৪৬ সেকেন্ডে বক্সিং জেতার পর ছেলে না মেয়ে নিয়ে বিতর্ক
প্যারিস অলিম্পিকে মেয়েদের বক্সিংয়ে গতকাল ৬৬ কেজি ক্যাটাগরিতে আলজেরিয়ার ইমানে খেলিফের মুখোমুখি হয়েছিলেন ইতালির অ্যাঞ্জেলা কারিনি। বেশ কয়েকটি পাঞ্চ বিনিময়ের পর লড়াই থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন ইতালিয়ান বক্সার। ম্যাচের বয়স তখন মাত্র ৪৬ সেকেন্ড! কারিনি হার মেনে নেওয়ার পর তাঁর সঙ্গে হাত মেলাতে যান খেলিফ। কিন্তু হাত না মিলিয়ে তিনি রিংয়েই হাঁটু মুড়ে বসে শিশুর মতো কাঁদতে শুরু করেন।
কোয়ার্টার ফাইনালের এই লড়াইয়ে খেলিফ দুটি শক্তিশালী পাঞ্চ করেছিলেন কারিনির মুখে। এরপর কারিনি আর লড়াই চালিয়ে যেতে পারেননি। তাঁর নাক মারাত্মকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয় এবং শর্টসে রক্তও লেগে থাকতে দেখা যায়। এ ঘটনায় ‘জেন্ডার এলিজিবিলিটি’ নিয়ম নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। জেন্ডার এলজিবিলিটি হচ্ছে সেই প্রক্রিয়া বা পরীক্ষা, যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তিকে পুরুষ বা নারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মেয়েদের বক্সিংয়ে খেলা আলজেরিয়ার খেলিফ ছেলে না মেয়ে—উঠেছে এমন প্রশ্ন।
খেলার পর সংবাদকর্মীদের সঙ্গে কথা বলার সময়ও কান্নায় ভেঙে পড়েন কারিনি, ‘প্রথম আঘাতের পরই নাক দিয়ে রক্ত ঝরছিল।’ ২৫ বছর বয়সী এই বক্সার ফুঁপিয়ে বলেন, ‘জাতীয় দলে প্রায়ই খেলি। ভাইয়ের সঙ্গেও অনুশীলন করি। ছেলেদের বিপক্ষে সব সময়ই লড়েছি। কিন্তু আজ (গতকাল) খুব ব্যথা লেগেছে।’
খেলিফ এবং তাইওয়ানের বক্সার লিন ইউ–তিংকে (আজ তাঁর ৫৭ কেজিতে ম্যাচ আছে) গত বছর ভারতে অনুষ্ঠিত মেয়েদের বক্সিং বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অযোগ্য ঘোষণা করেছিল আন্তর্জাতিক বক্সিং অ্যাসোসিয়েশন (আইবিএ)। কিন্তু প্যারিস অলিম্পিকে মেয়েদের বিভাগে খেলার জন্য তাঁরা দুজনই যোগ্য প্রমাণিত হন। তিন বছর আগে অনুষ্ঠিত টোকিও অলিম্পিকেও খেলেছেন তাঁরা।
আইবিএ গত বুধবার এক বিবৃতিতে খেলিফ ও লিন ইউ–তিংকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে খেলার ব্যাপারে অযোগ্য ঘোষণা করার ব্যাখ্যায় বলেছে, ‘মেয়েদের প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার শর্তগুলো পূরণ করতে পারেননি তাঁরা।’ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘অ্যাথলেটরা টেস্টোস্টেরন পরীক্ষায় অংশ নেননি। কিন্তু স্বতন্ত্র ও স্বীকৃত একটি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন, যেখানে সুনির্দিষ্ট ব্যাপারগুলো গোপন রাখা হয়।’
পরিচালনা, আর্থিক বিষয়াদি ও নীতিগত কিছু কারণে প্যারিস অলিম্পিকের বক্সিং ইভেন্ট আইবিএ পরিচালনা করছে না। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) অধীনে এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হচ্ছে প্যারিসে।
