২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

একজন ‘মেরি কমে’র খোঁজে বাংলাদেশে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন রুকসানা

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ বক্সার রুকসানা বেগমছবি : সংগৃহীত

‘লড়াই করে বেঁচে থাকার নামই জীবন’—কথাটা রুকসানা বেগমের চেয়ে ভালো কেই–বা বুঝতে পেরেছেন! বক্সিং রিংয়ে লড়তে হয় প্রতিপক্ষের সঙ্গে। কিন্তু রিংয়ের বাইরেও যে পাহাড় সমান লড়াই করতে হয়েছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ বক্সারকে, লড়তে হয়েছে নিজের পরিবার, সমাজের সঙ্গেও।

কখনো জিমনেসিয়ামে অনুশীলনে সতীর্থ বক্সারের বাজে আচরণের শিকার হয়েছেন। শারীরিক গড়ন আর উচ্চতা (৫ ফুট ৩ ইঞ্চি) নিয়ে শুনেছেন নেতিবাচক কথা। এমনও হয়েছে বক্সিং রিংয়ে লড়াইয়ের ফাঁকে সহযোগিতা নেওয়ার মতো কাউকে খুঁজে পাননি।

কিন্তু সব প্রতিকূলতা জয় করে হয়েছেন ব্রিটিশ মুয়ে থাই (কিক বক্সিংয়ের একটি বিশেষ ধরন) চ্যাম্পিয়ন। ২০১৬ সালে জিতেছেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের খেতাব। এর দুই বছর পর নাম লিখিয়েছেন পেশাদার বক্সিং জগতে।

শারীরিক গড়ন আর কম উচ্চতার কারণে রুকসানাকে অনেক নেতিবাচক কথা শুনতে হয়েছে
ছবি : সংগৃহীত

ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আজ রাতে হবে আন্তর্জাতিক পেশাদার বক্সিং প্রতিযোগিতা। এক্সেল স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড প্রমোশনসের আয়োজনে এই বক্সিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে ইংল্যান্ড থেকে পরশু ঢাকায় এসেছেন রুকসানা।

মূলত শেকড়ের টানে বাংলাদেশের বক্সিং প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার আগ্রহ রুকসানার। ও হ্যাঁ, বলাই হয়নি—রুকসানার আদি বাড়ি সিলেটের বালাগঞ্জে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রুকসানার দাদা ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান। ব্রিটিশ আর্মির হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন তিনি। এরপর বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যান তাঁর দাদিকে। বাবা আওলাদ আলীও সিলেট থেকে একসময় লন্ডনে চলে যান। আওলাদ ও মিনারা বেগম দম্পতির মেয়ে রুকসানার জন্ম হয়েছে লন্ডনেই।

পড়ার টেবিলের চেয়ে খেলার মাঠ বেশি টানতো রুকসানাকে। স্কুলে টিফিনের বিরতিতে ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলতেন। অন্য মেয়েদের মতো ততটা মেধাবী ছিলেন না স্কুলে। কিন্তু খেলাধুলায় ছিলেন দুর্দান্ত। ছেলেরা দল গড়তে গেলে রুকসানাকে রাখত।

প্রো-বক্সিংয়ে খেলে অনেক কিছু করা সম্ভব। কোনো প্রতিপক্ষকেই ভয় পাই না। কারণ, আমি বিশ্বাস করি, আমি পারব। বাঙালি মেয়েদের এই কথাটাই বোঝাতে চাই। বর্তমানে বক্সিংয়ে অনেক সম্ভাবনা। মেয়েদের এই খেলায় এগিয়ে আসা উচিত।
রুকসানা বেগম

অথচ বাড়িতে অন্য বাংলাদেশি মেয়ের মতোই ছিলেন রুকসানা। মাকে রান্নায় সাহায্য করতেন। অন্য বাঙালি পরিবারের মতো বয়স ২০ হওয়ার আগেই বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন মা–বাবা। কিন্তু স্কুলে পুরো উল্টো চরিত্রের রুকসানা। আত্মবিশ্বাসী, উচ্চাভিলাষী রুকসানা স্বপ্ন দেখতেন আকাশ ছোঁয়ার। কিন্তু একই সঙ্গে দুই ভুবনে বাস করা রুকসানার জন্য স্বপ্ন সত্যি করাটা কঠিনই ছিল।

