁ আন্তর্জাতিক খ্যাতি কুড়ানোর আগে সাঁতার অনুশীলন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। কোচ? কে আবার, ফেলপসেরই কোচ বব বোম্যান। তিনি টেক্সাস সাঁতারের ডিরেক্টর হওয়ার পর মারশাঁও তাঁর সঙ্গে চলে যান অস্টিনে। ন্যাশনাল কলেজিয়েট অ্যাথলেটিকস অ্যাসোসিয়েশনে (এনসিএএ) সান ডেভিলসে দলীয় শিরোপা জেতানোর পর মারশাঁ নামেন সাঁতারের পেশাদার জগতে।
টেক্সাসে যাওয়ার আগে মারশাঁ থাকতেন অ্যারিজোনা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মোনা প্লামার অ্যাকুয়াটিক সেন্টারে। সান ডেভিলস অ্যারিজোনা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়েরই দল।
বোম্যানের সঙ্গে মারশাঁর যোগাযোগের ঘটনাও বেশ মজার। তিন বছর আগে বোম্যানকে একটি মেইল করেছিলেন মারশাঁ। স্কলারশিপ নিয়ে তিনি বোম্যানের সাঁতার দলে যোগ দিতে পারবেন কি না, সেটা ছিল মেইলের বিষয়বস্তু। এই মেইল পাঠানোর ঘটনা পরে বেশ আলোচিতও হয়। তবে মারশাঁ কীভাবে বোম্যানের শিষ্য হলেন, সেই ঘটনা খুব একটা প্রকাশ পায়নি। ‘দ্য অ্যারিজোনা রিপাবলিক’ জানিয়েছে, মেইলটি কে পাঠিয়েছেন, সেটা দেখতে গিয়ে বোম্যান দেখেন, প্রেরকের নামের শেষ অংশে লেখা ‘মারশাঁ’। ব্যস, এই নাম ও তাঁর টাইমিং দেখে বোম্যান আর দেরি করেননি। ডেকে পাঠান মারশাঁকে।
প্রশ্ন হলো, ‘মারশাঁ’ নাম দেখে বোম্যানের কি কিছু মনে পড়েছিল? নইলে ফেলপসের সঙ্গে অলিম্পিক সাঁতারের ইতিহাসে সেরা জুটি বাঁধা এই কোচ হুট করে এই নাম দেখে তাঁকে ডেকে পাঠাবেন কেন?
উত্তরে আরেকটি গল্প। যেটা আপনার জানাও থাকতে পারে। ২০০২ সালে ফ্রান্সের তুলুজে জন্ম নেওয়া মারশাঁর বাবাও সাঁতারু-জাভিয়ের মারশাঁ। সাঁতারু তাঁর মা সেলিন বোনেটও। ছেলের মতো জাভিয়েরও নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের এনসিএএ প্রতিযোগিতায় অবার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে অংশ নিয়েছেন। অলিম্পিকেও অংশ নিয়েছেন দুবার। তিনি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে রুপাজয়ী। মা সেলিন অংশ নিয়েছেন ১৯৯২ বার্সেলোনা অলিম্পিকে। সাঁতারে ফ্রেঞ্চ রেকর্ডও ছিল তাঁর দখলে।
মারশাঁর ফেলপস-সংযোগের শুরু আসলে তাঁর জন্মের আগেই। সেটি তাঁর বাবার মাধ্যমে। ঘটনাটা জানিয়েছিল ওয়াশিংটন পোস্ট। ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিকে খেলার যোগ্যতা অর্জনে মৌসুমের শুরুর দিকে অবার্ন মিটে অংশ নিয়েছিলেন জাভিয়ের। আর সেই মিটে ছিলেন ১৮ বছর বয়সী ফেলপসও। মার্কিন ‘জলদানব’ তখনও ‘দানো’ হয়ে ওঠেননি। আসি আসি করছেন। সেই মিটে ৯ সেকেন্ডের ব্যবধানে মারশাঁকে পেছনে ফেলেছিলেন ফেলপস। আর তখন ফেলপসের কোচ ছিলেন এই বোম্যান। বাকিটা তো আপনার জানাই। ফেলপস-বোম্যান মিলে তারপর গড়লেন সাঁতারের ইতিহাসে সেরা খেলোয়াড়-কোচ জুটি।
সেই ঘটনার ১৭ বছর পর বোম্যানকে মেইলটি পাঠিয়েছিলেন মারশাঁ। পরের ঘটনাগুলো তো জানাই। বোম্যানের স্পর্শে মারশাঁও এখন ফেলপস হয়ে ওঠার পথে। দুঃখিত, একটু ভুল হলো। ফেলপস কেউ চাইলেই হতে পারেন না, ফেলপসরা জন্মান। ২২ মারশাঁ তাই আপাতত ‘ফরাসি ফেলপস’।
কালের ঘড়ি আরও এগিয়ে যাওয়ার পর বলা যাবে, ফেলপস হতেই তাঁর জন্ম কি না!