বাবা–মায়ের পথে হেঁটে সোনা–রুপা পাচ্ছে সন্তানেরা

টেবিল টেনিস দম্পতি মোহাম্মদ আলী ও সোনম সুলতারা ছেলে আবু সুফিয়ান (মাঝে) প্রথমবার যুব গেমসে ব্রোঞ্জ জিতেছে।ছবি: সংগৃহীত

মেয়ে ভারোত্তোলক হবে, তা কখনো চাননি শাহরিয়া সুলতানা।

শাহরিয়া নিজে একসময় জাতীয় দলে খেলেছেন। ১৪ বছরের ক্যারিয়ারে জাতীয় প্রতিযোগিতায় সোনা জিতেছেন ১৩ বার। বর্তমানে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোচ শাহরিয়া এশিয়ান ভারোত্তোলন ফেডারেশনের কোচিং অ্যান্ড রিসার্চ কমিটির সেক্রেটারি। কাজ করছেন বিশ্ব ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপের টেকনিক্যাল অফিসার হিসেবে। না চাইলেও মেয়ে হেঁটেছে তাঁর পথেই। এবার শেখ কামাল দ্বিতীয় বাংলাদেশ যুব গেমসের ভারোত্তোলনে রেকর্ড গড়ে সোনা জিতেছে শাহরিয়ার মেয়ে শাম্মী সুলতানা। খুলনা বিভাগের এই ভারোত্তোলক সোনা জিতেছে ৫৫ কেজি ওজন শ্রেণিতে।

শুধু শাম্মী নয়, এবারের যুব গেমসে অনেকে পদকমঞ্চে উঠেছে, যাদের বাবা-মায়েরা একসময় খেলোয়াড় ছিলেন। তাঁদের অনেকে বর্তমানে কোচ হিসেবে কাজ করছেন বিভিন্ন খেলায়। তেমনই এক ঘর থেকে উঠে আসা ফরহাদ হাসান অ্যাথলেটিকসের শটপুট ইভেন্টে জিতেছে রুপা।

আরও পড়ুন

খুলনা বিভাগের অ্যাথলেট ফরহাদের বাবা ফারুক হোসেন জাতীয় কাবাডি দলের সাবেক খেলোয়াড়। ২০০৬ কলম্বো এসএ গেমস, ২০০৭ সালে ভারতে ইন্দো-বাংলাদেশ গেমস ও ২০১০ গুয়াংজু এশিয়ান গেমসে কাবাডি দলে খেলেছেন ফারুক।

জাতীয় কাবাডি দলের সাবেক খেলোয়াড় ফারুক হোসেনের ছেলে ফরহাদ শটপুটে পদক জিতেছেন
ছবি: সংগৃহীত

অ্যাথলেটিকসেও একসময় নিয়মিত শটপুটে অংশ নিতেন। বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশের কর্মকর্তা ফারুক সংস্থাটির অ্যাথলেটিকস দলের কোচ হিসেবে আছেন। খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ারে কাবাডি ছাড়াও আন্তপুলিশ অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় শটপুট, ডিসকাস থ্রো ও ১০০ মিটারে সোনা জিতেছেন। বাবার দেখানো পথে হাঁটতে পেরে খুশি ঝিনাইদহের শৈলকুপার অ্যাথলেট ফরহাদ, ‘বাবা চান আমি যেন বড় হয়ে পুলিশ অফিসার হই। পাশাপাশি খেলাধুলা করতেও উৎসাহ দেন।’

অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে ঢাকায় চূড়ান্ত পর্বে খেলার সুযোগ পেয়েছে ফরহাদ। ঝিনাইদহ জেলা ক্রীড়া সংস্থায় অ্যাথলেটিকসের অনুশীলন সরঞ্জাম নেই বললেই চলে। বনানী আর্মি স্টেডিয়ামে দাঁড়িয়ে আক্ষেপ করে ফরহাদ বলছিল, ‘আমরা অনুশীলনের জন্য জেলা থেকে কোনো সুযোগ–সুবিধা বা অ্যাথলেটিকস সরঞ্জাম পাই না। আমার বাবা যেগুলো কিনে দিয়েছেন, তা নিয়ে এলাকার মাঠে একা একা অনুশীলন করি। একজন ভালো মানের কোচের অধীনে অনুশীলন করলে আরও ভালো পারফরম্যান্স হতো আমার।’

আরও পড়ুন

আর্চারির মাহমুদুল আলমের গল্প একটু অন্য রকম। বাবা নূর আলম জাতীয় দলের সাবেক আর্চার। বর্তমানে বিকেএসপির কোচ নূর আলম চাইলেও ছেলেকে নিজের অধীনে অনুশীলন করাতে পারেন না। তবু বিকেএসপি থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে মাঝেমধ্যে অনুশীলন করান ছেলেকে। মাহমুদুলের জন্য সাড়ে তিন হাজার ডলার দিয়ে কিনেছেন উন্নত মানের আধুনিক ধনুক। যুব গেমসে সে ধনুকেই এসেছে ছেলেদের রিকার্ভে রুপা।  

