অলিম্পিক নিয়ে ইমরানুর রহমানের একটা স্বপ্ন ছিল। অনেক বড় স্বপ্ন। ১০০ মিটার স্প্রিন্টের ফাইনালে ওঠা। প্রতিযোগিতায় ১০.১১ সেকেন্ডের কমে কখনো এই দূরত্ব দৌড়াতে পারেননি। মাস চারেক আগে যে স্বপ্নের কথা বলেছিলেন, তা পূরণ করতে সময়টা ১০ সেকেন্ডের নিচে নামিয়ে আনতে হবে, এটাও জানতেন। কাজটা খুব কঠিন, কিন্তু চেষ্টা তো করাই যায়।
বাস্তবে কী হলো? ১০০ মিটারের ফাইনাল তো দূর অস্ত, প্রাথমিক রাউন্ড থেকেই বাদ! ভালো শুরু করেও আটজনের মধ্যে ষষ্ঠ। সময় নিয়েছেন ১০.৭৩ সেকেন্ড। প্রাথমিক রাউন্ডের ৮টি হিটের প্রতিটি থেকে প্রথম দুজন প্রথম রাউন্ডে উঠেছেন। সঙ্গে সব হিট মিলিয়ে টাইমিংয়ের বিচারে আরও চারজন। আজ নিজের হিটে ষষ্ঠ হওয়ার পর ইমরানুরের পরের রাউন্ডে যাওয়ার তাই প্রশ্নই ওঠেনি।
অলিম্পিকের অ্যাথলেটিকস ভেন্যু স্তাদে দ্য ফ্রান্সে ইমরানুরের পারফরম্যান্সের চেয়েও অবশ্য বড় হয়ে উঠল অন্য বিতর্ক। দৌড় শেষে মিক্সড জোনে রীতিমতো বোমা ফাটালেন ইমরানুর। তাঁর দাবি, চোটের কারণে বলতে গেলে তেমন কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই দৌড়েছেন। গত মার্চে তাঁর তলপেটের পেশি ছিঁড়ে যায়। এরপর থেকে কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া দূরে থাক, ঠিকমতো অনুশীলনও করতে পারেননি। অলিম্পিকের প্রস্তুতি যদি বলেন, তা শুরু হয়েছে মাত্র দিন পনেরো আগে। সেটিকেও প্রস্তুতি বলা যায় কি না প্রশ্ন। কারণ ইমরানুরের দাবি, গত মার্চের পর অলিম্পিকে এসেই তাঁর প্রথম ১০০ মিটার দূরত্ব দৌড়ানো। মাঝের সময়টাতে ৫০ মিটারের বেশি দৌড়াতেই পারেননি।
কিন্তু প্যারিসে এসেও তো ইমরানুর সাংবাদিকদের বলেছেন, অলিম্পিকের জন্য তিনি পুরো প্রস্তুত। ইমরানুরের দাবি, অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন তাঁকে এমনই বলতে বলেছিল। ইমরানুর এমনও দাবি করলেন, নিজের অবস্থা জানিয়ে ফেডারেশনকে তাঁর বদলে অন্য কাউকে পাঠানোর কথাও নাকি বলেছিলেন।
এমনিতে ইমরানুরের এসব কথা সাংবাদিকতার নীতি অনুযায়ী প্রকাশ্যে আসার কথা নয়। কারণ তিনি কথাই শুরু করেছেন ‘অব দ্য রেকর্ড’ বলে। কিন্তু এরপরের ঘটনাপ্রবাহে ইমরানুরের কথা আর ‘অব দ্য রেকর্ড’ রাখার উপায় থাকল না। মিক্সড জোনে ইমরানুরকে সামনে রেখেই এক সাংবাদিক ফোন করলেন অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রকিবকে। ফোন স্পিকারে দিয়ে ধরিয়ে দেওয়া হলো ইমরানুরকেও। আবদুর রকিব সিলেটি ভাষায় ইমরানুরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এসব বলছ কেন?’