আরও পড়ুন

রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেলে নিজের কক্ষে বসে শুরুর সেই লড়াইয়ের গল্পটা বলছিলেন রুকসানা, ‘পড়ালেখা শেষ হওয়ার আগেই আমাকে জোর করে বিয়ে দেন মা–বাবা। কিন্তু স্বামীর সংসারে বেশি দিন টিকতে পারিনি। সেখানে অতিরিক্ত কাজ করতে হতো আমাকে। একপর্যায়ে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। তখন প্যানিক অ্যাটাকের শিকার হই। কারণে–অকারণে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়তাম। চিকিৎসকের পরামর্শে বাবা আমাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। কিছুদিন পর আমাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। মানসিক অবসাদ থেকে বের হতেই বক্সিং শুরু করি।’

ছোটবেলা থেকেই মারামারির খেলাটা পছন্দ রুকসানার, ‘ছোটবেলা টেলিভিশনে ব্রুসলিকে দেখতে অনেক ভালো লাগত। আমি তাঁর বড় ভক্ত ছিলাম। তাঁর স্কিল দেখে মুগ্ধ হতাম। এরপরই মনে হলো এই খেলাটাই আমার পছন্দের।’

২৩ বছর পর বাংলাদেশে এসেছেন রুকসানা
ছবি : প্রথম আলো

একে তো মুসলিম এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত, এর ওপর একজন নারী। সব মিলিয়ে রুকসানার জন্য বক্সার হয়ে ওঠাটা সহজ ছিল না, ‘মুসলিম নারী হওয়ায় অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছি। তখন ছেলেরাই বেশির ভাগ মার্শাল আর্ট অনুশীলন করত, পাশ্চাত্যের মেয়েরাও তেমন একটা মার্শাল আর্টে আগ্রহী ছিল না। আমি যখন খেলা শুরু করি হাতে গোনা চার পাঁচজন মেয়ে মার্শাল আর্টে অংশ নিত। শুরু থেকেই জানতাম এই সফরটা আমার জন্য কঠিন হবে। আমি অনেক বছর পর্যন্ত নিজের ইচ্ছার কথা গোপন রেখেছিলাম পরিবারের কাছে। তাঁদের না জানিয়েই পাঁচ বছরের মতো ট্রেনিং চালিয়ে গেছি।’

ক্যারিয়ারের প্রথম ট্রফিটা তো সবার সামনে বাড়িতে আনতেই পারেননি ভয়ে, ‘একটা পলিথিনের ব্যাগে মুড়িয়ে প্রথম জেতা ট্রফিটা বাড়িতে আনি। যাতে বাবা এটা দেখতে না পান। এরপর ছোট বোনের সহযোগিতায় সেটা ওয়ার্ডরোবে লুকিয়ে রাখি।’

আরও পড়ুন

বক্সিং রিংয়ে জীবনের নতুন ক্যানভাস খুঁজে পান রুকসানা, ‘বক্সিং আমাকে জীবনের নতুন পথ দেখিয়েছে। কীভাবে প্রাণবন্তভাবে বাঁচা যায়, লক্ষ্যে কীভাবে অবিচল থাকতে হয়, এটা শিখিয়েছে বক্সিং। জানি জীবনে সব কাজে হয়তো সফল হব না। তবে বক্সিং আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে সেগুলোর মুখোমুখি হতে হবে। হতাশায় ভুগলে বক্সিং অনুশীলনে যেতাম। মা বলতেন, যদি আমি এটা করে ভালো থাকি তো মন্দ কি।’

বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের খেতাব জেতার স্মৃতি আজও ভোলেননি রুকসানা, ‘সেই লড়াইয়ের এক সপ্তাহ আগে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমি নিশ্চিত ছিলাম না লড়তে পারব। এরপর কোচের সঙ্গে কথা বলি। এটা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ, এখানে সবাই নিজের সেরাটা উজাড় করে দিয়ে খেলবে। কেউ কাউকে ছাড় দেবে না। পুরো ফিট না হয়ে খেলাটা খুব ঝুঁকি ছিল। কিন্তু আমি লড়াই করার জন্য মুখিয়ে ছিলাম। প্রথম ব্রিটিশ-বাংলাদেশি হিসেবে নিজেকে মেলে ধরার সুযোগটা পুরোপুরি কাজে লাগাতে চেয়েছি এবং আমি পেরেছি।’

অন্য বক্সাররা ট্র্যাকস্যুট–ট্রাউজার পরলেও রুকসানা শাড়ি পরে এসেছিলেন। গতকাল গুলশান ক্লাবে
ছবি : সংগৃহীত

চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর রুকসানাকে নিয়ে মেতে ওঠে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম। অ্যাডিডাস, প্যানডোরা, জিম শক, অ্যাপলের মতো প্রতিষ্ঠান স্পনসরের জন্য খুঁজে নেয় রুকসানাকে। সাফল্যের স্বীকৃতিটা পেতে কতটা অপেক্ষা করতে হয়েছে সেটা ভালোই জানেন তিনি, ‘আমার এই সাফল্য একদিনে আসেনি। দশ বছরের কঠোর পরিশ্রমের পর ওই পর্যায়ে পৌঁছাই।’

