ছেলেকে অলিম্পিক গেমসে পৌঁছে দিতে এক চা বিক্রেতা মায়ের সংগ্রাম

নিজের চায়ের দোকানে আর্চার সাগর ইসলামের মাশহীদুল ইসলাম

নাম তাঁর সেলিনা। নামের আগে বা পরে আর কিছু নেই। মাঝবয়সী এই নারী থাকেন রাজশাহী শহরে। তাঁর চার সন্তান। স্বামী স্ট্রোক করে মারা গেছেন ১৫ বছর আগে। সেই থেকে রাজশাহী শহরে চা বিক্রি করে কোনোমতে সংসার চালাচ্ছেন। সন্তানদের জন্য নিজেকে নিংড়ে দিয়েছেন, দিচ্ছেন।

অনেকটাই সার্থক তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম। চার সন্তানের ছোটজন সাগর ইসলাম উজ্জ্বল করেছেন মায়ের মুখ। সাগরই এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের একমাত্র ক্রীড়াবিদ, যিনি আগামী ২৬ জুলাই শুরু হতে যাওয়া প্যারিস অলিম্পিকে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছেন।

বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন ছয়জন ক্রীড়াবিদের জন্য ওয়াইল্ড কার্ড চেয়েছে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির কাছে। কিন্তু এখনো কোনো উত্তর আসেনি। তার আগেই সাগর ইসলাম নিশ্চিত করেছেন অলিম্পিকের টিকিট। সেটি পেয়েছেন ১৭ জুন তুরস্কের আন্তালিয়ায় ‘২০২৪ ফাইনাল ওয়ার্ল্ড কোটা টুর্নামেন্ট’-এ ছেলেদের রিকার্ভ এককে ভালো করে।

এটিই ছিল প্যারিস অলিম্পিকের আগে আর্চারিতে ছেলেদের রিকার্ভ ইভেন্টে সরাসরি যোগ্যতা অর্জনের শেষ সুযোগ। সেমিফাইনালে উঠেই অলিম্পিকে খেলা নিশ্চিত করেন সাগর। এখানেই না থেমে ইভেন্টটির ফাইনালেও ওঠেন তিনি। শেষ পর্যন্ত জিতেছেন রুপা। যা তাঁর জন্য বিশাল এক অর্জনই।

দোকানে কাজে ব্যস্ত সেলিনা
শহীদুল ইসলাম

বাংলাদেশ থেকে এর আগে গলফার সিদ্দিকুর রহমান ও আর্চার রোমান সানা অলিম্পিক গেমসে সরাসরি খেলেছিলেন। সাগর সেই ছোট্ট তালিকায় নতুন সংযোজন। যাঁকে গড়ে তুলতে বিকেএসপি, বাংলাদেশ আর্চারি ফেডারেশনের পাশাপাশি বাংলাদেশের আর্চারির পৃষ্ঠপোষক সিটি গ্রুপকেও ধন্যবাদ দেন সাগরের মা সেলিনা।

তাঁর আনন্দের শেষ নেই এখন। রাজশাহী থেকে ফোনের ও প্রান্তে তাঁর গলায় ধরা পড়ে উচ্ছ্বাস, ‘সাগরের সাফল্যে খুব আনন্দ লাগছে। আল্লাহ আমার ছেলেকে এত দূর পৌঁছে দিয়েছেন। দোয়া করি সে যেন আরও বড় হয়। ভাবতে ভালো লাগছে যে সারা বিশ্ব এখন আমার সন্তানকে দেখবে। এর চেয়ে ভালো লাগার আর কিছু নেই। মা হিসেবে এর বেশি আর কী চাইতে পারতাম!’

সাগরের বাবা শাহ আলম টেম্পো মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতেন। ৪৫-৪৬ বছর বয়সে মারা যান। সালটা ২০০৯। সেই থেকে সংগ্রাম শুরু রাজশাহী শহরে ছোট বনগ্রামের বাসিন্দা সেলিনার। নিজেই বলতে থাকেন, ‘সাগরের বাবার মৃত্যুর পর রাস্তার পাশে ফুটপাতে চায়ের দোকান দিই। ভোর পাঁচটায় উঠে যেতাম, রাত ১১টায় ফিরতাম। রাস্তার পাশে এখনো আমি সেই চায়ের দোকানই করি। আগে ওপরে পলিথিন টানিয়ে করতাম। এখন ওপরে টিন দিয়ে আর চারপাশে বেড়া দিয়ে করছি। এটা রাজশাহী বঙ্গবন্ধু কলেজ মোড়ে। মাঝে মাঝে বড় ছেলে এসে দোকানে বসে। সহযোগিতা করে।’

দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। বড় মেয়ের স্বামী বিয়ে পাস, কোনো চাকরি পাননি। ছোট মেয়ের স্বামী ঢাকায় এক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে মাস্টাররোলে। বড় ছেলে অনার্স পর্যন্ত পড়ে কোনো চাকরি পাননি। তিনি এখন আলু আর পুকুরে মাছের ব্যবসা করেন। ছোট মেয়েটা অনার্স পড়ছেন। কষ্ট করে আসতে হয়েছে সেলিনাকে। নিজেই বলেন, ‘কষ্ট করে সংসার চালাইছি। সংসার চালাতে খুব কষ্ট। এটা যে করে, সে-ই শুধু জানে।’

কিন্তু দমে যাননি সেলিনা। মাতৃস্নেহের আবেগ সামলেছেন। পেছন ফিরে বলেন, ‘সাগর আমার ছোট ছেলে। ওকে ছেড়ে আমার থাকতে কষ্ট হয়। ঈদের মধ্যে আমার বাচ্চা বাড়ি আসতে পারে না। ঠিকভাবে খাওয়াতে পারিনি, পড়াতে পারিনি। স্কুলে গিয়ে বসে থাকতে না পারলে স্যাররা বলত, আপনার বাচ্চা নিয়ে যান। খুব ছোট থাকতে ওকে কোলে করে অনেক সময় দোকানে নিয়ে আসতাম। রাতের বেলা ঘুমিয়ে গেছে, কোলে করে তুলে নিয়ে আসছি দোকানে।’

ছোট থেকে সাগরের খেলার প্রতি খুব আগ্রহ। সৌভাগ্যক্রমে তাঁদের বাসার পাশে একটা আর্চারি ক্লাব ছিল। ‘ক্লাবের পরিচালকের কাছে গিয়ে বললাম, “বাবা আমার ছেলেটাকে নাও, খেলা শিখাও। ওরা নিল। ওখানে অনুশীলন করল। মাসে ৫০০ টাকা দিতে হতো। তারপর বিকেএসপিতে ভর্তি করি পাঁচ বছর হলো। এখন সে দেশ–বিদেশে খেলে। আমার খুব ভালো লাগছে ছেলের এগিয়ে যাওয়া দেখে,’ বলছিলেন গর্বিত মা সেলিনা।

আর্চার সাগর ইসলাম
আর্চারি ফেডারেশন

সেলিনার শরীর ভালো নেই। কিডনি, লিভারে সমস্যা। এ অবস্থায় সরকারের কাছে তাঁর কিছু চাওয়া আছে, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করি, আমার ছেলেকে যেন তিনি দেখেন। যে জায়গাটায় আমি কর্ম করে খাই, সেখানেই যেন খেতে পারি। দুদিন পরপর এসে অভিযানে দোকান ভেঙে দেয়। ঈদের পরদিন আজও খোলা আমার দোকান। আর আমার চাওয়া, ছেলে-মেয়েদের যদি একটা চাকরি হয়।’

বলতে বলতে কণ্ঠ ধরে আসে তাঁর। দুঃখের বর্ণনা শেষই হয় না, ‘আমার বাচ্চাদের মাথা গোঁজার জায়গা নাই। বাড়ি নাই, ঘর নাই। আমি যে জায়গায় থাকতাম, বছরে ১ হাজার ২০০ টাকা দিতাম। এখন একটা টিনের চালের বাসা ভাড়া নিয়েছি। বাসাভাড়া, বিদ্যুৎ বিলসহ সাড়ে চার হাজার টাকার মতো আসে।’ ১৫ বছর ধরে বিধবা হয়েও এখনো বিধবা ভাতা না পাওয়ার আক্ষেপ তাঁর, ‘আমি কোনো বিধবা ভাতা পাইনি। এই দুঃখ কাকে বলি।’

এই দুঃখের গল্পের মাঝেই কখনো কখনো সেলিনার চোখ ছলছল করে। সেলিনা নিজেকে সামলে নেন। ছেলের অর্জন তাঁর দুঃখটা ক্ষণিকের জন্য হলেও ভুলিয়ে দেয়। খুব সুখী লাগে তাঁকে। লাগারই কথা। বাংলাদেশে এত এত খেলোয়াড়, কই আর কেউ তো প্যারিস অলিম্পিকে সরাসরি টিকিট পেল না! এখানেই সাগর ইসলাম আলাদা। মাকে সুখী করে নিজেও সুখী। তাই তো দুঃখ আপাতত ছুটি নিয়েছে এই সংসার থেকে!