শান্তিরক্ষী থেকে জীবনের পুলে রোমানা
খেলা থেকে দূরে প্রায় পাঁচ বছর। বিয়ে-সন্তান-সংসার-চাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। মাঝখানে জাতিসংঘ মিশনে সুদান গিয়ে দেখে এসেছেন জীবনের অন্য রূপ। সেই অভিজ্ঞতা রোমানা আক্তারকে জীবনে অনেক কিছু শিখিয়েছে। অনুপ্রেরণা দিয়েছে আবার সাঁতার পুলে ফিরতে।
কিশোরগঞ্জের নিকলির মেয়ে রোমানা পুলে ফিরেই আলো কেড়েছেন। মিরপুর জাতীয় সাঁতার কমপ্লেক্সে আজ শুরু হওয়া ম্যাক্স গ্রুপ ৩৩তম জাতীয় সাঁতারের প্রথম দিনে ১০ ইভেন্টের মধ্যে চারটিতে নতুন জাতীয় রেকর্ড হয়েছে। ২৫ বছর বয়সী রোমানা রেকর্ড গড়ে জিতেছেন ১০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকের সোনা। সেটিও জীবনের সেরা টাইমিং করে। পুলে ফেরাটা এর চেয়ে স্মরণীয় হতে পারত না তাঁর জন্য। ২০১২ থেকে জাতীয় সাঁতারে তাঁর সোনার সংখ্যা হলো ৯।
রোমানা আক্তার ও ফয়সাল আহমেদ, স্বামী-স্ত্রী মিলে প্রথম দিনই জিতেছেন মোট চারটি পদক
২০১৬ এসএ গেমসে সাঁতারে ২০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে ব্রোঞ্জ পেয়েছিলেন রোমানা। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে নেপালে হওয়া সর্বশেষ এসএ গেমসে ৫০, ১০০, ২০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোক—তিনটিতেই হয়েছেন চতুর্থ। সেই গেমসের পর পর সাঁতার থেকে দূরে ছিলেন। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বিয়ে করেন। স্বামী ফয়সাল আহমেদও সাঁতারু। সেনাবাহিনীর করপোরাল পদে আছেন। ফয়সালের মূল ইভেন্ট ৪০০ মিটার ফ্রিস্টাইল। আজ তিনি ২০০ মিটার ফ্রিস্টাইলে ব্রোঞ্জ ও ২০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে রুপা জিতেছেন। রোমানা ২০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে ব্রোঞ্জ পেয়েছেন। ফলে স্বামী-স্ত্রী মিলে প্রথম দিনই জিতেছেন মোট চারটি পদক।
২০২১ সালের মার্চে এই সাঁতারু দম্পতির কোলে আসে কন্যাসন্তান ফালাক আহমেদ। ছোট্ট কন্যাকে দেশে রেখেই ২০২২ সালের মার্চে সুদানে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে যান রোমানা। ফেরেন ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে। মিশনফেরত রোমানা আজই প্রথম প্রতিযোগিতামূলক সাঁতারে নেমে দারুণ উচ্ছ্বাসিত। প্রথম আলোকে বললেন, ‘খেলায় ফেরার ইচ্ছা ছিল। তবে লম্বা বিরতি পড়ায় কিছুটা আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগছিলাম। সেনাবাহিনী দলে জায়গা পাওয়াও ছিল কঠিন। বাহিনী আমাকে ফিরিয়ে এনেছে আগের পারফরম্যান্স দেখে। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। তবে রেকর্ড গড়ে সাঁতারে ফিরব, এটা ভাবনার বাইরে ছিল।’
রোমানার বাবা নেই। ৪ বোন ৬ ভাইয়ের পরিবারে একমাত্র তিনিই সরকারি চাকুরে। চাকরির টাকা নিয়মিত পাঠান মায়ের কাছে, আর এতে খুব গর্বিতও তিনি। নিজের জীবনসংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে একটু আবেগ ছুঁয়ে যায় রোমানাকে, ‘এভাবে পরিবারকে সহায়তা করে যেতে চাই। একটা মেয়ে সংসারজীবনে ঢুকে গেলে খেলায় ফেরা অনেক কঠিন। সন্তান সামলানো সহজ নয়। সঙ্গে চাকরি। যে চাকরি আবার খেলা নিয়ে। সবচেয়ে বেশি ভালো লাগছে ফিরে এসেছি জীবনের সেরা টাইমিং করে।’
সুদানের জীবনটা ছিল অন্য রকম। মানুষকে নিরাপত্তা দিতে হয়েছে সেখানে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজে হয়েছে। সেসব দিনে ফিরে রোমানা বলছিলেন, ‘জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা বাহিনীর হয়ে কাজ করেছি। স্থানীয় মানুষদের নিরাপত্তা দেওয়াই ছিল আমার বড় কাজ। সেখানে খেলা থেকে পুরোপুরিই দূরে ছিলাম। কোনো সুইমিং পুল ছিল না। তবে আমাদের পিটি হতো। পিটির মাধ্যমে ফিটনেস ধরে রাখার চেষ্টা করেছি, যা এখন আমার কাজে লেগেছে।’
জাতীয় সাঁতারে আরও রেকর্ড গড়েছেন ৫০ মিটার ব্যাকস্ট্রোকে নৌবাহিনী সামিউল ইসলাম, ৫০ মিটার ব্যাকস্ট্রোকে একই দলের যুথী আক্তার, ২০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে কাজল মিয়া।
মেয়ের জন্য খেলতে পারিনি। ওর বয়স এখন ৩ বছর ৮ মাস। সাঁতার কমপ্লেক্সে আজ ওকে আনিনি। তবে আমার মেয়েই আমার গোল্ড। তার জন্যই আমার আজকের সাফল্য
গত বাংলাদেশ গেমসে অংশ নিতে পারেননি। এসব নিয়ে তাঁর কোনো আক্ষেপ নেই। যেটি বোঝা যায় তাঁর এই কথায়, ‘মেয়ের জন্য খেলতে পারিনি। ওর বয়স এখন ৩ বছর ৮ মাস। সাঁতার কমপ্লেক্সে আজ ওকে আনিনি। তবে আমার মেয়েই আমার গোল্ড। তার জন্যই আমার আজকের সাফল্য।’
নিকলি স্থানীয় কোচ আবদুল হাশেমের হাত ধরে তাঁর উঠে আসা। হাশেম যখন পুকুরে অন্যদের সাঁতার শেখাতেন, পুকুরপাড়ে যেতেন ছোট্ট রোমানা। খেলা দেখতেন। সাভার বিকেএসপিতে ভর্তি হন ২০০৯ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে। ২০১৪ সালে দশম শ্রেণিতে উঠে বিকেএসপি ছাড়েন। যোগ দেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে এসএসসি পাস করেন। উচ্চমাধ্যমিক পেরোন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ইসলামিক স্টাডিজে এখন স্নাতক পড়ছেন উত্তরায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
‘পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাই, খেলাও চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আছে’—রোমানার এই কথায় ফুটে ওঠে এক সাহসী মেয়ের প্রতিচ্ছবি।