সুফিয়া খাতুনকে আজও ভোলেনি মুর্শিদাবাদ
পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে তাঁর জন্ম ১৯৫০ সালে। সম্পত্তি বিনিময় করে ১৯৬৫ সালে পরিবার নিয়ে বাবা পাবনায় চলে আসেন। সেই থেকে সুফিয়া খাতুন হয়ে যান এপার বাংলার মেয়ে। বাংলাদেশের কিংবদন্তি অ্যাথলেট।
কিন্তু অ্যাথলেট হিসেবে তাঁর ভিত্তিটা তৈরি হয়েছিল মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের সাদিখাঁরদিয়াড় বিদ্যানিকেতনে। এই স্কুলের হয়েই ষাটের দশকে ১০০ ও ২০০ মিটার দৌড়ে গোটা ভারতে চোখ কাড়েন সুফিয়া খাতুন। অল ইন্ডিয়া স্কুল প্রতিযোগিতায় ওড়ান সাফল্যের পতাকা। চণ্ডীগড়ে সর্বভারতীয় জুনিয়র ন্যাশনালে পশ্চিমবঙ্গের হয়ে ১০০ মিটারে চ্যাম্পিয়ন। শিলংয়ে অল ইন্ডিয়া স্কুল ন্যাশনালেও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সেরা।
সুফিয়া খাতুনের সেই স্কুলের হীরকজয়ন্তী উদ্যাপিত হলো সম্প্রতি। ৪ জানুয়ারি ম্যারাথন দিয়ে যার শুরু। নাচ-গান, কবিতা, কুইজ, ফুটবল ম্যাচসহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান...স্কুলের কৃতী ছাত্রছাত্রীদের পুরস্কার দেওয়া। মূল ক্রীড়ানুষ্ঠান চলে ২২-২৪ জানুয়ারি। ২৩ জানুয়ারি স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী আর শিক্ষকদের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানটা জমেছিল বেশি। ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ থেকে স্কুলের প্রাক্তনেরা এসেছেন।
সেসব অনুষ্ঠানের মধ্যমণি হয়ে ছিলেন সুফিয়া খাতুন। স্কুলের প্রাক্তনদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত যে তিনিই। কীভাবে, তা অর্জনের তালিকায় চোখ বোলালেই পরিষ্কার বোঝা যায়। ১৯৬৮ সালে ঢাকায় পাকিস্তান অলিম্পিকে ১০০ মিটার জিতে পাকিস্তানের দ্রুততম মানবী হয়েছিলেন।
বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে নিজের প্রথম জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপেও দ্রুততম মানবী। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত টানা পাঁচবার ধরে রেখেছেন যে শ্রেষ্ঠত্ব। ২০০ মিটার, লংজাম্পেও পদক জিতেছেন। খেলা ছেড়ে হয়েছেন কোচ। কোচিং করিয়েছেন এই সেদিনও। অ্যাথলেটিকস ছাপিয়ে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনেই উজ্জ্বল এক নাম। সেটিরই স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৬ সালে প্রথম আলোর ক্রীড়া পুরস্কারে পেয়েছেন আজীবন সম্মাননা। এর ২০ বছর আগেই পেয়েছেন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার।
এবার নিজের ‘আঁতুড়ঘরে’ সংবর্ধনা পেয়ে দারুণ উচ্ছ্বসিত তিনি। মুর্শিদাবাদ থেকে ফোনে তা প্রকাশ করেন এভাবে, ‘আমার স্কুলের হীরকজয়ন্তী হয়েছে অনেক জাঁকজমকপূর্ণভাবে। তিন-চারটি অনুষ্ঠানে আমি প্রধান অতিথি ছিলাম। ওরা আমাকে এত সম্মান দিয়েছে যে তা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। আমি সত্যিই অভিভূত, ধন্য। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আগামী ৮-১০ মার্চ। স্কুল থেকে ফোন করে বলে রেখেছে, এই তিন দিনও থাকতেই হবে।’
