৪৮তম জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়নশিপের খেলা চলছিল পল্টনে দাবা ফেডারেশনে। ১৩ রাউন্ডের মধ্যে গতকাল শুক্রবার ছিল ১২তম রাউন্ডের খেলা। ১১ রাউন্ড পর্যন্ত এগিয়ে থাকা ১৪ বছরের কিশোর মনন রেজা কি পারবে প্রথমবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হতে? নাকি নাটকীয় মোড় নিয়ে গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাবেন? এসব প্রশ্ন মনে নিয়ে কাল বিকেলে ১২তম রাউন্ডের খেলা দেখতে গেলাম দাবা ফেডারেশনে।
বিকেল পাঁচটা বাজে তখন। ততক্ষণে মনন রেজা ১২তম রাউন্ডে ড্র করেছে গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদের সঙ্গে। আজ শনিবার শেষ রাউন্ডে জিতলেই মনন চ্যাম্পিয়ন। জিয়া তখনো ১২ রাউন্ডে লড়ছিলেন আরেক গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীবের সঙ্গে। পাশের ঘরেই জিয়ার স্ত্রী তাসমিন সুলতানা বসে আছেন, অপেক্ষা কখন খেলা শেষ হবে। সেখানে দাবার আন্তর্জাতিক বিচার হারুনুর রশিদ, আন্তর্জাতিক মাস্টার আবু ফাহাদ রহমানের বাবা, ক্রীড়া সাংবাদিক ঢাকা পোস্টের আরাফাত জোবায়ের আর আমি। নানা গল্প চলছিল।
আজ শনিবার মনন রেজা চ্যাম্পিয়ন হলে সে কি সর্বকনিষ্ঠ দাবাড়ু হিসেবে জাতীয় দাবার শিরোপা জিতবে? এসব নিয়ে আড্ডায় হারুনুর রশিদ জানান, ১৯৭৯ সালে নিয়াজ মোরশেদ মাত্র ১৩ বছর বয়সে প্রথম জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হন। জিয়া ১৯৮৮ সালে প্রথম চ্যাম্পিয়ন হন ১৪ বছর বয়সে। কাজেই ধরে নেওয়া হলো, মনন রেজা চ্যাম্পিয়ন হলেও সেটা রেকর্ড হবে না। এই ফাঁকে প্রশ্ন এল, কে বেশিবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন জাতীয় দাবায়। হারুনুর রশিদ জাতীয় দাবার রোল অব অনার বের করে বললেন, জিয়া সর্বোচ্চ ১৪ বার।
চায়ের কাপে আড্ডা যখন জমে উঠল, ঠিক তখনই দুই দাবাড়ু আন্তর্জাতিক মাস্টার আবু সুফিয়ান শাকিল ও ফিদে মাস্টার নাইম হক দরজা ধাক্কা দিয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘জিয়া ভাই ফ্লোরে পড়ে গেছেন।’ সঙ্গে সঙ্গে আমরাও ছুটে গেলাম দাবার কক্ষে। গিয়ে দেখা গেল, জিয়া মেঝেতে পড়ে আছেন অচেতন অবস্থায়। কেউ জিয়ার পা ধরে আছেন, কেউ মাথা। কেউ শরীরে একটু পানি ছিটানোর চেষ্টা করলেন।
মাঝে একবার চোখমুখ খিঁচিয়ে জিয়াকে জোরে শ্বাস নিতে দেখা গেল। ততক্ষণে জিয়ার স্ত্রী কান্নাকাটি শুরু করেছেন। পেশাদারত্বের মোড়ক পেরিয়ে উপস্থিত দুই ক্রীড়া সাংবাদিক তাঁকে সান্ত্বনা দিতে থাকলাম। কেউ একজন তাগিদ দিলেন দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স ডাকার। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে এবং আসতে সময় লাগবে। তাই তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত হলো, জিয়ার এদিনের প্রতিপক্ষ এনামুল হোসেন রাজীবের গাড়িতে করে দ্রুত কাছের কোনো হাসপাতালে নিতে হবে তাঁকে। দু–একটি হাসপাতালের নাম নিয়ে আলোচনা হলেও ত্বরিত সিদ্ধান্ত হয়, শাহবাগের ইব্রাহিম কার্ডিয়াকে নেওয়ার এবং সেটা করা হয় দ্রুতই। রাজীবের গাড়িতে মাত্র ৯ মিনিটের মধ্যে জিয়াকে নিয়ে আসা হয় ইব্রাহিম কার্ডিয়াকে।
আমরা দুই সাংবাদিকও দ্রুত চলে এলাম হাসপাতালে। এসেই দাবা–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মুখ দেখে খারাপ কিছু অনুমান করতে কষ্ট হলো না। তাঁরা বললেন, ‘জিয়া আর নেই।’ কী বলে, জিয়া আর নেই! কিছুটা বিস্ময় নিয়ে আরেকটু খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারা গেল, আসলেই নেই। চিকিৎসকেরা জিয়ার পালস (স্পন্দন) খুঁজে পাননি। অনেক চেষ্টা করেও। ফলে তাঁরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান যে জিয়া চলে গেছেন পরপারে। কিন্তু চিকিৎসকেরা আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানাননি তখনো।
