পুলে নামছেন আর সোনা জিতছেন। সোনিয়া আক্তারের প্রিয় কাজ যেন এটাই। মিরপুর জাতীয় সাঁতার কমপ্লেক্সে চলমান ম্যাক্স গ্রুপ ৩৩তম জাতীয় সাঁতারের প্রথম দুই দিনে ব্যক্তিগত চারটি ইভেন্টে অংশ নিয়ে চারটিতেই সোনা জিতেছেন সোনিয়া।
শনিবার প্রথম দিনে জিতেছেন রিলেসহ তিনটি সোনা। রোববার দ্বিতীয় দিনে সোনা জেতেন ২০০ মিটার আইএম ও ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইলে। ৫টি ইভেন্টে অংশ নিয়ে ৫টিতেই সোনা। এবার তিনি ইভেন্ট করবেন ১২টি। সোনিয়ার আশা, সব কটিতেই সোনা জিতবেন।
বাংলাদেশ নারী সাঁতারুদের মধ্যে এখন সবচেয়ে সিনিয়র সোনিয়া আক্তার, সাঁতার অঙ্গনে অনেকেই যাঁকে চেনেন টুম্পা নামে। বয়স ৩০ পেরিয়েছে কিছুদিন আগে। কিন্তু এখনো তিনি সাঁতারে নারী বিভাগে আলো কাড়ছেন। পেছনে ফেলছেন প্রতিদ্বন্দ্বীদের।
জাতীয় সাঁতারে সিনিয়র বিভাগে খেলা শুরু ২০০৭ সালে। তবে মিরপুর সাঁতার কমপ্লেক্সে আসছেন তারও আগে থেকে, ২০০৩ সালে। জাতীয় বয়সভিত্তিক সাঁতারে প্রথম অংশ নেন সেবার। ২১ বছর হয়ে গেছে তাঁর সাঁতার জীবনের। দীর্ঘ এই সময়ে জাতীয় সাঁতারে সোনিয়ার সোনার সংখ্যা ১০০ পেরিয়েছে। কীভাবে তা সম্ভব হলো?
আমাদের দুজনের ইচ্ছা ছিল একসঙ্গে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে খেলতে যাব। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। দুজনই জাতীয় প্রতিযোগিতায় দ্রুততম সাঁতারু হয়েছি। এটা দুজনের জন্যই একট বড় সাফল্য।আসিফ রেজা, সাঁতারু
মিরপুর সাঁতার পুলে দাঁড়িয়ে ঝিনাইদহের ভুটিয়ারগাতির মেয়ে বললেন, ‘সাঁতারকে অনেক ভালোবাসি। এ কারণে খেলাটা এখনো ছাড়তে পারিনি। ছোটবেলায় বিকেএসপিতে ভর্তি হয়েছিলাম, সেখান থেকে বের হই ২০১০ সালে। এরপর তিন বছর ছিলাম বাংলাদেশ আনসারে। ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশ নৌবাহনীতে আছি। আর নৌবাহিনীতে সব সুযোগ–সুবিধা পাই। সেটাই আমাকে এগিয়ে এনেছে এত দূর।’
সোনিয়ার স্বামী আসিফ রেজাও সাঁতারু। তাঁরা বিয়ে করেন ২০২১ সালে। কুষ্টিয়ার মিরপুরের ছেলে আসিফ একসময় জাতীয় সাঁতারে বেশ কিছু সোনা জিতেছেন। এবারের জাতীয় সাঁতারের প্রথম দুই দিনে আসিফ ব্যক্তিগত ইভেন্টে অংশ নেন একটিতে, সেই ইভেন্টে পেয়েছেন ব্রোঞ্জ। তবে রিলেতে সোনা জিতেছেন নৌবাহিনীর হয়ে।
দুজনই বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সাঁতারু হওয়ার ব্যক্তিজীবনে দুজনের জন্যই সুবিধা হয়েছে। সোনিয়া তা নিয়ে বলছিলেন, ‘আমরা দুজন একই সংস্থায় খেলছি বলে অনেক সুবিধা হয়। অনুশীলনে একজন আরেকজনকে সহায়তা করতে পারি। আসিফ আমার ভুলগুলো ধরিয়ে শুধরে দিতে পারে। আমিও ওর ভুলগুলো ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি। ফলে একজন আরেকজনের পাশে থাকতে পারি।’
স্বামী-স্ত্রীর সাঁতারজীবন চলছে ভালোই। সোনিয়ার কথায় মনে হলো জীবন নিয়ে খুশিই আছেন, ‘আমাদের সংসারজীবন ভালোই কাটছে। দুজন একসঙ্গে থাকায় সবকিছু ভালোভাবে করা যায়। খেলাটা এত দিনেও ধরে রাখতে পেরেছি।’
আসিফের মামা বাংলাদেশের সাঁতারে তৃণমূলের অন্যতম সেরা কোচ আমিরুল ইসলাম, যিনি বাংলাদেশ সাঁতার ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদকও। ভাগনেকে সাঁতারে তুলে এনেছেন নিজ হাতে। আস্তে আস্তে বড় করেছেন। তারপর সোনিয়ার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন।
পেছন ফিরে আমিরুল বলছিলেন, ‘আসিফ আমার বোনের ছেলে। সাতাঁরু হিসেবে আমি ওকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম। সেটা পেরেছি বলে আজ তৃপ্ত আমি।’
আসিফও তৃপ্ত তাঁর সাঁতারজীবন নিয়ে। জাতীয় প্রতিযোগিতায় ২৫ থেকে ৩০টি সোনা জিতেছেন। সোনিয়ার সঙ্গে ঘর বেঁধে ঢাকা ক্যান্টমেন্টের পাশে ভাসানটেকে বাসা ভাড়া নিয়েছেন বছর দুয়েক আগে।
দুজনের পরিচয় বিকেএসপিতে। সেখানে শিক্ষার্থী ছিলেন তাঁরা। ২০০৫-২০১৩ পর্যন্ত বিকেএসপিতে ছিলেন আসিফ রেজা। ২০১৩ সাল থেকে নৌবাহনীতে। ‘আমাদের প্রথম দেখা ২০০৪ সালে, বগুড়ায় বয়সভিত্তিক সাঁতার প্রতিযোগিতায়। তারপর দুজনের বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়া। দুজনের মধ্যে ভালো লাগা, ভালোবাসা। সেখান থেকেই পারিবারিকভাবে বিয়ে’—বলছিলেন আসিফ।
বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি সাঁতারু দম্পতি আছে। তার মধ্যে শাহজাহান আলী রনি-মাহফুজা খাতুন শীলা জুটির পরিচিতি সবচেয়ে বেশি। দুজনই দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে সোনাজয়ী। আছে শরিফ-সবুরা, কামাল-জুঁই দম্পতি। তবে সক্রিয়ভাবে খেলছেন—এমন জুটির মধ্যে আসিফ-সোনিয়ার কথাই আগে আসে।
স্ত্রী সোনিয়ার সাফল্যে গর্বিত আসিফ বলেন, ‘আমাদের দুজনের ইচ্ছা ছিল একসঙ্গে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে খেলতে যাব। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে ২০২২ সালে। অস্ট্রেলিয়ায় আমরা খেলতে যাই। দুজনই জাতীয় প্রতিযোগিতায় দ্রুততম সাঁতারু হয়েছি। এটা দুজনের জন্যই একট বড় সাফল্য।’
এ সাফল্যের ধারা ধরে রাখতে চান দুজনই। এগিয়ে যেতে চান আরও অনেকটা পথ।