আইওসির মুখপাত্র মার্ক অ্যাডামস এ সপ্তাহে সংবাদকর্মীদের বলেছেন, ‘পাসপোর্ট অনুযায়ী তাঁরা নারী ও সেখানে তাঁদের নারী হিসেবেই বর্ণনা করা হয়েছে।’ খেলিফ খুব অল্প সময়ে জেতায় বিতর্ক শুরুর পরও আইওসি তাদের পূর্বের অবস্থান থেকে সরে আসেনি। বরং আইওসি এ ব্যাপারে আইবিএকেই দোষারোপ করেছে, ‘বর্তমানে এ দুই অ্যাথলেটের বিরুদ্ধে চড়াও হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে বিধিবহির্ভূত সিদ্ধান্ত।’
এদিকে বিতর্ক থেমে নেই। আইওসির দাবির সঙ্গে একমত হতে পারেননি ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি। কারিনি–খেলিফের লড়াই ‘সমান পদক্ষেপের ছিল না’ বলে মনে করেন তিনি। আইওসির নীতির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে প্যারিসে ইতালিয়ান অ্যাথলেটদের সঙ্গে সাক্ষাতে মেলোনি বলেছেন, ‘আমার মতে যেসব অ্যাথলেটের মধ্যে পুরুষদের জিনগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তাঁদের মেয়েদের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে দেওয়া উচিত নয়।’
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যাল এ বলেছেন, ‘মেয়েদের খেলাধুলা থেকে ছেলেদের বাইরে রাখব আমি।’ হ্যারি পটার বইয়ের লেখিকা জেকে রোলিং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘এক্স’–এ লিখেছেন, ‘কারিনির সঙ্গে নির্মম অবিচারের জন্য চিরকালের মতো কলঙ্কিত হলো’ প্যারিস অলিম্পিক। তিনি আরও লিখেছেন, ‘এক তরুণ নারী মুষ্টিযোদ্ধা পরিশ্রম ও অনুশীলন করে প্রস্তুত হয়েই এসেছিল, কিন্তু তাঁর কাছ থেকে সবকিছু ছিনিয়ে নেওয়া হলো। কারণ, রিংয়ে তার সঙ্গে পুরুষকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
টেনিস কিংবদন্তি মার্টিনো নাভ্রাতিলোভাও চুপ করে থাকেননি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অলিম্পিকে বক্সিং নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘শোচনীয়’ আখ্যা দিয়ে খেলিফকে তিনি বলেছেন, ‘জন্মগতভাবেই পুরুষ।’
নর্থ প্যারিস অ্যারেনায় খেলিফ রিংয়ে আসার সময়ই আলজেরিয়ান সমর্থকদের একাংশ তাঁকে বিপুল উৎসাহে সমর্থন দিয়েছে। লড়াই শেষে চলে যাওয়ার পর সংবাদকর্মীদের খেলিফ শুধু বলেছেন, ‘এমন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতা জিততে পারা সব সময়ই সন্তুষ্টির। তবে আমার মনোযোগ পদক জয়ের দিকে।’
আলজেরিয়া এবং তাইওয়ান তাঁদের বিতর্কিত দুই বক্সারের পাশে দাঁড়িয়েছে।
তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লাই চিং–তে ২৮ বছর বয়সী লিনের পাশে দাঁড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেছেন, ‘আমাদের একতাবদ্ধ হয়ে তাঁকে সমর্থন দেওয়া উচিত।’ আলজেরিয়া অলিম্পিক কমিটি (সিওএ) খেলিফকে নিয়ে প্রশ্ন তোলার নিন্দা জানিয়ে বলেছে, ‘নির্দিষ্ট কিছু বিদেশি মিডিয়া দ্বারা আমাদের সুপরিচিত অ্যাথলেট ইমানে খেলিফের প্রতি ক্ষতিকর এবং অনৈতিক আক্রমণ করা হয়েছে।’ সিওএর দাবি, যে অভিযোগ তোলা হয়েছে, সেটা ‘মিথ্যা’ এবং ‘পুরোপুরি অন্যায়’।