জিয়ার স্ত্রী ততক্ষণে পাগলপ্রায়। এদিক–ওদিক ছুটছেন আর বিলাপ করছেন। জিয়া মারা যাননি, তিনি ঘুমিয়ে আছেন বলে ভেতরে ঢুকে গেলেন তাসমিন। কিন্তু ভেতরে গিয়ে স্বামীর নিথর দেহই দেখলেন। বেরিয়ে আসার পর তাঁকে সান্ত্বনা দিতে থাকেন স্বজনেরা। জিয়ার ছেলে ফিদে মাস্টার তাহসিন তাজওয়ার মাকে জড়িয়ে ধরে ছিলেন।
এক আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়। জিয়া বা তাঁর স্ত্রীর মা-বাবা কেউ বেঁচে নেই। দুই পরিবারের অন্য সদস্যরা এলেন হাসপাতালে। এক ফাঁকে কথা হলো জিয়ার বড় ভাইয়ের স্ত্রীর সঙ্গে। তিনিও কাঁদছেন। সতীর্থ দাবাড়ুরা কাঁদছেন। সবার চোখে পানি।
এনামুল হোসেন রাজীব স্তম্ভিত। কারণ, জিয়া তাঁর জীবনের শেষ কয়েকটা ঘণ্টা তাঁর সামনেই ছিলেন। এমনিতে দাবা মানসিক চাপের খেলা। সেই চাপ সবার মধ্যে সব সময়ই থাকে। চাল নিয়ে ভাবতে হয়। জিয়া মেঝেতে লুটিয়ে পড়ার আগে চাল ছিল রাজীবের। তিনি বলছিলেন, ‘আমি চাল নিয়ে ভাবছিলাম। হঠাৎ দেখি, জিয়া ভাই চেয়ারের এক পাশে কাত হয়ে আছেন; কিন্তু উঠছেন না। পরে পড়ে গেলেন। বিশ্বাসই হচ্ছে না সুস্থ মানুষটা এভাবে খেলতে খেলতে চোখের সামনে দিয়ে চলে যাবেন আমাদের ছেড়ে।’
হাসপাতাল চত্বরে সংবাদকর্মীদের ভিড় বাড়তে লাগল। ততক্ষণে জিয়ার মৃত্যুর খবর প্রচার হয়ে গেল সংবাদমাধ্যমে। যদিও জিয়ার স্ত্রী তখনো অন্য হাসপাতালে নেওয়ার অনুরোধ করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। পরিবার সিদ্ধান্ত না দেওয়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিক ঘোষণাও দিতে পারছিল না। অবশেষে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে জিয়ার মৃত্যুসনদে সই করলেন চিকিৎসকেরা। এরপর আর কারও কোনো সংশয় রইল না। প্রিয়জন হারানোর ব্যথায় কাতর হয়ে পড়লেন সবাই। শুরু হয়ে গেল মরদেহ মোহাম্মদপুরে জিয়ার বাসায় নেওয়ার কার্যক্রম। তাঁর কফিন হাসপাতাল চত্বরে যখন, গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ নির্বাক দাঁড়িয়ে। তিনিও কাঁদছেন।
জিয়া ছিলেন অমায়িক। কারও সাতে–পাঁচে থাকতেন না। জীবনটাকে বানিয়ে ফেলেছিলেন দাবাময়। বিদেশে খেলতে গেলে সঙ্গী হতেন স্ত্রী, ছেলেও। দাবা পরিবার হিসেবেই তাঁরা আলাদাভাবে নজর কাড়তেন। সেই পরিবারে নেমে এসেছে দুঃখ।
খেলোয়াড় হিসেবে জিয়ার সঙ্গে বহুবার কথা হয়েছে। সব সময়ই তাঁর আক্ষেপ ছিল, কেন দাবায় বাংলাদেশ একটা জায়গায় থমকে আছে। নানা অপ্রাপ্তির মধ্যেও জিয়াই ছিলেন বাংলাদেশের দাবার লড়াকু সৈনিক। নিজে প্রায় সব টুর্নামেন্টে খেলতেন, ফাঁকে ফাঁকে কোচিং করাতেন। সেই জিয়া কাল আকস্মিকভাবে চলে যাওয়ার দেশের দাবার স্থবিরতা আরও জেঁকে বসবে বলেই মনে হচ্ছে। তবে জিয়া চলে গেলেও দাবায় তাঁর অবদান–কীর্তি ক্রীড়াঙ্গন স্মরণ করবে বহুদিন।
জাতীয় দাবায় সর্বোচ্চবার শ্রেষ্ঠত্বের পাশাপাশি দাবা অলিম্পিয়াডেও জিয়াই বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশিবার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। পেয়েছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অসংখ্য পুরস্কার। পুরস্কারে ভরে গিয়েছিল তাঁর শোকেজ। ‘এত পুরস্কার কোথায় রাখব। আমার তো আরেকটি শোকেস বানাতে হবে’ মাঝেমধ্যে মজা করে বলতেন এমন কথাও।
দাবা অঙ্গনের অনেকেই বলতেন, ক্রীড়াবিদদের মধ্যে জিয়াই সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দেশে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এবারের জাতীয় দাবায় সেরা পাঁচে থেকে সেপ্টেম্বরেই হাঙ্গেরিতে বিশ্ব দাবা অলিম্পিয়াডে তাঁর যাওয়া মোটামুটি নিশ্চিত ছিল। কিন্তু তিনি চলে গেলেন পরপারে। অনেক রেকর্ড–অর্জনের মতো দেশের অন্য চার গ্র্যান্ডমাস্টারকে পেছনে ফেলে জিয়া এই যাত্রাতেও প্রথম হলেন!