সুফিয়ার পৈতৃক বাড়ি থেকে সাদিখাঁরদিয়াড় বিদ্যানিকেতন ঢিল ছোড়া দূরত্বে। তবে এখন তিনি আছেন স্কুল থেকে চার কিলোমিটার দূরের জলঙ্গিতে, যেখানে স্থায়ীভাবে থাকেন তাঁর মেয়ে মাহফুজা বিশ্বাস। আরও অনেক আত্মীয়ও। তাঁর ভাইবোনেরা যদিও কেউ আর বেঁচে নেই, তবে তাঁদের ছেলেমেয়েরা আছে। সুফিয়া খাতুনের শ্বশুরবাড়িও সেখানে। সবার সঙ্গে দেখা করতে মাঝেমধ্যেই জন্মভিটায় যান। তবে এবারের যাওয়াটা ভিন্ন রকম।
স্কুলের হীরকজয়ন্তীতে স্মারক উপহার পেয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মন্ত্রী আনিসুর রহমান তা তুলে দিয়েছেন সুফিয়ার হাতে। জেলার মান্যগণ্যরা এসেছেন অনুষ্ঠানে। ফোনের ওপ্রান্তে উচ্ছ্বসিত শোনায় সুফিয়া খাতুনের কণ্ঠ, ‘কদিন ধরে এত আনন্দে আছি যে বলার মতো নয়। পুরোনো লোকজন দেখা হলেই সুফিয়াদি, সুফিয়াদি বলে ডাকে। আমি তো এখন অসুস্থ। কিন্তু এখানে এসে চনমনে হয়ে গেছি।’
গত সেপ্টেম্বরে সুফিয়া খাতুনের হৃদ্যন্ত্রে বসানো হয়েছে দুটি রিং। বয়স হয়ে গেছে ৭৪। একমাত্র ছেলে থাকে রাজশাহীতে। একমাত্র মেয়ের কাছে বেড়াতে গেছেন গত ২৩ ডিসেম্বর। ১৫-২০ মার্চের দিকে বাংলাদেশে ফিরে আসার কথা।
জন্মভূমিতে বসে সুফিয়া খাতুন ছোটবেলার স্মৃতিচারণা করেন। বলেন, আজও তাঁকে ভোলেনি মুর্শিদকুলি খাঁর জেলা। মোগল আমলে মুর্শিদাবাদ ছিল বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজধানী। সেখান থেকে ২১০ কিলোমিটার দূরের কলকাতায় গিয়ে খেলাটা কঠিন ছিল। তবু কলকাতার ধর্মশালায় বেহালা অ্যাথলেটিক ক্লাবের হয়ে খেলেছেন। ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ভোলানাথ চ্যাটার্জির বাসায় থাকতেন। বাবা ৩৫ নম্বর বেহালার ট্রামে উঠিয়ে দিলে ক্লাবে গিয়ে নামতেন। সেসব দিন তাঁকে আজ আপ্লুত করে, ‘তখন সারা ভারতেই অ্যাথলেটিকসে মুসলমান মেয়ে বলতে গেলে ছিলই না। সাদিখাঁরদিয়াড় স্কুল আজ যে এত সম্মান করছে, সেটা তো স্কুলের হয়ে আমার সাফল্যের কারণেই।’
কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার ২৬ মে ১৯৬৫ সালের সংখ্যায় সুফিয়া খাতুনকে নিয়ে লেখা হয়েছিল, ‘চণ্ডীগড়ের ইন্টার স্টেট স্পোর্টসে স্ট্যান্ডের মাঝখানে দাঁড়িয়ে মুর্শিদাবাদের সাদিখাঁরদিয়াড় গ্রামের গরিব চাষী ফারুকউদ্দিনের (আসলে ফরিদ মণ্ডল) বড় মেয়ে সোফিয়া খাতুন। বয়স ১৪। সেদিন কেউ ভাবতেও পারেনি যে বাংলার অজপাড়াগাঁয়ের এই মেয়েই বাংলার মুখ রাখবে। সোনার মেডেল নিয়ে আসবে দুখানা।’
সেই সুফিয়া খাতুনের শোকেস কবেই ভরে গেছে অসংখ্য পদকে। ছোটবেলার স্কুল থেকে পাওয়া স্মারক উপহারটাও এখন যোগ হলো এর সঙ্গে। সুফিয়া খাতুনের সবচেয়ে বেশি আবেগও সম্ভবত এটিকে ঘিরেই থাকবে।