পুরো নাম এ কে এম মমিনুল হক। এই নামে তাঁকে যতজন চিনবেন, তার চেয়ে অনেক বেশি চিনবেন ’ক্যাসিনো সাঈদ’ বললে। নামেই পরিচয় কথাটা এর চেয়ে যথার্থ আর হতে পারে না। মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় রীতিমতো ক্যাসিনো বসিয়ে জুয়ার যে মহোৎসব চলছিল, তার মূল হোতাদের একজন এই মমিনুল হক। ‘ক্যাসিনো সাঈদ’ নামের উৎপত্তিও সেখান থেকেই।
প্রায় সাড়ে তিন বছর আত্মগোপনে থাকার পর সেই ‘ক্যাসিনো সাঈদ’–এর পুনরাবির্ভাব ঘটেছে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে। সেটিও মহাসমারোহে। আবারও বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক পদে বরণ করে নেওয়া হয়েছে তাঁকে। সেটিও গত মঙ্গলবার ফেডারেশনের সভাপতি ও বিমানবাহিনীর প্রধানের উপস্থিতিতে হকি ফেডারেশনের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায়। সভা শেষে ফেডারেশন সভাপতি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, কমিটির সবাই মমিনুল হকের সাধারণ সম্পাদক পদে ফেরার পক্ষে মত দিয়েছেন। এই ফেরাটাকে ‘স্বাভাবিক প্রক্রিয়া’ বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।
স্বাভাবিক প্রক্রিয়া! কীভাবে? এটা সত্যি, মমিনুল হক হকি ফেডারেশনের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। ফেডারেশনের যে নির্বাচিত কমিটির মেয়াদ আছে আগামী এপ্রিল পর্যন্ত। সেই হিসাবে নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদকের তাঁর পদে ফেরাটাকে কেউ ‘স্বাভাবিক প্রক্রিয়া’ বলতেই পারেন। কিন্তু মাঝখানে ‘অস্বাভাবিক’ সব কাণ্ডকীর্তির সঙ্গে মমিনুল হকের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় তা আর স্বাভাবিক থাকছে কই! ২০১৯ সালের এপ্রিলে সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন মমিনুল। ক্যাসিনো–কেলেঙ্কারিতে তাঁর নাম আসার পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। আগস্টে তাঁকে হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর মমিনুলের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। যে মামলাগুলো এখন বিচার পর্যায়ে আছে। এমন একজনকে আবারও হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক পদে ফিরিয়ে আনাটা কীভাবে ‘স্বাভাবিক প্রক্রিয়া’ হয়? এর চেয়েও বড় প্রশ্ন, মমিনুলকে ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে কী বার্তা দেওয়া হলো? যে কারণে মমিনুল হককে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল, সেই কারণটা কি এখন উধাও হয়ে গেছে? মমিনুল হকের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ, সেসব তো আর মিথ্যা হয়ে যায়নি। মাঝের সময়টায় তিনি নিরপরাধ বলেও প্রমাণিত হননি। তাহলে? ঘটনাটা ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে এটা শুধু আইনি ব্যাপারেই সীমাবদ্ধ থাকে না, চলে আসে নীতি–নৈতিকতার প্রশ্নও। যে নীতি–নৈতিকতাই খেলাধুলার মূল চেতনা। মমিনুলের পুনর্বাসনের পর সেটির মূল্য থাকল কোথায়? হকি ফেডারেশনের সভায় এই প্রশ্নটা কেউই তুলেছেন বলে শোনা যায়নি। বরং আশ্চর্য হলেও সত্যি, অনেকেই মমিনুলের পক্ষে সাফাই গাইছেন।
মমিনুল হক নিজেকে ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে দাবি করেন। কাগজে–কলমে কথাটা সত্যিও। ক্যাসিনো–কাণ্ডের সময় তিনি ছিলেন আরামবাগ ক্রীড়াসংঘের সভাপতি। সভাপতি ছিলেন দিলকুশা ক্লাবেরও। মেরিনার ইয়াংস ক্লাবের হকি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন, মোহামেডান ক্লাবের স্থায়ী সদস্যও। এতগুলো ক্লাবের সঙ্গে জড়িত একজনকে দুঁদে ক্রীড়া সংগঠক বলে মনে হতেই পারে। অথচ ঘটনা হলো, ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে মমিনুলের আগে তেমন কোনো পরিচিতি ছিল না। দেদার টাকা ছড়িয়ে হঠাৎই তিনি ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে আবির্ভূত হন। হকি ফেডারেশনের নির্বাচনে আবদুস সাদেকের মতো কিংবদন্তিকে হারিয়ে দেওয়াতেও মমিনুলের টাকাপয়সা বিলানোর বড় ভূমিকা ছিল, এটা মোটামুটি ‘ওপেন সিক্রেট’।
মেরিনার ইয়াংস ক্লাবের প্রথমবারের মতো প্রিমিয়ার হকি লিগে চ্যাম্পিয়ন হওয়াতেও মমিনুলের দুহাতে টাকা ওড়ানোর বড় ভূমিকা। হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে যে কয়েক মাস কাজ করেছেন, তখনো ‘দানবীর’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। নিজের পকেটের টাকা দিয়েও নাকি ক্লাবগুলোকে অনুদান দিয়েছেন। এসবই ভালো কাজ হিসেবে বিবেচিত হতো, যদি এই টাকার উৎস নিয়েই প্রশ্ন না থাকত। এটা তো মোটামুটি প্রমাণিতই যে, মমিনুলের ‘পকেটের টাকা’ মানে ক্যাসিনোর টাকা। ক্লাবগুলোর পৃষ্ঠপোষক দরকার, কোনো ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকের টাকাপয়সা খরচ করার ক্ষমতা থাকাটাও সেই খেলার জন্য ভালো—কিন্তু সেই টাকা যদি অবৈধ পথে আসে, তখন তো খেলার মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গেই তা সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায়। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে এটা তো বলাই যায়, মমিনুলের কথিত ক্রীড়ানুরাগ আসলে একটা ছদ্মবেশমাত্র। ক্লাবগুলোর সঙ্গে তা জড়িত হওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল ক্যাসিনোর আসর বসিয়ে টাকা কামাই করা।
সেই ‘ক্যাসিনো সাঈদ’–এর আবার একটা জাতীয় ক্রীড়া ফেডারেশনের গুরুত্বপূর্ণ পদে ফিরে আসা থেকে আমরা টাকার মহিমা বুঝতে পারি। হয়তো রাজনৈতিক পরিচয়েরও। নিন্দা জানানো ছাড়া আমাদের আর কীই–বা করার আছে!