জাতীয় দলের সাবেক আর্চার নূর আলমের সঙ্গে ছেলে মাহমুদুল আলম
ছবি: সংগৃহীত

ছেলেকে নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখেন নূর আলম, ‘ওর সবচেয়ে বড় সমস্যা নিয়মিত অনুশীলন করতে পারে না। আমি ওকে বিকেএসপিতে ভর্তি করালে অনেকে বলত স্বজনপ্রীতি করিয়েছি। আমি চাই, সে নিজের যোগ্যতায় খেলুক জাতীয় দলে।’
করোনাভাইরাস মহামারির সময় বিকেএসপিতে তিন মাস নিজের কাছে রেখে অনুশীলন করিয়েছিলেন ছেলেকে। তখন বিকেএসপির কোরিয়ান আর্চারি কোচ লি ইয়ং হো বলেছিলেন, ‘এই ছেলের মধ্যে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। নিয়মিত অনুশীলন করলে একসময় অলিম্পিকে খেলার সুযোগ পাবে।’

সাভার ইপিজেডের বেপজা পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র মাহমুদুল জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন দেখে, ‘গত বছর জুনিয়র আর্চারি প্রতিযোগিতায় অংশ নিলেও কিছু পাইনি আমি। এবার রুপা জেতায় আত্মবিশ্বাস বেড়েছে অনেক। আমি রোমান ভাইয়ার (রোমান সানা) মতো জাতীয় দলে খেলতে চাই।’

আরও পড়ুন

ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনের কোচ তারেক মাহমুদের মেয়ে তানজিলা মাহমুদ প্রথমবার অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ যুব গেমসে। মাতুয়াইল হাজী মনির হোসেন উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির এই ছাত্রী নজরে পড়েছেন প্রথমবারেই। ঢাকা বিভাগের হয়ে খেলে মিশ্র দ্বৈতে শেখ সাগরের সঙ্গে জুটি গড়ে জিতেছে রুপা। এ ছাড়া মেয়েদের এককে জিতেছে ব্রোঞ্জ, মেয়েদের দ্বৈতে ব্রোঞ্জ জিতেছে মিম আক্তারের সঙ্গে জুটি গড়ে।

ব্যাডমিন্টন ফেডারেশনের কোচ তারেক মাহমুদের সঙ্গে মেয়ে তানজিলা মাহমুদ
ছবি: সংগৃহীত

শেখ রাসেল জাতীয় স্কুল টুর্নামেন্টে দ্বৈতে চ্যাম্পিয়ন তানজিলা খেলেছে গত ডিসেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ইয়োনেক্স সানরাইজে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায়। বাবা কোচ হলেও নিয়মিত অনুশীলন করার সুযোগ মেলে না তানজিলার। দুঃখ করে তানজিলা বলছিল, ‘আমার এলাকায় অনুশীলনের ইনডোর বা মাঠ কিছুই নেই। পল্টন উডেনফ্লোরে সব সময় অনুমতি পাই না। অনেক সময় অন্ধকারে অনুশীলন করি। পাশের টেবিল টেনিস কোর্টে অল্প আলো জ্বলে। সেটা দিয়ে অনুশীলন করি।’

মেয়ের মধ্যে অপার সম্ভাবনা দেখেন বাবা, ‘বাবা হিসেবে নয়, কোচ হিসেবে বলব আমার মেয়ের মধ্যে অনেক সম্ভাবনা। ওকে নিয়মিত অনুশীলন করাতে পারলে অনেক দূরে সে যাবে।’

আরও পড়ুন

টেবিল টেনিস দম্পতি মোহাম্মদ আলী ও সোনাম সুলতানার ছেলে আবু সুফিয়ান প্রথমবার অংশ নিয়েছে এবারের যুব গেমসে। আলী বর্তমানে ফেডারেশনের কোচ। সোনাম জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। এই দম্পতির বড় ছেলে আবু সুফিয়ান টেবিল টেনিসে ঢাকা বিভাগের হয়ে জিতেছে দলগত ব্রোঞ্জ।

আরও পড়ুন

বিসিএসআইআর স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র সুফিয়ান এর আগে পল্লীমা সংসদ আন্তস্কুল টেবিল টেনিসে হয়েছে এককে চ্যাম্পিয়ন। ছেলের যুব গেমসের পারফরম্যান্সে খুশি মোহাম্মদ আলী, ‘আমার বাসায় রোবটের সঙ্গে সে নিয়মিত অনুশীলন করে। কখনো মায়ের সঙ্গে, কখনো এলাকার ট্রেনিং পার্টনারদের সঙ্গে অনুশীলন চলে। যুব গেমসে পদক জেতায় ওর মধ্যে খেলার আগ্রহ আরও বেড়েছে। একা একাই সে চলে এসেছে পল্টনের উডেনফ্লোরে। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে এমনিতেই খেলাধুলায় আগ্রহ কম। এদিক দিয়ে সে ব্যতিক্রমই।’