মেরি কম যা অর্জন করেছেন তা সত্যিই প্রসংশার দাবি রাখে। শাহরুখ খানের মতো তারকাও মেরি কমকে অভিনন্দন জানিয়ে বার্তা পাঠিয়েছেন। কারণ, তিনি ভারতের মেয়েদের আশার আলো দেখিয়েছেন। বক্সিং মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিতে পারে। এমন একজন বাংলাদেশেও তৈরি হতে পারে। এখান থেকেই ভবিষ্যতের চ্যাম্পিয়ন উঠে আসতে পারে। উঠে আসতে পারে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো তারকা।
রুকসানা বেগম

লন্ডনের মুসলিম স্কুল ছাত্রীদের বিনা মূল্যে বক্সিং শেখান রুকসানা। ফাইট ফর পিস ও স্পোর্টিং ইকুয়াল—নামের দুটি সংগঠনের শুভেচ্ছাদূত। ২০১২ সালে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে একবার দেখা করার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। সেই প্রসঙ্গ তুলতেই বললেন, ‘আমি মেয়েদের নিয়ে কাজ করি। মেয়েদের এসব প্রতিবন্ধকতার বৃত্ত ভাঙার কারণেই সুযোগ পাই রানী এলিজাবেথের সঙ্গে দেখা করার। উনি জিজ্ঞাসা করেন, এই খেলায় তো অনেক ব্যথা সহ্য করতে হয়? আমি তখন হেসে বলি, জ্বি ম্যাডাম। উনি আমার লড়াইয়ের গল্পটা শুনেছিলেন। এটা সত্যিই স্বপ্নের মতো ছিল আমার কাছে।’

আরও পড়ুন

২৩ বছর আগে সর্বশেষ বাংলাদেশে এসেছিলেন রুকসানা। এবার এসে ঢাকায় রিকশায় চড়েছেন। নিজে রিকশা চালিয়েছেনও! আবারও দেশের মাটিতে আসতে পেরে আনন্দিত ৩৯ বছর বয়সী বক্সার, ‘এখানে আমার শেকড় গাঁথা। বাংলাদেশে এসে খেলাটা আমার জন্য অনেক বড় কিছু। একজন নারী বক্সার হিসেবে ইংল্যান্ডে আমি যে পরিবর্তন আনতে পারি, তার চাইতে অনেক বেশি পরিবর্তন আনতে পারব এখানে। মেয়েরা এখানে আমাকে দেখে অনুপ্রাণিত হবে। তারা বিশ্বাস করবে যে চাইলেই স্বপ্ন সত্যি করা সম্ভব।’

পেশাদার বক্সিংয়েও যে জীবন বদলে যেতে পারে, সেটা বোঝাতে চান মেয়েদের। রুকসানা বলেন, ‘বক্সিংয়ে খুব ভালো ক্যারিয়ার আছে, এটা এখানকার মানুষদের বোঝাতে চাই। বক্সিংয়ের বাজার বাংলাদেশের বাইরে অনেক বড়। প্রো-বক্সিংয়ে খেলে অনেক কিছু করা সম্ভব। কোনো প্রতিপক্ষকেই ভয় পাই না। কারণ, আমি বিশ্বাস করি, আমি পারব। বাঙালি মেয়েদের এই কথাটাই বোঝাতে চাই। বর্তমানে বক্সিংয়ে অনেক সম্ভাবনা। মেয়েদের এই খেলায় এগিয়ে আসা উচিত।’

পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বক্সার ভারতের মেরি কম
ফাইল ছবি

বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভারতীয় বক্সার মেরি কমের লড়াইয়ের গল্পটা অজানা নয় রুকসানার। বাংলাদেশেও তৈরি করতে চান নতুন কোনো মেরি কম, ‘মেরি কম যা অর্জন করেছেন তা সত্যিই প্রসংশার দাবি রাখে। শাহরুখ খানের মতো তারকাও মেরি কমকে অভিনন্দন জানিয়ে বার্তা পাঠিয়েছেন। কারণ, তিনি ভারতের মেয়েদের আশার আলো দেখিয়েছেন। বক্সিং মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিতে পারে। এমন একজন বাংলাদেশেও তৈরি হতে পারে। এখান থেকেই ভবিষ্যতের চ্যাম্পিয়ন উঠে আসতে পারে। উঠে আসতে পারে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো তারকা।’