কিলি হজকিনসনের জন্ম বাংলাদেশে হলে নিশ্চিত ‘লেট লতিফ’ তকমা জুটে যেত। প্রায় সব কাজে যে দেরি করার বদঅভ্যাস তাঁর। কিন্তু প্যারিসে গতকাল রাতে এই ব্রিটিশ দৌড়বিদ দেরি করেননি। মাত্র ১ মিনিট ৫৬.৭২ সেকেন্ড সময়ে পৌঁছেছেন মেয়েদের ৮০০ মিটার দৌড়ের ফিনিশিং লাইনে। তারপর তো উদ্যাপন শেষে বিজয় মঞ্চে উঠতে হলো। সোনার পদক গলায় হজকিনসন যখন সেখানে দাঁড়িয়ে, তখন কি তাঁর সেই সময়টা মনে পড়েছে? হজকিনসন তখন হাঁটতে পারতেন না। ভাগ্যের কী খেলা, হাঁটতে পারবেন কি না সেই দুশ্চিন্তায় একটা সময় কাটানো হজকিনসনই দুই পায়ের গতিময় পদক্ষেপে তুলে আনলেন সোনা!
শুধু সোনার পদক কেন, ছোট্ট এক টুকরো ইতিহাসও আছে। ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিকে কেলি হোমসের পর প্রথম ব্রিটিশ নারী হিসেবে এই ইভেন্টে সোনা জিতলেন হজকিনসন। তাঁর কোচ ট্রেভর পেইন্টার এই আনন্দে আপাতত শিষ্যের দেরি করার বদঅভ্যাস নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না। পেইন্টারের স্ত্রী ও ৮০০ মিটারে সাবেক ব্রিটিশ দৌড়বিদ জেনি মিডোজও হজকিনসনের কোচ। স্বামী-স্ত্রী মিলেই কোচিং করান তাঁকে।
শিষ্যের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত পেইন্টার বলেছেন, ‘কখনো কখনো সে হয়তো ২০ থেকে ২৫ মিনিট দেরি করে, তারপর মুচকি হাসি দিয়ে হেঁটে চলে যাবে। কিন্তু আমরা যদি তাকে ধরে রাখি, একটি বক্সে রেখে বলি তাকে এটার আকার নিতে হবে, তাহলে সে ওই মানুষটা হবে না যাকে আমরা ১ মিনিট ৫৪.৬১ সেকেন্ডে দৌড়াতে দেখেছি (গত মাসে ডায়মন্ড লিগে ব্রিটিশ রেকর্ড)। সে এখন যা, সেটা তার মুক্ত চেতনার স্বভাবের জন্য।’
কৈশোরের শুরুতে কঠিন সময় কেটেছে হজকিনসনের। কানে একটি টিউমার হয়েছিল। তাতে ক্যানসারের জীবাণু ছিল না। কিন্তু সেই টিউমারে হাঁটতে পারবেন কি না আর, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানকে সেসব দিনের কথা বলেছেন হজকিনসন, ‘১০ বছর ধরে এটা বেড়ে উঠেছিল কিন্তু কেউ ধরতে পারেনি। স্নায়ুতন্ত্র আক্রান্ত হওয়ার খুব কাছাকাছি ছিলাম। স্নায়ু আক্রান্ত হলে হলে হয়তো ফেসিয়াল প্যালসি (মুখের প্যারালাইসিস) হতো, তাই এটা নির্মূল করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।’
স্কাই স্পোর্টসকে হজকিনসন এ নিয়ে বলেছেন, ‘হাঁটতে পারতাম না। এটা একটু অদ্ভুত। কারণ সমস্যাটা ছিল কানে। তবে সৌভাগ্যবশত সব পরিকল্পনা অনুযায়ীই হয়েছে। ওটা নির্মূল করা হয় এবং আমি তাতে কানে কম শোনা শুরু করি। সেটা অবশ্য মন্দ না।’ হজকিনসন কানের ৯৫ শতাংশ শোনার ক্ষমতা হারিয়েছেন। মজা করে এই অ্যাথলেট আরও বলেছেন, ‘লোকে যখন মাস্ক পরে আমার কষ্টকর উঠে আসার কথা বলে তখন বুঝতে পারি লিপ রিডিংয়ের ওপর আমি কতটা নির্ভরশীল।’
শৈশবে হজকিনসন সাঁতারুও হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর বাবা মেয়ের ভবিষ্যৎ দেখেছেন অ্যাথলেটিকসে। হজকিনসন জানিয়েছে, তাঁর বয়স যখন ১২ বছর তখন তাঁর বাবা স্কুলের একটি দৌড়ের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে তাঁকে এক জোড়া জুতো ঘুষ দিয়েছিলেন। সে জন্য বাবাকে এখন ধন্যবাদ দেন হজকিনসন। কেন? বাবা তাঁকে ‘কমফোর্ট জোন’ থেকে বের করে এনেছেন সে জন্য।
২০২১ টোকিও অলিম্পিকে রুপা জিতেছিলেন হজকিনসন। ২০২২ ও ২০২৩ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ এবং ২০২২ কমনওয়েলথ গেমসেও জিতেছেন রুপা। প্যারিসে তাঁর সোনালি সাফল্য বাবা-মায়ের জন্য এক অন্যরকম প্রশান্তির ছোঁয়াও। হজকিনসন যখন বাইরে থেকে তহবিল পাচ্ছিলেন না তখন তাঁর বাবা ডিন এবং মা র্যাচেল টাকা ঢেলেছেন।
অ্যাথলেটিকসের বাইরেও হজকিনসনের অন্য এক জীবন আছে। সেটি পুরোনো গাড়ির। মেইল অনলাইনকে এ নিয়ে বলেছেন, ‘পিন্টারেস্টে আমি দারুণ একটি গাড়ি দেখেছি। ভাই বলে, তুমি কি জানো এগুলোর দাম কত বেশি? বলেছি অলিম্পিকে জিতলে ওই গাড়িটা নিজেকে উপহার দেব।’
গাড়ির মালিক এখন ফোন কল পেতেই পারেন।