এই প্রশ্নে অবশ্যই ইমরানুরের কথা সত্যি না মিথ্যা, সেটির মীমাংসা হয় না। যে কারণে সরাসরি আবদুর রকিবের সঙ্গে কথা বলতে স্টেডিয়ামের বাইরে বাংলাদেশের পাঁচ সাংবাদিক দেখা করলেন তাঁর সঙ্গে। আবদুর রকিবের সঙ্গে তখন বাংলাদেশের অলিম্পিক দলের শেফ দ্য মিশন ইন্তেখাবুল হামিদও আছেন। ইমরানুরের দাবি সত্যি হলেও আবদুর রকিব যে তা স্বীকার করবেন না, এটা তো অনুমেয়ই ছিল। রকিব বরং দাবি করে বসলেন, ইমরানুর চোট সম্পর্কে তাঁর কিছুই জানা নেই।
গত মার্চে প্রথম আলো ও বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশনের চোখে ২০২৩ সালের বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদের পুরস্কার নিতে ইমরানুর ঢাকা গিয়েছিলেন। তখনই সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে স্ক্যান করিয়েছিলেন ইমরানুর। তলপেটের সমস্যাটা তাতেই নিশ্চিত হয়। ইমরানুর যে স্ক্যান করিয়েছেন, আবদুর রকিব তা জানেন বলে স্বীকার করলেন। তবে স্ক্যানে কী এসেছে, তা নাকি জানেন না। দেশের সেরা অ্যাথলেট একটা সমস্যার কথা অনুমান করে স্ক্যান করাচ্ছেন, এটা জানলে সেই স্ক্যান কী বলছে, অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকের অবশ্যই তা জানার কথা। সাধারণ বুদ্ধি বিবেচনা তো তা-ই বলে।
সাধারণ বুদ্ধি-বিবেচনা অবশ্য এটাও বলে যে, অলিম্পিকে ১০০ মিটারের নিয়মকানুন অ্যাথলেটিকসের সাধারণ সম্পাদক অবশ্যই জানবেন। অথচ বিশ্বাস করবেন কি না, আবদুর রকিব সেটিও জানেন না। ইমরানুর পরের রাউন্ডে কোয়ালিফাই করেছেন দাবি করে প্রথমেই হতভম্ব করে দিলেন সাংবাদিকদের। প্রমাণ হিসেবে নিজের মোবাইলে কী সব দেখাতেও লাগলেন। সাংবাদিকেরা যতই বলেন, প্রাথমিক রাউন্ডে ৪৫ জনের মধ্যে ২৫তম ইমরানুরের কোয়ালিফাই করার প্রশ্নই ওঠে না, আবদুর রকিব নিজের দাবিতে অটল।
নিজের শেফ দ্য মিশন পরিচয় দম্ভভরে জানানো ইন্তেখাবুল হামিদ শুধু তাঁর সঙ্গে সুর মিলিয়েই থামলেন না, তিনি আরও এক কাঠি সরেস। অলিম্পিকে যেকোনো ইভেন্ট শেষেই সাংবাদিকেরা মিক্সড জোনে প্রতিযোগীদের সঙ্গে কথা বলেন। এটাই নিয়ম। শেফ দ্য মিশন তা জানলে তো! সাংবাদিকেরা কেন ইমরানুরের সঙ্গে কথা বলেছেন, তা নিয়ে তাই তিনি রীতিমতো হম্বিতম্বি শুরু করলেন। একটু পরই নাকি ইমরানুর আবার দৌড়াবেন (যেটি শুধু তাঁদের দুজনের কল্পনাতেই), এই সময়ে তাঁর মনোযোগে বিঘ্ন ঘটানোর ‘গর্হিত কাজ’ করায় সাংবাদিকদের ওপর ক্ষোভে তাঁর একেবারে যুদ্ধংদেহী রূপ। এতটাই যে, আশপাশের লোকজন অবাক হয়ে তা দেখতে শুরু করেছেন।
পরে অবশ্য আবদুর রকিব ও ইন্তেখাবুল হামিদ দুজনই ফোন করে সাংবাদিকদের ‘সরি’ বলেছেন। এর আগে অবশ্যই তাঁরা আরেকটা কাজ করে থাকবেন বলে অনুমান করাটা কঠিন কিছু নয়। ইমরানুরকে দিয়ে বলিয়েছেন, যা কিছু হয়েছে, সেটির পুরো দায়ই তাঁর। ফেডারেশন কোনো জোর করেনি।
বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে অলিম্পিকে কোনো পদক না জেতার অগৌরবের রেকর্ডটা বাংলাদেশের। এতে বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদদের খুব একটা দোষ নেই। অলিম্পিক পদক পাওয়ার মতো কিছু তাদের জন্য করা হলে তো! তবে পদকের লড়াইয়ে না থাকলে কী হবে, বিতর্কের লড়াইয়ে বাংলাদেশ প্রায়ই থাকে। ইমরানুর রহমান যে বিতর্কের ইতিহাসে সর্বশেষ সংযোজন।